চরম বৈষম্যপূর্ণ একটা দেশ হওয়ার একেবারে খাদের কিনারে দাঁড়ানো বাংলাদেশের মানুষদের প্রতিনিয়ত এত এত নির্দয় ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় যে সেগুলোর ব্যাখ্যা যৌক্তিক বোধেরও বাইরে।
এই যেমন ৬ জুন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা মেইল ট্রেনটির ঘটনার কথাই ধরা যাক। নরসিংদী স্টেশন থেকে ঢাকায় কর্মস্থলে আসছিলেন ৪২ বছর বয়সী ঝুমুর কান্তি বাউল। ভিড়ের কারণে শেষ বগিতে উঠেছিলেন। গরমের কারণে খানিকটা স্বস্তি পাওয়ার আশায় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু সেখানে আসনে থাকা যাত্রী মনজুর মিয়া তাঁকে সরে অন্যখানে দাঁড়াতে বলেন। দুজনের মধ্যে কথা–কাটাকাটি হয়। অন্য যাত্রীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝুমুরকে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি মারতে থাকেন মনজুর মিয়া। মারের চোটে অচেতন হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
বাস, ট্রেনের মতো গণপরিবহনে জানালা নিয়ে এ রকম বচসা নৈমিত্তিক ঘটনা। তাই বলে কারও গায়ে হাত তুলতে হবে! এমনভাবে পেটাতে হবে যে আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। যিনি এভাবে অন্যকে মারলেন, তাঁরও তো নিজের সন্তান আছে, ভাইবোন, অন্য স্বজন আছে। তাহলে এই নিষ্ঠুরতার ব্যাখ্যা কী?
এ ঘটনার তিন দিন পর ৯ জুন রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়া বারিধারায় পুলিশ কনস্টেবল মনিরুল ইসলামকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন আরেক কনস্টেবল কাউসার আলী। তাঁরা দুজনেই ফিলিস্তিনি দূতাবাসে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাতে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বাইরে দাঁড়িয়ে কে কতক্ষণ দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। কাউসার চাকরিতে মনিরুলের চেয়ে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তিনি চাইতেন মনিরুল তাঁকে সম্মান করুন। কিছুটা বেশি সময় বাইরে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করুন। কিন্তু মনিরুল সে কথা শুনতেন না। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে মনিরুলকে গুলি করেন কাউসার। মনিরুলের শরীরে বেশ কয়েকটি গুলি লাগে।
পেশাগত দায়িত্ব পালন নিয়ে কথা–কাটাকাটি হতে পারেই। তাই বলে সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা করতে হবে? কাউসারের স্ত্রীর দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে তো সবার আগে প্রশ্ন চলে আসে, মানসিক সমস্যা আছে—এ রকম ব্যক্তি কীভাবে পুলিশের মতো এমন পেশাদার ও সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হতে পারেন? কীভাবে তাঁকে কূটনৈতিক জোনের মতো এমন সংবেদনশীল জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হলো?
আমাদের রাজনীতিবিদেরা যেভাবে সামষ্টিক স্বার্থকে গলা টিপে ধরে শুধু ক্ষমতার বলয়ে থাকা মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য আলাদিন চেরাগের অগ্রগতির ব্যবস্থা করে চলেছেন, তার চড়া মূল্য কি প্রতিদিন চুকিয়ে যাচ্ছি না?
শেষ করা যাক ঢাকার মিরনজিল্লা হরিজন কলোনির উচ্ছেদ অভিযানের ঘটনাটি দিয়ে। ২০০ থেকে ২৫০ বছরের ওপরে এই জনগোষ্ঠী সেখানে বাস করে আসছেন। পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্রিটিশরা তাঁদের ঝাড়খন্ড থেকে নিয়ে এসেছিল। সে হিসাবে ঢাকায় মিউনিসিপ্যাল গড়ে ওঠার অনেক আগেই সেখানে বাস করছেন হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন। বর্ণবাদে বিভক্ত ভারতীয় হিন্দু সমাজের চার বর্ণেরও বাইরের অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী তাঁরা। আবার মুসলমান সমাজে বর্ণ বিভাজন না থাকলেও এই জনগোষ্ঠীর প্রতি অস্পৃশ্যতার একই দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো হয়। ফলে দোকানে চা খেতে চাইলেও তাঁদের নিজেদের কাপ-গ্লাস নিজেদেরই বহন করতে হয়। জীবিকা হিসেবে বংশানুক্রমিকভাবে পরিচ্ছন্নতার কাজই তাঁদের করতে হয়। অস্পৃশ্যতার অনড় বাধা পেরিয়ে এ জনগোষ্ঠীর দু-একজন সবে উচ্চশিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোনো পেশা বেছে নিতে পেরেছেন। পরিচয় জানলে অনেকে তাঁদের কাছে বাসাও ভাড়া দিতে চান না।
এ রকম একটা অবহেলিত, প্রান্তিক আর নাজুক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে সেখানে অত্যাধুনিক কাঁচাবাজার বানাতে চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। বলা হচ্ছে, সিটি করপোরেশনে যাঁরা স্থায়ী চাকরি করেন, তাঁরাই কলোনিটির বৈধ বাসিন্দা। তাঁদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। আর অন্যরা অবৈধ। কী অদ্ভুত আর গায়ের জোরের সিদ্ধান্ত। যাঁরা ১৫০ থেকে ২০০ বছর ধরে সেখানে বাস করছেন, তাঁরা সিটি করপোরেশনে স্থায়ী চাকরি করেন না বলেই অবৈধ হয়ে যাবেন? বুলডোজার দিয়ে তাঁদের পাঁচ থেকে ছয়টি ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা বুলডোজারের সামনে গিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সামনে হাতজোড় করে মিনতি করেছে, তাদের যেন উচ্ছেদ না করা হয়।
মিরনজিল্লার বাসিন্দারা যে ঘরগুলোয় থাকেন, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো মাথা গোঁজার ঠাঁইও নয়। আট ফুট দৈর্ঘ্য আর চার ফুট প্রস্থের একেকটা ঘরে চার থেকে পাঁচজন মানুষ থাকেন। সে ঘরই ভেঙে দিয়ে সিটি করপোরেশন এখন তাঁদের পথের ফকির বানিয়ে দিয়েছে। শুধু ঘর ভেঙেই কিংবা উচ্ছেদ করেই থামছে না; মিরনজিল্লার উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া অথবা উচ্ছেদের পথে থাকা বাসিন্দারা কাউন্সিলর আউয়াল হোসেনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটা এককথায় বর্ণবিদ্বেষী। ভুক্তভোগীরা বিবিসি বাংলার কাছে অভিযোগ করেছেন, ‘আমাদের কেউ বাসা ভাড়াও দিতে চাইছে না। কাউন্সিলরের লোকেরা মানা করে দিছে। বলছে যে এদের ভাড়া দিবা না। দিলে টিপ, চুড়ি—এগুলো পরতে দিবা না।’
প্রায় ছয় দশক আগে জার্মান দার্শনিক ও মনোবিদ এরিক ফ্রম অগ্রগতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘অগ্রগতি কেবল তখনই ঘটে, যখন অর্থনীতি, আর্থরাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিসরে স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন হয়। এর কোনো একটা ক্ষেত্রে অগ্রগতি যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে অন্য যেকোনো জায়গার অগ্রগতিটা ধ্বংস হয়।’
আমাদের রাজনীতিবিদেরা যেভাবে সামষ্টিক স্বার্থকে গলা টিপে ধরে শুধু ক্ষমতার বলয়ে থাকা মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য আলাদিন চেরাগের অগ্রগতির ব্যবস্থা করে চলেছেন, তার চড়া মূল্য কি প্রতিদিন চুকিয়ে যাচ্ছি না? মিরনজিল্লা কলোনির ঘর হারিয়ে পথের ফকির হয়ে যাওয়া রানু রানীর বুকভাঙা কান্না আমাদের কজনকে স্পর্শ করতে পারে। ‘ঘরদুয়ার সব ধ্বংস হয়ে গেল। এইটুকুন জায়গায় চার থেকে পাঁচজন আমরা থাকি। আমাদের জন্য কি কোনো মায়াদয়া লাগছে না? এইটুকু জায়গাটাও তোমরা লিয়ে লিচ্ছো...’
● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী