১২ জানুয়ারি ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামের একটি ছাত্রসংগঠনের প্রতিবাদ ও আপত্তির মুখে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নবম ও দশম শ্রেণির একটি পাঠ্যবইয়ে ব্যবহৃত ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সংগঠনটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের সুযোগ নেই। সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসার পর নজিরবিহীন দ্রুততার সঙ্গে তাঁদের দাবি মেনে নিয়ে গ্রাফিতিটি সরিয়ে অন্য একটি গ্রাফিতি তাঁদের ওয়েবসাইটে সংযোজন করেন। অথচ যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে কাজটি করা হলো, সেই সংবিধান নিয়ে সংস্কারের আলাপ বা পুনর্লিখনের দাবি এখন সর্বজনবিদিত।
এদিকে গতকাল (১৫ জানুয়ারি) ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামের ব্যানারে পাহাড়ি–সমতলের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী–তরুণদের ওপর হামলা করে। এ হামলায় কয়েকজন আহত হন। হামলার সময় এ স্লোগান দেওয়া হয় ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’। এটা কোনোভাবেই ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজের বার্তা দেয় না।
এটা স্বীকার করতেই হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে যে কেউ তার মতামত প্রকাশের অধিকার রাখে। আর সেটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তাই একটি ছাত্রসংগঠনের জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের কোনো একটি বিষয়বস্তু নিয়ে মতামত বা আপত্তি জানানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এনসিটিবি যে উপায়ে কাজটি করল, তা অগ্রহণযোগ্য এবং ভালো কোনো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না।
কেননা, পাঠ্যপুস্তকে কোনো তথ্য বা ছবি পরিবর্তন বা পরিমার্জন করার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটি প্রক্রিয়া মানতে হয়। এ রকম কোনো কিছু করার জন্য নিশ্চয়ই নির্দিষ্টভাবে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকে। এ ছাড়া যেসব বিশেষজ্ঞ তাঁদের মূল্যবান চিন্তা থেকে গ্রাফিতিটি যুক্ত করেছেন, তাঁদের পরামর্শ নেওয়া শোভন ও কাম্য ছিল।
এবার আসি অন্য আরেক আলোচনায়। ছাত্রসংগঠনটি সংবিধান–সংক্রান্ত যে আলাপ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতিটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তা কতটা সর্বজনগ্রাহ্য বা সর্বজনগ্রাহ্য নয়, তা বোঝার জন্য আদিবাসী শব্দটি নিয়ে বিতর্কটির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী কী কী অর্থে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়, তা জানা জরুরি।
সেই আলোচনা শুরু করা যাক একটু পেছনে ফিরে এবং কী প্রেক্ষাপটে সংবিধানে শব্দটি শেষ পর্যন্ত আর জায়গা করে নিতে পারল না, সেটা জানার মধ্য দিয়ে।
জনসংখ্যা ও ঘরশুমারি ২০২২ অনুযায়ী, আদিবাসীরা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১ ভাগ, মতান্তরে যা ১ দশমিক ৮ শতাংশ বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্তত ৩৫ ভাষাভাষীর প্রায় ৫৪ ধরনের আদিবাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, খুলনা, ঢাকাসহ অন্য অনেক জেলায় কমবেশি তাঁদের বসবাস রয়েছে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৮ (ক) ধারায় একাধিকবার আদিবাসী শব্দটি স্পষ্ট করে ব্যবহার করা হলেও এবং আদিবাসীদের পরিচয় সংবিধানে স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তী সময় সে কথা আর তারা রাখেনি। তবে ২০১০ সালে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ধারা ২–এ বলা হয়, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রতিনিধিত্বে একটি দল আদিবাসীদের জন্য স্বায়ত্তশাসনসহ চারটি দাবি নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে, যা তিনি তৎক্ষণাৎ খারিজ করে দেন এবং এর পরিবর্তে তাদের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে আপন করে নিতে বলেন।
১৯৭২ সালের সংবিধানে শুধু ‘বাঙালি’ ও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ (ধারা ৩,৬ [২] এবং ৯)–কে প্রতিষ্ঠা করা হলে, সংসদীয় বিতর্কের দ্বিতীয় অধিবেশনে শ্রী মানবেন্দ্র লারমা তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি একজন চাকমা, আমি বাঙালি নই।...আমরা কোনোদিনই নিজেদের বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদের বাংলাদেশি বলে মনে করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।’ (সূত্র: পরিষদ বিতর্ক রিপোর্ট, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২। খণ্ড ২, সংখ্যা ১৩, পৃ: ৪৫২)
পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান অস্থিরতা নিরসনে ও শান্তি বিরাজের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে করা পার্বত্য শান্তিচুক্তির মূল বিষয় ছিল পাহাড়ি জনগণের ভূমির অধিকারসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, যা ৭২টি চুক্তির মধ্য দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে একই সময় থেকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৮ (ক) ধারায় একাধিকবার আদিবাসী শব্দটি স্পষ্ট করে ব্যবহার করা হলেও এবং আদিবাসীদের পরিচয় সংবিধানে স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তী সময় সে কথা আর তারা রাখেনি। তবে ২০১০ সালে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ধারা ২–এ বলা হয়, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণ।
এরপর ২০১১ সালে তৎকালীন সরকারের করা সংবিধানের বহুল সমালোচিত এবং বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয় যে ‘রাষ্ট্র উপজাতি, ক্ষুদ্রজাতি, নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় এবং সম্প্রদায়ের অনন্য স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষা ও বিকাশের জন্য পদক্ষেপ নেবে’ (২৩ [ক], বাংলাদেশ সংবিধান)।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, যেমন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আদিবাসীদের আলাদা করার জন্য যে চারটি স্বতন্ত্র মানদণ্ড প্রয়োগ করে, তা বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পূরণ হয় বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। সেই ঘোষণাপত্রে ১২টি ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল জাতিসংঘ, যার মধ্যে ভূমিসংক্রান্ত অধিকারগুলোই ছিল মুখ্য।
ধরে নেওয়া হয়, মূলত এই কারণেই বাংলাদেশ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত আছে এখন পর্যন্ত। সর্বশেষ ২o২২ সালের জুলাই মাসে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার অনুরোধ করা হয়।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর দোহাই দিয়ে পরবর্তী সময়ে দেশের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়সহ বিভিন্ন অধিকার খর্ব করার একটি অপপ্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। পতিত সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা দেওয়াসহ তার প্রায় সব কার্যক্রমের সমালোচনা করলেও ঠিক এই ‘আদিবাসী’ বিষয়ে ছাত্রসংগঠন ঠিকই সেই সরকারের করা পঞ্চদশ সংশোধনীর দোহাই দিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ সরিয়ে ফেলার জন্য আন্দোলন করল। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের এই আমলে কমিশন করে বাংলাদেশের সংবিধানকে নতুনভাবে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের ওয়েবসাইটে ‘সংস্কারের পরিধি’ হিসেবে ‘জন–আকাঙ্ক্ষার’ প্রতিফলনের কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া সাংবিধানিক সংস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। মাননীয় কমিশনপ্রধান এবং অন্য সদস্যদের কাছে আমার প্রশ্ন, আদিবাসীদের স্বীকৃতি প্রদানের মতো একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংস্কার প্রস্তাবে আনা না হলে আমরা কি বলতে পারি, এই জন–আকাঙ্ক্ষা, জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের আলাপ কেবল সংখ্যাগুরু জনগণের জন্য? আর যদি তা–ই হয়, সংখ্যাগুরুর আকাঙ্ক্ষা কি অবধারিতভাবে আদিবাসী তথা জাতিগত সংখ্যালঘুদের আকাঙ্ক্ষা ও অবস্থানকে বৈষম্যমূলকভাবে ছাঁটাই করে না?
নোয়াম চমস্কি আদিবাসী এবং শোষিত জনগণ, সাম্রাজ্যবাদী সমাজ দ্বারা যাঁদের বিভিন্ন সময়ে নির্মূল করা হয়েছে বা যাঁদের জমি ও বসতি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তঁাদের ‘অ-মানুষ’(আন–পিপল) হওয়ার প্রক্রিয়াকে সংজ্ঞায়িত করেছেন বহু আগেই। বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আমরা কি এই ‘অ-মানুষ’ হওয়ার প্রক্রিয়াটিই দেখতে পাই কি না, তা খুঁজে দেখা ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় সম্ভবত এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার কারিগরদের হাতেই।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়