বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবু আঞ্চলিক পর্যায়ে একটি বিকল্প সংস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি এখন জোরেশোরে উঠছে। গত মার্চে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম চীন সফরে গিয়ে এ আলোচনাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।
তিনি এশিয়ান মনিটরি ফান্ড (এশীয় মুদ্রা তহবিল) বা এএমএফ চালুর প্রস্তাব করেছেন। তাঁর যুক্তি, এ অঞ্চলে চীন, জাপান ও অন্য বেশ কিছু দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত। এটাই এএমএফ প্রতিষ্ঠা এবং একই সঙ্গে তাঁদের নিজ নিজ মুদ্রার ব্যবহার নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত সময়।
আইএমএফের বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। নতুন করে আলোচনার সূত্রপাতের কিছু কারণ— ডলারের প্রাধান্য এবং রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা জারির কারণে বাণিজ্যব্যবস্থায় চলমান অস্থিতিশীলতা। ঐতিহাসিকভাবেই সংকটের সময় আইএমএফের প্রতি বিরক্তিও চরমে ওঠে। কারণ, তাদের ঋণ দেওয়ার কিছু শর্ত থাকে।
এর মধ্যে ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর আর্থিক অবস্থা মজবুত করার বাধ্যবাধকতা আছে। আশির দশকে ঋণসংকট, নব্বই দশকে কাঠামোগত সমন্বয়, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট অর্থনীতিতে বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। এতে সামাজিক বৈষম্য বাড়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের যে ধারণা রয়েছে, তার অবমূল্যায়নের মতো ঘটনা ঘটে। এসব কারণে আইএমএফ ও এর নীতির প্রতি ক্ষোভ আছে বিভিন্ন দেশের।
জাপানের আর্থিক কর্তৃপক্ষ ১৯৯৭ সালে প্রথম এএমএফের প্রস্তাব করেছিল। এশিয়ায় সে সময় আর্থিক সংকট চলছিল। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে জাপান সে সময় নেতৃত্বে আসতে চেয়েছিল। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।
আইএমএফ বর্তমানে যে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছে, সফল হতে হলে এএমএফকে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝখানে পড়ে আইএমএফ অনেকটাই গতিহীন ও রাডারবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্য অন্য শঙ্কা ছিল—এএমএফ অর্থাৎ পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক উদ্যোগের কাছে আইএমএফ (এবং যুক্তরাষ্ট্রও) তাদের প্রভাবশালী অবস্থান হারাতে পারে। সে কারণে তারা এ উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করে। পরে ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ আবারও এ আলোচনা উসকে দেন। তিনি বলেন, যদি একটি আঞ্চলিক তহবিল থাকত, তাহলে এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিত না।
১৯৯৭ সালের আর্থিক সংকটের চিন্তা থেকেই বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আওয়াজ ওঠে আবারও। এ ব্যবস্থায় সংকট এড়ানোর প্রত্যাশাও আছে। আসিয়ানভুক্ত বেশির ভাগ দেশ ২০০৮ সালে আর্থিক সংকটের দরুন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েছিল। তবে দ্রুতই তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এর পেছনে আইএমএফের নির্দেশনায় আগের দশকে আর্থিক খাতে নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচির অবদান আছে।
বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংক খাত সংস্কার, শ্রমবাজার এবং করপোরেট খাতে ব্যবস্থাপনার সংস্কার এশিয়ার দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই সংস্কার দক্ষিণ কোরিয়ার বনেদি ব্যবসা বা পারিবারিকভাবে পরিচালিত ব্যবসার ওপর মৌলিক প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সে সময় বনেদি ব্যবসাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দাইয়ু দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল।
স্যামসাং, হুন্দাই ও এলজি ভেঙে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়াও রাজস্ব ঘাটতির লাগাম টেনে ধরে। ইন্দোনেশিয়ার ব্যাংকগুলো গেড়ে বসা স্বজনতোষণ (ক্রোনিজম) থেকে বেরিয়ে আসে। এ সাফল্য সত্ত্বেও আইএমএফের প্রতি বিতৃষ্ণা এশিয়ায় প্রবল।
এর প্রমাণ অস্বাভাবিক দ্রুততায় পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ঋণ শোধ। তখন থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলো বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিশালী রিজার্ভ গড়তে শুরু করে। ভবিষ্যতে বহির্বিশ্বের কোনো ধাক্কায় তারা আইএমএফের কোনো সহযোগিতা নিতে চায় না। তীব্র এ ক্ষোভ থেকেই আসিয়ান প্লাস থ্রি ইকোনমি ২০১০ সালে চিয়াংমাই ইনিশিয়েটিভ মাল্টিল্যাটারালাইজেশন (সিএমআইএম) তৈরি করে। এর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক সংকটের সময় স্বল্প মেয়াদে ঋণ দেওয়া। বর্তমানে সিএমআইএম ২৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সক্ষম আর আইএমএফ এক ট্রিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে আইএমএফের তুলনায় সিএমআইএম এক–চতুর্থাংশ ঋণ দিতে পারে।
সিএমআইএমকে আসলে কল্পিত এএমএফের দিশারি প্রকল্প হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা বিনিময় ও প্রতিশ্রুতিনির্ভর ব্যবস্থার কারণে সংকটের সময় এ উদ্যোগ খুব একটা কার্যকর হয়নি। কোনো সদস্যই এ সুযোগ নেয়নি। ফলে আইএমএফের বিকল্প হিসেবে এই আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এরপরও আনোয়ার ইব্রাহিম আঞ্চলিক শক্তির যে উত্থান, তার ওপর নির্ভর করতে চান। তিনি নিশ্চিত সম্মিলিত ব্যবস্থায় এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতিগুলোকে যুক্ত করা সম্ভব।
আইএমএফ বর্তমানে যে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছে, সফল হতে হলে এএমএফকে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝখানে পড়ে আইএমএফ অনেকটাই গতিহীন ও রাডারবিহীন।
বহুপক্ষীয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক—জাপান ও চীনের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোকে যুক্ত করাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। না হলে বৃহৎ কোনো শক্তি সহজেই প্রতিষ্ঠানটির ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। যেসব বিষয় এখনো পরিষ্কার নয়, তা হলো এএমএফের ঋণের শর্ত আইএমএফের থেকে কতটা আলাদা হবে।
দেখতে হবে ঋণগ্রহীতা দেশগুলো রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিবেশীদের পরামর্শ শুনতে কতটা প্রস্তুত। আরও একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন হচ্ছে, বৈশ্বিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলারের ভূমিকা কী হবে।
ডি-ডলারাইজেশন (রিজার্ভের বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলারের ব্যবহার না করা) প্রায় অসম্ভব। কারণ, এশিয়ায় নগদ অর্থের বাজার এখনো বড় নয়। রিজার্ভের বিনিময় মুদ্রা হিসেবে রেনমিনবির (চীনা ইউয়ান) ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে চীনকে ডলারের রিজার্ভ রাখতে হবে। অথবা মূলধন হিসাব উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
আসিয়ানের সব সদস্য এএমএফ ধারণার সঙ্গে একমত নয়। ইন্দোনেশিয়া তাদের অনিচ্ছার কথা জানিয়েছে। তবে এএমএফের ধারণা আর এখন অবান্তর কোনো কল্পনা নয়। জাপানকে অন্তর্ভুক্ত করাও কঠিন হবে।
কিন্তু চীন এখন জাপানের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী। গত বছরগুলোয় তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর হয়েছে। যদি এশিয়ার সব নেতা এক টেবিলে বসতে পারেন, তাহলে হয়তো শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চল আইএমএফ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম
ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ কুয়ালালামপুরের মোনাশ ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ও গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান
সৈয়দ আবুল বাশার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের অধ্যাপক ও কাতার সেন্ট্রাল ব্যাংকের সামষ্টিক অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ