২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল না

১৯৭৫ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অস্থির সময়। বছরের শুরুতে বাকশাল গঠন করা হয় এবং ১৫ আগস্ট সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নির্মমভাবে নিহত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সামরিক অভ্যুত্থান, জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড, পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান—এ রকম একের পর এক ঘটনা ঘটে। ৩ নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান

আমাদের এই অঞ্চল হাজার বছরের বেশি ছিল সামন্তপ্রভুদের অধীন। তাঁরা ছিলেন বিদেশি। তাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন এ দেশের লোকদের সাহায্য নিয়ে। সামন্তপ্রভুরা ছিলেন ঈশ্বরতুল্য। তাঁদের মহিমান্বিত করে কাব্য করতেন একদল পোষা দরবারি কবি। সেখানে প্রভুদের বন্দনা করে বলা হতো—‘মহামহিম, আপনি না থাকলে চন্দ্র-সূর্য উঠবে না, রাজ্য যাবে রসাতলে।’

তারপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বারবার। রাজ্য হয়েছে রাষ্ট্র। সামন্তপ্রভুর ফরমানের জায়গা নিয়েছে কাগুজে সংবিধান। যেহেতু রাজা-প্রজার সম্পর্কে পরিবর্তন আসেনি, সম্পর্কটা যেহেতু শাসক আর শাসিতের, তাই ‘সংবিধান’কে আমরা ‘শাসনতন্ত্র’ বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এত পরিবর্তনের পরও রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা রাজার মতোই ঈশ্বরতুল্য থেকে গেছেন। তাঁদের পূজা চলে। তাঁদের নিয়ে লেখা হয় পদাবলি—‘তিনি না জন্মালে এ দেশ হতো না, তিনি না থাকলে ঘোর অন্ধকার’ ইত্যাদি।

রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে দাবা বা পাশা খেলার একটা মিল আছে। ক্ষমতার রাজনীতি একটা পাশার বোর্ড। এখানে কেউ খেলে, কেউ হয় ঘুঁটি। ঘুঁটি চালতে ভুল হলেই রাজার খেলা শেষ। এ রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। পাশার দান উল্টে গিয়েছিল কোটালের হাতে। দেখা গেল, ঈশ্বরতুল্য রাজা না থাকলেও রাজ্য এক দিনের জন্যও থেমে থাকে না।

১৫ আগস্ট ভোরে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলেন। যে নির্মম শাসন তিনি চালিয়েছিলেন সাড়ে তিন বছর, তার অবসান হলো নির্মমতার মধ্য দিয়েই। ক্ষমতার চূড়ায় এলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বন্ধু খন্দকার মোশতাক আহমদ। মুজিবের দলে তিনিই ছিলেন শেখ মুজিবের একমাত্র সুহৃদ। সম্পর্ক ছিল তুই-তুমি। বাকি সবাই ছিলেন কর্মী বা অনুগত ভক্ত।

১৫ আগস্টের পালাবদলের পর ইতিহাসের বয়ান পাল্টে গেল। কারও কাছে শেখ মুজিব হয়ে গেলেন জুলিয়াস সিজার আর মোশতাক হলেন ব্রুটাস। আবার কারও কাছে মোশতাক হলেন জিন্দাপীর, অভ্যুত্থানকারীরা হলেন সূর্যসন্তান, আর মুজিব হলেন স্বৈরাচারী।

১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মূল অনুঘটক ছিল সামরিক বাহিনীর একটি অংশ। এটি সমর্থন করেছিল সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব এবং বাকশাল তথা আওয়ামী লীগ ও তার শরিকেরা ছাড়া আর সব রাজনৈতিক দল। মুজিবের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমেছিল। জনরোষের ভয়ে এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কেউ পথে নামেনি। কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন, অন্যরা গেছেন আত্মগোপনে।

অভ্যুত্থানকারীরা সামরিক বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙেছিলেন। এ নিয়ে সামরিক বাহিনীতে অস্বস্তি ছিল। বাহিনীর অনেকেই এতে অংশ নেওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং তাঁরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করতেন। কতিপয় মেজর-ক্যাপ্টেন বঙ্গভবনে বসে ছড়ি ঘোরাবে, এটা তাঁরা সহ্য করতে পারছিলেন না। তা ছাড়া মোশতাক সামরিক আইন জারি করলেও দেশে সামরিক শাসনের আসর পড়েনি। সামরিক আইন প্রশাসক বলে কিছু ছিল না। জাতীয় সংসদ বহাল ছিল। এটা ছিল একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা।

ঠিক এই পরিস্থিতিতে ৩ নভেম্বর ভোরে হলো আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর একটি বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গে বিমানবাহিনীর একটি অংশও যোগ দিয়েছিল। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর আগস্ট অভ্যুত্থানের কারিগরেরা একটা সমঝোতার মাধ্যমে দেশ ছেড়ে চলে যান। কোনো রক্তপাত হয়নি।

সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে নতুন সেনাপ্রধান হলেন খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় অবস্থানরত সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেড তখন চালকের আসনে, যাঁদের উপেক্ষা করে কিংবা না জানিয়ে আগস্ট অভ্যুত্থান হয়েছিল। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা সরকারের ‘সিভিলিয়ান’ মুখোশটা আর রাখলেন না। জারি হলো পুরোপুরি সেনাশাসন। খন্দকার মোশতাককে হটিয়ে বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করা হলো। বিলুপ্ত হলো জাতীয় সংসদ। ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনী ক্ষমতার বারান্দায় ঢুকে পড়েছিল। ৩ নভেম্বরের পর তারা ঢুকল একেবারে অন্দরমহলে।

আগস্ট অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ পর বাকশালের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু হয়। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত বাকশাল সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মনসুর আলী ও বাকশাল-পূর্ব আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম কামারুজ্জামান ২৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগে ব্রাত্য হয়ে যাওয়া তাজউদ্দীন আহমদও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এই চার নেতা ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৩ নভেম্বর ভোরে যখন অভ্যুত্থান ঘটছিল, তখন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য জেলখানার ভেতরে ঢুকে তাঁদের হত্যা করে।

জেলখানায় কিংবা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরায় থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক বন্দীকে মেরে ফেলার ঘটনা এ দেশে নতুন নয়। ১৯৭২ সাল থেকেই এটা হয়ে আসছে। কিন্তু জেলে চার নেতার হত্যাকাণ্ড সবাইকে নাড়া দেয়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন। এটা মনে করা হয়েছিল, দেশে একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ এলে এই চারজন তার নেতৃত্ব দেবেন।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের একটা ঘোষিত লক্ষ্য ছিল আগস্ট অভ্যুত্থানের মেজর-ক্যাপ্টেনদের চক্রকে সরিয়ে সেনানেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। শুরুতেই তাঁরা সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভাঙেন। অভ্যুত্থানের প্রথম প্রহরে সেনাপ্রধান জিয়াকে অন্তরিণ করা হয়েছিল। এই অভ্যুত্থান মোশতাকের বিরুদ্ধে ছিল না। খালেদ মোশাররফ মোশতাকের সঙ্গে দুই দিন দর-কষাকষি করেছেন তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে এবং মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে রেখে দিতে। মোশতাক রাজি হননি। তিনি ৪ নভেম্বর পদত্যাগ করেন।

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে আওয়ামী-বাকশালীরা উল্লসিত হয়েছিলেন। তাঁদের ধারণা হয়েছিল, এই অভ্যুত্থান মোশতাক-জিয়ার বিরুদ্ধে। তার মানে, খালেদ হয়তো ১৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরিয়ে আনবেন। ৪ নভেম্বর তাঁরা শেখ মুজিবের একটি বাঁধানো ছবি নিয়ে মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের বাসভবন পর্যন্ত যান। একপর্যায়ে ওই মিছিলে যোগ দেন খালেদের মা ও ছোট ভাই, যিনি আওয়ামী লীগ করতেন। জনমনে চাউর হলো, খালেদ ভারতের দালাল, তিনি বাকশালিদের পুনর্বাসন করতে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে ভারতের তাঁবেদার মনে করা হতো। এর পরিণতি হয়েছিল বিয়োগান্ত।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের প্রধান দিক দুটি। এই অভ্যুত্থানের কারণে মোশতাক সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে পুরোদস্তুর সামরিক শাসন শুরু হয়। দ্বিতীয়ত, এই ডামাডোলে জেলে আটক চার নেতা নিহত হন। এটা এখন মোটামুটি স্পষ্ট যে খালেদের অভ্যুত্থানের পেছনে কোনো রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁদের পরিকল্পনায় চার নেতা ছিলেন না। যদি থাকতেন, তাহলে শুরুতেই খালেদ ও তাঁর সঙ্গীরা চার নেতাকে মুক্ত করতে জেলখানায় ছুটে যেতেন। তাঁরা সেটা করেননি। তাঁরা ৩ তারিখ সারা দিন ওই নেতাদের খোঁজও নেননি।

১৫ আগস্ট আর ৩ নভেম্বর একই সূত্রে গাঁথা। ১৫ আগস্ট না হলে ৩ নভেম্বর হতো না। কিন্তু দুটির মধ্যে বিস্তর ফারাক। ১৫ আগস্টকে ক্ষমতচ্যুতরা ছাড়া বাকি সবাই স্বাগত জানিয়েছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে আবদুল মালেক উকিল, মহিউদ্দিন আহমদ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের। সবাইকে জবরদস্তি করে মোশতাক মন্ত্রী বানাননি। একটা উদাহরণ দিই। ১৫ আগস্ট ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী (সাবেক রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী)। তিনি মোশতাক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি সরকারি কাজে বিদেশেও গেছেন। ফিরেও এসেছেন। ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এমন কোনো প্রচারপত্র বা বিবৃতি দেখা যায়নি, যেখানে শেখ মুজিবের জন্য কেউ আহা-উঁহু করেছেন।

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া ছিল অন্য রকম। বাকশালের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ ছাড়া কারও মধ্যে উৎসাহ-উল্লাস দেখা যায়নি। সব জায়গায় একটা থমথমে অবস্থা ছিল। সবাই একরকম অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। এটি জনমনে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

সেনাবাহিনীর দুটি অংশ আগস্ট ও নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘটালেও তাঁদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ছিল সামান্যই। তাঁরা ছিলেন পরস্পরের সহকর্মী, বন্ধু। সে জন্য কোনো রক্তপাত হয়নি।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক