এ দেশে নির্বাচনব্যবস্থা চালু করেছিল ব্রিটিশরা। প্রথমে স্থানীয় সরকার, পরে আইনসভার নির্বাচন। তখন অবশ্য সবাই ভোট দিতে পারতেন না। ১৯৩৭ সাল থেকে সাধারণ নির্বাচন হয়ে আসছে নিয়মিত বিরতিতে। তখন ছিল পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা। অর্থাৎ মুসলমানরা ভোট দিতেন মুসলমান প্রার্থীকে আর অমুসলিমরা দিতেন অমুসলিম প্রার্থীকে। পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা তুলে দিয়ে ১৯৬২ সালে যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা প্রথমবার প্রয়োগ করেছিলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। তখন ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের যুগ। ভোটাররা সারা পাকিস্তানে ইউনিয়ন কাউন্সিলে (এখন ইউনিয়ন পরিষদ) ৮০ হাজার লোককে নির্বাচিত করে গঠন করতেন ইলেকটোরাল কলেজ। ওই ৮০ হাজার লোক নির্বাচন করতেন প্রেসিডেন্ট এবং আইনসভার সদস্যদের। এখন আমরা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে যে সাধারণ নির্বাচন দেখি, ১৯৭০ সালে তা চালু করেছিলেন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। তার চেয়ে ভালো নির্বাচন আজ অবধি হয়েছে বলে মনে হয় না।
একটা ভালো নির্বাচন শুধু নাগরিকদের চাওয়া নয়, এটি তাদের অধিকার। এত বছর পরেও ভালো নির্বাচন যদিও অমাবস্যার চাঁদ। আমরা দিন দিন এমন অবস্থা তৈরি করেছি, যে যুক্তিতে ব্রিটিশরা বলত, ভারতবাসী স্বরাজের জন্য প্রস্তুত নয়। আইয়ুব খানও বলেছিলেন, ভোটাররা অশিক্ষিত। তারা সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করতে অক্ষম। তাই তাদের হয়ে তাদের প্রতিনিধিরাই নির্বাচন করবেন। তিনি এর নাম দিলেন বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র। এখন সেটিই যেন ফিরে এসেছে। আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের দাবি নিয়ে একদল লোক তাদের পছন্দের মানুষদের নির্বাচনে জিতিয়ে আনছেন।
এ ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে প্রশাসন ও পুলিশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। প্রশ্ন হলো, তাঁদের নিরপেক্ষতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়? তাঁদের ওপর নির্বাচন কমিশনের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে? নিয়ন্ত্রণ যে নেই, তা গত বুধবার গাইবান্ধায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের চোখের সামনে ও নাকের ডগায় নানান কারসাজি হয়েছে। তাঁরা কানে দিয়েছেন তুলো, চোখে পরেছেন ঠুলি।
এখন গত ছয় দশকে আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, একবার ক্ষমতা হাতে পেলে কেউ সেটা ছাড়তে চান না। নানান কারসাজি করে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পেতে চান। তাঁদের পক্ষে সাফাই গাইবার লোকেরও অভাব হয় না। আইয়ুব খান জনগণের টাকায় কিছু মানুষ পুষতেন—তাদের নানান রকম সুবিধা, উৎকোচ, তমঘা আর রাষ্ট্রীয় পদ বিলাতেন। সেই মডেলটি এখনো জারি আছে। এমন সব মানুষের মুখ থেকে একটি কথা বের করিয়ে নেওয়া হয়—নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন কাগজে–কলমে স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা হলেও কাজকর্মে তারা তার প্রমাণ রাখতে পারেনি। আগের কমিশনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের মেরুদণ্ড শক্ত নয়, তারা সরকারের মুখের দিকে তাকিতে থাকে, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়ে তারা ওই দলের প্রতি পক্ষপাত দেখায় ইত্যাদি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে হতে যাচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচন। কমিশন ভালো করেই জানে, মানুষ কী চায়, সরকার কী চায় আর রাজনৈতিক দলগুলো কী চায়। শুরুতেই তারা স্বীকার করেছে, এখানে আস্থার সংকট আছে। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, একটা ভালো নির্বাচন উপহার দেবে। তারা এ-ও বলেছে, সব দল নির্বাচনে না এলে নির্বাচন ভালো হবে না। নির্বাচনের প্রযোজক যদি হয় নির্বাচন কমিশন, তাহলে এর পরিচালক আর কলাকুশলীরা মাঠে এর প্রয়োগ ঘটান। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশাসন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী; মানে ডিসি-ইউএনও আর এসপি-ওসি। তাঁরা যেদিকে হেলে থাকবেন, জয়মাল্য যাবে তাদের গলায়।
এ ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে প্রশাসন ও পুলিশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। প্রশ্ন হলো, তাঁদের নিরপেক্ষতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়? তাঁদের ওপর নির্বাচন কমিশনের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে? নিয়ন্ত্রণ যে নেই, তা গত বুধবার গাইবান্ধায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের চোখের সামনে ও নাকের ডগায় নানান কারসাজি হয়েছে। তাঁরা কানে দিয়েছেন তুলো, চোখে পরেছেন ঠুলি।
অনেকের আপত্তির মুখে নির্বাচন কমিশন ইভিএমে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্তে অচল থেকেছে। গাইবান্ধার উপনির্বাচন ছিল একটা টেস্ট কেস। ইভিএম পদ্ধতির যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে তাঁরা সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলেন, যাতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা যায়।
এতে ফল হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। একপর্যায়ে কমিশন নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে।
এই আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন দুজন—ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাঁদের পরম মিত্র জাতীয় পার্টির প্রার্থী। কিন্তু সংসদ সদস্য পদ এমন এক মহার্ঘ বস্তু, যেখানে শত্রু-মিত্র বাছবিচার চলে না। যেভাবেই হোক, জিততে হবে। দেখা গেল, নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণায় ও সিইসির বক্তব্য শুনে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি নাকি নির্বাচনে কোনো অনিয়ম দেখেননি। তিনি যদি দলের প্রকৃত মুখপাত্র হয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে, তাঁর দল ‘এ নিয়মেই’ নির্বাচন করতে চায়। তবে আমার ধারণা, ক্ষমতাসীন দলে তাঁদের সভাপতি ছাড়া আর কোনো মুখপাত্র নেই। সভাপতির কথাই শেষ কথা। বাকিরা মাঝেমধ্যে বিনোদন দেন।
নির্বাচন কমিশনের আস্থার জায়গাটি আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এটি ফিরিয়ে আনা যাবে কি না, তা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। নির্বাচন স্থগিত করে ক্ষমতাসীন দলকে বিব্রত করে কমিশন কি কোনো বার্তা দিতে চাচ্ছে—দেখো, আমরা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে বদ্ধপরিকর। কেউ কেউ এমনও বলছেন, এটা একটা পাতানো খেলা। বিরোধীদের, বিশেষ করে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার একটা কৌশল। সরকারও সেটিতে সাই দিয়েছে। উপনির্বাচনে একটি আসন হাত ফসকে গেলে তো ক্ষতি নেই। সামনে বড় নির্বাচন আছে। খেলা হবে সেখানে।
আমাদের মনে আছে, কয়েক বছর আগে একের পর এক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হেরে গিয়েছিলেন। একটু হলেও মানুষের মনে কিঞ্চিৎ আশার ঝিলিক দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। এর পরপরই সরকারি দল স্বমূর্তি ধারণ করেছিল। এবারও কি সেই নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন হবে?
অতটা সংশয়বাদী না হয়ে আমি মনে করি, প্রশাসন ও পুলিশ যদি নিরপেক্ষ থাকে, একটা ভালো নির্বাচন আশা করা যায়। এখানে ইভিএম কোনো ফ্যাক্টর নয়। ইভিএমের বদলে ব্যালট পেপারে ভোট হলেও ইচ্ছেমতো ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরা যায়, বাক্স মাথায় নিয়ে দৌড়ে চলে যাওয়াও যায়। অতীতে এমনটি দেখা গেছে অনেকবার। ব্যালট পেপার হোক আর ইভিএম হোক, কোনো ব্যবস্থাই কাজে আসবে না, যদি কারচুপি করার সুযোগ বন্ধ করা না যায়। সে ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা রাখতে পারে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন ও পুলিশ।
প্রশ্ন হলো দলীয় সরকারের অধীনে প্রশাসন ও পুলিশ কি নিরপেক্ষ হতে পারবে? কিংবা তারা কি সেই ঝুঁকি নেবে। আমার উত্তর হলো, না। আমরা গত পাঁচ দশকে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো ভালো নির্বাচন হতে দেখিনি। সরকারকে বিব্রত করে বা তাকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে প্রশাসন ও পুলিশ তার আইনানুগ দায়িত্ব পালনের ঝুঁকি নেবে, এমনটা মনে হয় না। তাদেরও তো সংসার আছে। চাকরি-বাকরি করে খেতে হয়। অতি বড় নির্বোধও এটা বোঝে।
এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন কী করবে? গাইবান্ধায় তারা যে উদাহরণ তৈরি করল, তা কি তারা আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে কার্যকর করতে পারবে? তাদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে—অনিয়ম দেখলেই নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া, অথবা একযোগে পদত্যাগ করে কমিশনের এবং নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করা। সেট তারা পারবে কি পারবে না, সেই পূর্বাভাস এখন দিতে পারব না। কারণ, আমি সবজান্তা নই।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক