যুক্তরাষ্ট্র থেকে সফরে এসেছিলেন ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এতটাই পরিচিত যে তাঁর নাম বললেই হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে তাঁর পদ-পদবি কী, তা উল্লেখ না করলেও চলে।
বাংলাদেশে এসে তিনি প্রকাশ্যে যেসব কথাবার্তা বললেন, তাতে সরকারি দলের খুশি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু লু দেশে ফিরে যেতে না যেতেই এল সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা।
এমন একটি ঘোষণার জন্য অন্তত দেশবাসী প্রস্তুত ছিলেন বলে মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, বাংলাদেশ মিশনকে এই নিষেধাজ্ঞার কথা আগেই জানানো হয়েছিল।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ভারতের গিয়ে প্রথমে নিখোঁজ ও পরে খুন হয়েছেন বলে জানা গেল। যে কায়দায় তিনি খুন হয়েছেন, সেই কাহিনি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এর চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সোনা চোরাচালানসহ সেই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধ-অপকর্মের নানা অভিযোগ। একসময় ইন্টারপোলের ওয়ারেন্ট তালিকায় তাঁর নাম ছিল, তিনি ২১ মামলার আসামি—এসব তথ্য সামনে চলে এসেছে।
দেশে যে কায়দায় নির্বাচন হচ্ছে, তাতে নির্বাচন ও এর মনোনয়নপ্রক্রিয়া নিয়ে দেশের মানুষ স্বাভাবিক কারণেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এরপরও আনোয়ারুল আজীমের মতো একজন ব্যক্তি কেন ও কীভাবে সরকারি দলের মনোনয়ন পেলেন, সে প্রশ্ন এই খুনের ঘটনার পর নতুন করে উঠতে শুরু করেছে।
এর পরপরই দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। তাঁর সম্পত্তির নতুন নতুন খোঁজখবরও বের হতে শুরু করেছে। বেনজীরকে নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ যে নাটকীয় মোড় নিয়েছে, তা একই সঙ্গে বিস্ময় ও তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনাটিকে ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’ বলা যাবে না। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এর গুরুত্ব অনেক। দেশের রাজনীতি কতটা দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে, সে বিষয় এ ঘটনা নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে দুই বাহিনীর দুই সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও সেই অর্থে ‘রাজনৈতিক’ বিষয় নয়। তবে রাজনৈতিকভাবে তা গভীর প্রভাব বিস্তারকারী।
সরকার কি তবে বেনজীরকে ‘খরচের খাতায়’ ফেলে দিয়েছে? কিন্তু কেন? সরকার সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে? নাকি বিশেষ কোনো বিবেচনায় সাময়িক এই উদ্যোগ নিতে হচ্ছে? আরও কৌতূহলী প্রশ্ন হচ্ছে, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজও কি বেনজীরের ভাগ্য বরণ করবেন? আরও যাঁদের বিরুদ্ধে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তাঁদের কী হবে? বাছাই করে তাঁদের কাউকে কাউকে কি ধরা হবে? সামনে কি আরও নতুন চমক অপেক্ষা করছে?
সাবেক সেনা ও পুলিশপ্রধান—দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন। তাঁরা দুজনই বর্তমান সরকারের খুবই কাছের এবং ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের খুব বিশ্বস্ত না হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে কারও নিয়োগ পাওয়ার কথাও নয়। সরকারের স্বার্থ রক্ষায় তাঁরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন—এমন ধারণাই জনমনে প্রবল।
তিনটি ঘটনাই দেশের রাজনীতিতে আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের বিরুদ্ধে দুদককে যথেষ্ট তৎপর দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বেশ আটঘাট বেঁধেই তারা মাঠে নেমেছে। যত দ্রুত সম্পদ ক্রোকের নির্দেশনা আসছে, তাতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তাঁর পার পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে আসছে।
সরকার কি তবে বেনজীরকে ‘খরচের খাতায়’ ফেলে দিয়েছে? কিন্তু কেন? সরকার সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে? নাকি বিশেষ কোনো বিবেচনায় সাময়িক এই উদ্যোগ নিতে হচ্ছে?
আরও কৌতূহলী প্রশ্ন হচ্ছে, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজও কি বেনজীরের ভাগ্য বরণ করবেন? আরও যাঁদের বিরুদ্ধে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তাঁদের কী হবে? বাছাই করে তাঁদের কাউকে কাউকে কি ধরা হবে? সামনে কি আরও নতুন চমক অপেক্ষা করছে?
এসব প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। তবে আমরা বিষয়গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। প্রভাবশালী কোনো কোনো মহলের সঙ্গে সাবেক পুলিশপ্রধানের বিরোধের কথা আলোচনায় আছে। তেমন কিছু নিশ্চয়ই থাকতে পারে কিন্তু শুধু সে কারণেই বেনজীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।
বেনজীর যে সম্পদ গড়ে তুলেছেন, তা পুলিশে চাকরি করা অবস্থায়, বিশেষ করে পুলিশপ্রধান থাকার সময়েই হয়েছে। সরকার যন্ত্রের অগোচরে তা ঘটা সম্ভব নয়। এমন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অর্থ একজন পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির বিষয়টিকে স্বীকার করে নেওয়া।
বেনজীরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা শুরুর মধ্য দিয়ে এটা কার্যত মেনে নেওয়া হচ্ছে যে বাংলাদেশের সাবেক পুলিশপ্রধান তাঁর ক্ষমতার অব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পত্তি অর্জন করেছেন। একই সঙ্গে এটাও মেনে নেওয়া হচ্ছে যে এমন একটি পদে থেকে এই মাত্রায় দুর্নীতি ও ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করা যায়। আর বর্তমান সরকারে আমলেই তা ঘটেছে।
এরপরও সরকার কেন এই পথ ধরেছে?
এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই সরকার বেনজীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, বেনজীরের বিরুদ্ধে আদালত যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তাতে সরকারের সায় আছে।
সরকার বা দলের বড় কোনো স্বার্থ ছাড়া বেনজীরের বিরুদ্ধে এমন একটি অবস্থান নেওয়ার কথা নয়। কোনো বিরোধ বা সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা রোধের চেষ্টা থেকে এমন একটি কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ এবং সামনে আরও নাজুক হতে পারে—এমন বিপদের কথা অর্থনীতিবিদের মুখ থেকে আমরা শুনছি। সরকার নিজেও এই বিপদের কথা জানে। জনগণ মনে করে, দুর্নীতিই অর্থনীতির বাজে পরিস্থিতির মূল কারণ। এমন পরিস্থিতিতে দুর্নীতিবিরোধী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া সরকারের জন্য জরুরি। এর মধ্য দিয়ে অন্তত এটা দেখানো যে দেরিতে হলেও তারা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
তা ছাড়া দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে সরকারকে ঘিরে স্বার্থসন্ধানী লোকজনের আকার দিন দিন বড় হয়েছে। এর একটি রাশ টানাও সম্ভবত সরকারে জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে কঠোর কিছু করা ছাড়া তো আর পথ নেই।
বেনজীরের জমিজমা ও সম্পদের যে হিসাব দুদকসূত্রে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে একে মাত্রাছাড়া দুর্নীতি হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। সরকার যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু করতে যাচ্ছে, তা বোঝাতে চাইলে বেনজীরের মতো কাউকেই দরকার। তাঁর খরচের খাতায় চলে যাওয়ার পেছনে এসব বিষয় কাজ করে থাকতে পারে।
ডোনাল্ড লু এবার বাংলাদেশ সফরে এসে দুর্নীতির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। বেনজীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাকে সেই ‘কাজের’ অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা যতে পারে। সরকারকে যদি দেখাতে হয় যে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু করছে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা বেনজীরকে বেছে নেওয়াটাই যৌক্তিক। আবার দুর্নীতি ও সুশাসন প্রশ্নে আইএমএফেরও কিছু শর্ত রয়েছে।
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ক্ষেত্রেও সরকারের একই বিবেচনা কাজ করতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে তিনিও বেনজীরের পরিণতি বরণ করতে পারেন।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সাবেক সেনাপ্রধানও ধরা পড়েছেন; যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে বিষয়টি তো জনসমক্ষে চলে এসেছে।’ অর্থমন্ত্রী অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি সেনাবাহিনীর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর দুই দিন পরই সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুদক চাইলেই সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারে।
দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ অবশ্য শুধু এই দুজনের বিরুদ্ধে নয়, আরও অনেকের বিরুদ্ধেই আছে। সামনে আরও দু-একজনের বিরুদ্ধে দুদককে তৎপর দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতিতে দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগকে সামনে নিয়ে আসা কৌশল হিসেবে নতুন কিছু নয়।
সরকারের এই উদ্যোগ কতটা লোকদেখানো আর কতটা আন্তরিক, তা বোঝার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সরকার কাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে আর কাদের ব্যাপারে চুপ থাকছে, সেদিকে খেয়াল রাখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]