বিশেষ সাক্ষাৎকার: গিডিয়ন লেভি

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের অর্জন সামান্য

ইসরায়েলি সাংবাদিক ও লেখক গিডিয়ন লেভি আশির দশক থেকে দেশটির প্রাচীনতম দৈনিক হারেৎজ–এ লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। বর্তমানে পত্রিকাটির তিনি নিয়মিত কলামিস্ট ও সম্পাদনা পরিষদের সদস্য। ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের দীর্ঘ সংঘাতের নিবিড় পর্যবেক্ষক তিনি। গত বছরের
৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। গাজা যুদ্ধের বছরপূর্তিতে গিডিয়ন লেভির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসজাদুল কিবরিয়া

প্রথম আলো:

এক বছর আগে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার শিশুসহ ৪১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আমরা জানি, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে হামাসের হামলায় সহস্রাধিক ইসরায়েলি নিহত ও দুই শতাধিককে জিম্মি করার ঘটনার পর এই অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তেল আবিব। এত মানুষের প্রাণহানির পর এই যুদ্ধের ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

গিডিয়ন লেভি: এককথায় বললে, গাজা যুদ্ধ থেকে ইসরায়েল কিছুই অর্জন করতে পারেনি; বরং সম্পূর্ণ এক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে, শিশু, নারীসহ হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে। গাজায় ঘরবাড়ি, স্কুল-হাসপাতালসহ যাবতীয় অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সেখানকার মানুষ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা অনাহার, অপুষ্টি ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাঁরা অমানবিক জীবন যাপন করছেন।

প্রায় এক বছর আগে গাজা অভিযান শুরুর প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলের নেতারা বলেছিলেন যে হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল ও হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের সবাইকে উদ্ধার করা হবে। এটা ঠিক যে সামরিকভাবে হামাস অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করছে যে হামাসের সামরিক শক্তি নিঃশেষ। এখন তাই গেরিলা কায়দায় লড়তে চেষ্টা করছে।

কিন্তু হামাস রাজনৈতিকভাবে আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়েছে। আবার ২৫৫ জন জিম্মির মধ্যে ১৫৪ জনকে মুক্ত করে আনা সম্ভব হয়েছে। বাকি ১০১ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। বস্তুত, গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়েছে, যদিও আইনি সংজ্ঞা অনুসারে এটি হয়তো গণহত্যা হিসেবে অভিহিত হওয়ার শর্তগুলো পূরণ করেনি।

প্রথম আলো:

যুদ্ধ শুরুর পর ২০২৩ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে এক সপ্তাহ যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। তারপর গত ১০ মাসে কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টার পরও কেন যুদ্ধবিরতি সম্ভব হলো না?

গিডিয়ন লেভি: হলো না, কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ঠিকঠাকভাবে চেষ্টা করেনি। ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরি করেনি। যুক্তরাষ্ট্র শুধু কথা বলেছে আর দুই পক্ষকে থামতে আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি ইসরায়েলে ক্রমাগতভাবে অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিয়ে গেছে, যার মানে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য মদদ দিয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় কেউই এখন আর সক্রিয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

প্রথম আলো:

ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে?

গিডিয়ন লেভি: ট্রাম্প আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তা শুধু এই অঞ্চলের জন্য নয়, বরং সারা দুনিয়ার জন্যই খুব খারাপ হবে। তবে ইসরায়েল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে সামান্যই পরিবর্তন আসবে, তা ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যে–ই জিতুক না কেন।

প্রথম আলো:

ইসরায়েল এখন অধিকৃত পশ্চিম তীরেও বসতি স্থাপনকারীদের মদদ দিচ্ছে সেখানকার ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালানোর জন্য, তাঁদের ঘরবাড়িতে হামলা করার জন্য। আপনি কি মনে করেন যে পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি সামনে আরও খারাপ হবে?

গিডিয়ন লেভি: সেটার আশঙ্কাও প্রবল। ইসরায়েল গাজার মতোই পশ্চিম তীরেও ব্যাপক রক্তপাত ঘটাতে চায়। যত দিন যাবে, ততই সেখানকার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।

প্রথম আলো:

ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালিয়ে সেখানে হিজবুল্লাহর ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করছে। হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ বেশির ভাগ শীর্ষ নেতাকে হত্যা করেছে। ফলে হিজবুল্লাহও এখন অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় সামনের দিনগুলোয় কী হতে পারে বলে আপনি মনে করছেন?

গিডিয়ন লেভি: নির্বিচার ইসরায়েলি বিমান হামলায় লেবাননের একাংশ ইতিমধ্যে প্রায় গাজার মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি এখন স্থল ও নৌ অভিযান শুরু করার মানে হচ্ছে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ আরও বাড়বে, লাখ লাখ মানুষ অনির্দিষ্টকালের জন্য উদ্বাস্তু হবেন। আর হিজবুল্লাহপ্রধান নাসরুল্লাহকে হত্যা করার পর বহু ইসরায়েলি যেভাবে বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছে, তা এ সমাজের অবনমনেরই প্রতিফলন।

নাসরুল্লাহকে হত্যার পরদিন থেকেই কি ইসরায়েল অধিকতর নিরাপদ হয়ে উঠেছে? গাজায় এক বছর ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর লেবাননেও একই পথে হাঁটতে যাচ্ছেন নেতানিয়াহু ও তাঁর দলবল। আমি তো আশঙ্কা করি, এতেও ইসরায়েলের শেষ রক্ষা হবে না।

প্রথম আলো:

আপনি অনেক বছর ধরেই ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের ক্রমাগত নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড জবরদখল করার জন্য ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এ জন্য আপনি নিজ দেশের সরকার ও নাগরিকদের কাছ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার মুখে পড়েছেন?

গিডিয়ন লেভি: কাজটা খুব সহজ নয়। এ জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে ও হচ্ছে। আমাদের পত্রিকার জন্য অর্থমূল্যটা বেশ চড়াই হয়ে গেছে। কিন্তু ইসরায়েল সরকারের ভাষ্যকে ক্রমাগত সমালোচনা করা এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পক্ষে ইসরায়েলের সাফাইকে পাল্টা যুক্তি-তথ্য দিয়ে চ্যালেঞ্জ করা তো হারেৎজের ডিএনএতে গেঁথে রয়েছে।

আমার মতো সাংবাদিকদের ও হারেৎজের মতো গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-ঘৃণা অনেক দিন ধরেই ইসরায়েলিদের মধ্যে রয়েছে। আমি অনেক বছর গাজা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করেছি, প্রতিবেদন করেছি, লিখেছি। আমি পশ্চিম তীর নিয়েও কাজ করেছি। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল সরকার আমাকে গাজায় যেতে দিচ্ছে না।

প্রথম আলো:

আমরা দেখেছি যে জিম্মিদের মুক্ত করা ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইসরায়েলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে। এগুলো কতটা চাপ তৈরি করতে পেরেছে?

গিডিয়ন লেভি: খুবই সামান্য। ইসরায়েল সরকার তো গাজাকে ধ্বংস করার জন্য, গাজাবাসীকে হত্যা করার জন্য বদ্ধপরিকর। বেশির ভাগ ইসরায়েলিও এসব কাজকে ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য মনে করে না। ইসরায়েলের শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও অন্যান্য সংস্থা মিলে বছরের পর বছর ধরে এখানকার মানুষকে এমনভাবে মগজধোলাই করেছে যে তাদের চোখে ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়, বরং সব ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী ও হামাস।

প্রথম আলো:

আপনার প্রথম বই ১৪ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল যেটার নাম দ্য পানিশমেন্ট অব গাজা। আর এ বছর ১ অক্টোবর বের হলো দ্য কিলিং অব গাজা: রিপোর্টস অন আ ক্যাটাসট্রোফ। এই বই থেকে পাঠকেরা কী পাবেন?

গিডিয়ন লেভি: আমার সদ্য প্রকাশিত বইতে আমি ৭ অক্টোবর হামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেছি যে এই প্রেক্ষাপট বা পরিপ্রেক্ষিতকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। বিষয়টি ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলাকে বৈধতা দেওয়া বা না দেওয়ার নয়, বরং একটি নিষ্ঠুর বাস্তবতা, যা সবাইকে মানতে হবে। আর সবকিছুর শুরু তো সেই ১৯৪৮ সালে, যখন থেকে গাজা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।

এরপর সাড়ে সাত দশকে গাজা অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করেছে আর ২০০৬ সাল থেকে অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল গাজাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খাঁচা বানিয়েছে। একবার চিন্তা করে দেখুন যে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ একটা খাঁচার মধ্যে বাস করছে। এভাবে ১৮ বছর ধরে বন্দী রেখে তাঁদের কাছ থেকে আর কী আশা করা যায়?

ইসরায়েল নির্বিচারে বছরের পর বছর গাজার মানুষকে লাঞ্ছিত-অপমানিত করে চলেছে, যখন ইচ্ছা হত্যা করছে আর তাঁদের সীমাহীন যন্ত্রণাময় জীবনধারণে বাধ্য করছে। কতজন ইসরায়েলি জীবনে একবার গাজায় গিয়েছে? তাদের কাছে গাজা তো সন্ত্রাসীদের কারখানা।

আমি গাজায় গিয়েছি ও থেকেছি। গাজার আলো-বাতাস, সমুদ্রসৈকত, ওখানকার খাদ্য উপভোগ করেছি। আমি গাজাকে ভালোবাসি। গাজার অধিবাসীদের পছন্দ করি, যাঁরা আমাদের মতোই মানুষ।

এসব কথা যখন আমি এখানে বলি, তখন ইসরায়েলিরা মনে করে যে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তো বইয়ের প্রথম অংশে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরার পর দ্বিতীয় অংশে গাজায় বছরখানেক ধরে চলমান হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ-বিশ্লেষণ তুলে ধরেছি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে।

প্রথম আলো:

আপনার সমালোচকেরা বলে থাকেন যে আপনি একজন হিব্রুভাষী, যিনি আরবি জানেন না। তাই আরবিভাষী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আপনি ঠিকমতো কথাবার্তা বলতে পারেন না। তাঁরাও আপনাকে ঠিকমতো বোঝেন না।

গিডিয়ন লেভি: আমি হিব্রুভাষী এবং হিব্রুতে লেখালেখি করি। আমার প্রায় সব লেখাই ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়, যেন আপনার মতো অন্য ভাষার লোকজন তা পড়তে পারেন। কিছু আরবিতেও অনূদিত হয়।

আর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও কথাবার্তা বলা কোনো বড় সমস্যা নয়। তাঁদের অনেকেই হিব্রু জানেন ও বোঝেন। প্রয়োজনে আমরা দোভাষীর মাধ্যমে আলাপ করি। আমরা ইংরেজিতেও আলাপ করতে পারি। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি যদি ফিলিস্তিনিদের হয়রানি ও নির্যাতিত হওয়ার অশেষ কাহিনি আন্তরিকভাবে জানতে চান, তাঁদের আনন্দ-বেদনাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে চান, তাহলে ভাষা কোনো বাধা নয়।

প্রথম আলো:

আপনি কি আশাবাদী যে আপনার জীবদ্দশায় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের অবসান দেখতে পাবেন? দেখতে পাবেন যে এই অঞ্চলে শান্তি এসেছে?

গিডিয়ন লেভি: সত্যি বলতে, আমি আশাবাদী নই, সেরকম কোনো সম্ভাবনাও দেখি না। তবে এটাও তো ঠিক যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বার্লিন প্রাচীরের ভাঙন বা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের ঘটনা কয়েক মাস আগেও তো প্রায় কেউই ভাবতে পারেনি। এরপরও এসব ঘটেছে।

আপনার দেশের কথাই চিন্তা করুন। কয়জন ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসকের এভাবে পতন ঘটবে? সুতরাং একটা যেকোনো সময়ের পর যেকোনো কিছু ঘটতে পারে, যদিও আমরা আগে সেই সময়টা জানি না।