তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মনে করেন, রাশিয়া ও পশ্চিম ‘সমান’ নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত। ১৮ সেপ্টেম্বর সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির ওপর তুরস্কের নির্ভরযোগ্যতা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগদানের জন্য তুরস্কের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় স্থবিরতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন এরদোয়ান।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম পিবিএসকে এরদোয়ান বলেন, ‘পশ্চিমা শক্তির ওপর যতটা নির্ভর করা যায়, রাশিয়ার ওপরও ততটা নির্ভর করা যায়। ৫০ বছর ধরে, আমরা ইইউর দোরগোড়ায় অপেক্ষা করে আছি। এই মুহূর্তে, আমি পশ্চিমাদের মতো রাশিয়াকেও বিশ্বাস করি।’
৪ সেপ্টেম্বর রাশিয়া সফরে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর এরদোয়ান এ–ও বিশ্বাস করেন যে, ক্রেমলিনের অধিকর্তা ইউক্রেনে বাজেভাবে তাঁর আটকে যাওয়া থেকে অতিসত্বর বেরিয়ে আসতে চান। এরদোয়ান বলেন, ‘পুতিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই যুদ্ধ শেষ করার পক্ষে। এটাই তিনি বলেছেন। আমি তাঁর এ মন্তব্য বিশ্বাস করি।’
এরদোয়ানকে আপাতদৃষ্টে ‘নির্বোধ’ বলে মনে হতে পারে। তবে তিনি যুদ্ধরত দুই পক্ষ, পশ্চিমা শক্তি, চীন এবং তাঁর নিজের পক্ষের মধ্যে একটি সতর্ক ভারসাম্য বজায় রাখার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
পাঁচ বছর ধরে দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি এবং এ বছরের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধাক্কার মধ্যে এরদোয়ানের এ ভারসাম্যমূলক অবস্থান তাঁর জন্য ও তাঁর দেশের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশ বলেন, এরদোয়ানের ভূরাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিমা, রাশিয়া ও চীনকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতির তিনটি বিরোধমূলক অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে। প্রতিটি দিক থেকে, এরদোয়ান সর্বাধিক সুবিধা পাচ্ছেন—বাজার, প্রযুক্তি এবং পশ্চিম থেকে অর্থনীতি আধুনিকীকরণ, সস্তা কাঁচামাল, জ্বালানি এবং রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আর চীন থেকে পণ্য সরবরাহের ট্রানজিট ও বিনিয়োগ।
তবে কিছু ইউক্রেনীয়র কাছে, এরদোয়ানের এই ভারসাম্য বজায় রাখায় বিষয়টি নিন্দনীয় মনে হতে পারে।
তুরস্কে নিয়মিত ছুটি কাটানো কিয়েভভিত্তিক এক আইটি বিশ্লেষক ভ্যালেনটিন আলেক্সাসেঙ্কো বলেন, ‘তিনি (এরদোয়ান) একজন বাজার ব্যবসায়ীর মতো; তিনি হাসি দেবেন এবং আপনার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন কিন্তু তিনি মূলত আপনার কাছে অর্থ চান এবং অন্য ক্রেতার কাছে যাতে আপনি তাঁর জন্য সুপারিশ করেন।’
তবে এরদোয়ানের অবস্থান কিয়েভের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে সহায়তাই করে। তিনি ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ‘প্রিয় বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছেন। সম্প্রতি তাঁকে ইস্তাম্বুলে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছেন। রাশিয়ার হাতে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি এবং কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনীয় গম পাঠানোর জন্য ‘শস্য চুক্তি’র মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মধ্যস্থতায়ও এগিয়ে এসেছেন।
এরদোয়ানের জামাতার কোম্পানিতে নির্মিত ড্রোন রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে এতটাই প্রাণঘাতী ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে যে, সেই ড্রোন কেনার পর ইউক্রেন তুরস্ক থেকে আরও সরঞ্জাম কেনার তালিকা পাঠায়।
ইস্তাম্বুলের ইসিক ইউনিভার্সিটির সেদা দেমিরালপ বলেন, এরদোয়ানের প্রতিবন্ধকতাই দেশের ভেতরে তাঁর পক্ষ নিতে কাজ করে। কারণ তাঁর ভোটাররা বুঝতে পারেন যে, বেশির ভাগ ইইউ সদস্য তাদের রাষ্ট্রকে জোটটিতে প্রবেশ করতে দিতে কতটা অনিচ্ছুক এবং অভিবাসনের বিষয়ে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতাও, যা তাদের মধ্যে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলে।
সেদা দেমিরালপ বলেন, তাঁর (এরদোয়ান) ভোটাররা নিশ্চিত যে একটি স্বাধীন অবস্থান তুরস্কের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকার বয়ে আনবে। তুর্কি ভোটাররা পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রশংসা করে আবার একই সঙ্গে এ–ও উপলব্ধি করে যে, তুরস্ক কখনোই পশ্চিমের কাছে সমান অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হয় না।
ওয়াশিংটন ডিসি–ভিত্তিক একটি থিঙ্কট্যাংক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের তুর্কি বংশোদ্ভূত বিশ্লেষক গনুল তোল বলেন, এরদোয়ানের দিক থেকে চিন্তা করলে, তাঁর জন্য এমন নীতি অনুসরণ করা পুরোপুরি যুক্তিসংগত, যা একচেটিয়াভাবে একটি পক্ষকে সমর্থন করে না। কারণ, তিনি পশ্চিম বা রাশিয়া কাউকেই দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না।
অন্যদিকে, ব্রাসেলস, ওয়াশিংটন আর মস্কোরও বারবার এরদোয়ানের কাছে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, তাঁকে নিয়ে তাদের মধ্যে যতই হতাশা কাজ করুক না কেন।
আবার এরদোয়ান ও পুতিনের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত যোগসূত্র রয়েছে। দুজনেরই রাজনৈতিক গতিপথ কিছুটা একই। দুজনই পঞ্চাশের দশকে জন্মগ্রহণ করেছেন। উভয়েই দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন। এর মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা এবং তাঁদের জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে সমালোচকেরা সমালোচনা করে থাকেন। যদিও এরদোয়ান ও তাঁর সমর্থকেরা এসব সমালোচনাকে পাত্তা দেন না।
উভয় নেতাই তাঁদের জাতির সাম্রাজ্যবাদী শাসনকাল নিয়ে নস্টালজিক। সব ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই শাসনকালের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন তাঁরা। এর জন্য উভয়ই একই ধরনের ভিত্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তুরস্কের প্রধান মিত্র আজারবাইজানের রাজধানী বাকু–ভিত্তিক বিশ্লেষক এমিল মুস্তাফায়েভ বলেন, সময়ই দেখিয়েছে যে উভয় নেতাই তাঁদের জাতির স্বার্থকে অনুসরণ করেন। এর জন্য তাঁরা একই সঙ্গে একমতও হতে পারেন এবং আপসও করতে পারেন।
রাশিয়ান জার এবং অটোমান সুলতানেরা এক ডজনবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। জার শাসক নিকোলাস এক ১৮৬০ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্ক ও পশ্চিমা শক্তির ক্রিমিয়ান যুদ্ধে তুরস্ককে ‘ইউরোপের অসুস্থ জাতি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, যা আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।
তবে দেড় শতাব্দী পরে সেটিই আবার রাশিয়ার জন্য খাটে, যখন মস্কো ক্রিমিয়াকে অধিগ্রহণ করে নেয় এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে সেই একই শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে।
২০১৫ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের নাজুক হয়ে পড়া ক্ষমতাকে উদ্ধার করতে রাশিয়া তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় তুর্কি বিমানবাহিনী একটি রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল। সে সময় আঙ্কারা অভিযোগ করেছিল, তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল রুশ যুদ্ধবিমানটি।
এ ঘটনা তখন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে। মস্কো তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তুরস্কে চার্টার ফ্লাইট নিষিদ্ধ করে। রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক কোম্পানি গ্যাজপ্রমও তুরস্কে ১ হাজার ১০০ কিলোমিটারের পাইপলাইন নির্মাণ স্থগিত করে দেয়।
কিন্তু দুই দেশের মধ্যে এ উত্তেজনা শিগগিরই শেষ হয়ে যায়। রাশিয়ান গ্যাস চলে যায় তুরস্কে, এমনকি পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত। মস্কো এমনকি আঙ্কারাকে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের গ্যাস বিল পরিশোধের সময় আরও পিছিয়ে দেয়।
জার্মানিতে একটি রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ক্রেমলিন এখন তুরস্কে একটি গ্যাস হাব তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি রয়টার্সের এক প্রতিবেদন বলছে, হাবটির ওপর কার নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তা নিয়ে উভয় পক্ষ একমত হতে না পারায় পরিকল্পনাটি স্থগিত হয়ে গেছে।
মানসুর মিরোভালেভ কিয়েভ–ভিত্তিক সাংবাদিক। আল–জাজিরা, বিবিসি, এপি, সিএনএনসহ অনেক সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: রাফসান গালিব