ভারতের প্রসিদ্ধ নিউরোসার্জন শাকির হোসাইন তাঁর রোগীদের সব সময় বলেন, মানুষের উচিত কিছুটা স্বার্থপর হওয়া, নিজেকে সময় দেওয়া এবং নিজের কথা ভাবা। উনি বলেন, ‘খানিকটা স্বার্থপর হও, কারণ তুমি নিজে ভালো না থাকলে আরও পাঁচজনকে ভালো রাখতে পারবে না। কাজেই যতই কাজের চাপ থাকুক, নিয়মিত ঘুমাও, ব্যায়াম করো, আনন্দ করো ও ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো। একসঙ্গে অনেক কাজের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার চেষ্টা কোরো না। তাহলে মন, মগজ ও শরীর—তিনটিই বিগড়ে যাবে।’
বর্তমানে সত্যিই তা–ই হয়েছে আমাদের অবস্থা। মন, মগজ ও শরীর—তিনটিই বিগড়ে যাওয়ার মতো। ডাক্তারের এ কথা শুনে মনে হয়েছিল, উনি যা বলছেন, আমাদের জীবন তো ঠিক এর বিপরীত দিকে বইছে। আমরা ভাবি, সময় কোথায় সময় নষ্ট করার, মানে নিজেকে নিয়ে ভাবার? যাঁকে পরিবারের সবার মুখে ভাত জোগাতে হয়, যাঁকে একসঙ্গে ১০ ধরনের কাজ সারতে হয়, যাঁকে সংসারের আরও অনেক দায়িত্ব বহন করতে হয়, যাঁকে নানাজনের মানসিক ধকল সামলাতে হয়, তিনি কীভাবে স্বার্থপর হবেন?
ডাক্তার বলেছেন, এসব দায়িত্বই ঠিকমতো সামলানোর জন্য তোমাকে নিজের দিকে তাকাতে হবে। জানতে হবে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কীভাবে, কোথায় করা যায়। আধুনিক জীবনের মাল্টিটাস্কিং ও দায়িত্বের সঙ্গেই নিজেকে সময় দেওয়ার ব্যাপারটি জড়িত। অনেক কাজ একসঙ্গে না করে কীভাবে অল্প কিছু কাজ ভালো করে করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।
অথচ এই শহুরে ব্যস্ত ও প্রতিযোগিতামূলক জীবন কী দিচ্ছে আমাদের? সকালে উঠে সংসারের হাজারো কাজ সামলে একজন পুরুষ বা নারী যখন গণপরিবহন বা স্কুটার-রিকশায় চেপে দ্রুত অফিসে বা কাজের জায়গায় পৌঁছানোর জন্য বের হন, তখন তাঁকে পথিমধ্যেই নানান হাঙ্গামার মুখে পড়তে হয়। এর মধ্যে আছে সময়মতো পরিবহন না পাওয়া, ভাড়ায় বনিবনা না হওয়া, যানজট, গরম, ঘাম, ধুলা ইত্যাদি। দিনের শুরুতেই একরাশ ক্লান্তি নিয়ে অফিসে দেরিতে পৌঁছানো। এরপর তো আছে কাজের জায়গায় চাপ, অস্বাচ্ছন্দ্য, চ্যালেঞ্জ, হয়রানি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা এবং আরও নানান ঝামেলা।
তবে কর্মজীবী নারীর চাপ ও কষ্ট কর্মজীবী পুরুষের চেয়ে বেশি। অফিস থেকে বাসায় ফিরে, বাসার সব দায়দায়িত্ব শেষ করার পরেও তাঁকে রাতে মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। সকালে বাসার সহকারী ঠিক সময়ে আসবেন তো? সবার জন্য টিফিন কি হবে? বাসার সহায়তাকারী থাকুক বা না থাকুক, পরিবারে নারীর সকাল হয় সবার আগে। স্বামীর টিফিন, বাচ্চার টিফিন, নিজের খাবার তৈরি করা, বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করা, বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দেওয়া। এরপর শুরু হয় সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ।
একজন কর্মজীবী নারীর মাথায় যেমন চিন্তা থাকে অফিসের ওয়ার্কিং পেপারটা রেডি করা, মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন, প্রোডাক্ট সময়মতো ডেলিভারি, কারখানার শ্রমিকেরা ঠিকমতো কাজ করছেন কি না, চালান রেডি হয়েছে কি না ইত্যাদি নানা কিছু; তেমনি একই সঙ্গে তাঁকে ভাবতে হচ্ছে আজ কী রান্না হবে? কী বাজার আছে? কী নাশতা দেব? ছাদ থেকে শুকনা কাপড় নামানো হয়েছে কি না? ঝোড়ো বাতাস বইছে, জানালাগুলো কি খোলাই আছে? বাবা ঠিক সময়ে ওষুধটা খেয়েছেন কি? বাচ্চার আজকে পরীক্ষা কেমন হলো ইত্যাদি।
অফিসে বসেও নারীকে বাসার শত রকমের দায়িত্ব সামলাতে হয়। চিন্তাজগতে কাজের তাড়া চলতেই থাকে। বাচ্চা স্কুল থেকে সময়মতো বাসায় ফিরল কি না, দুপুরের খাবার দেওয়া হলো কি না, বাসার অসুস্থ মানুষটি কেমন আছে ইত্যাদি নানা কিছু ফোনে ফোনে ম্যানেজ করতে হয়। তা ছাড়া বাসায় গিয়ে কী রান্না হবে, কী বাজার করে নিয়ে যেতে হবে ইত্যাদি চিন্তা এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
একজন কর্মজীবী পুরুষের অবস্থাও বেশ ঝামেলাপূর্ণ। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজে অফিসের জন্য তৈরি হন, অনেকে বাচ্চাকে স্কুলে নামান, যানজটের শহরে সময়মতো অফিসে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। অফিসে কাজের দায়িত্ব, বহুমুখী কৈফিয়ত, বাসার খরচের চিন্তা, বাচ্চার পড়াশোনা, চাকরি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব—সবকিছু সামলাতে হয়।
অফিসে পৌঁছানোর পর নারী-পুরুষ উভয়েরই শুরু হয় অফিশিয়াল কাজের তাড়া। মিটিং, মেইলের উত্তর, কনফারেন্সের জন্য পেপার তৈরি করা, বসের সঙ্গে যোগাযোগ, নিজের টিমকে কাজ ভাগ করে দেওয়া, টেলিফোন কলের উত্তর, ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া, টার্গেট পূরণ করা, পাবলিক ম্যানেজমেন্ট এবং আরও অনেক কিছু। অফিসে বসে শুধু যদি অফিসের চিন্তা থাকত, তাহলেও অনেকটা সহজ হতো জীবন। কিন্তু না, অফিস, সংসার, হাসপাতাল, রোগী, অতিথি, অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের চিন্তা চলতেই থাকে মানুষের মনোজগতে।
এত কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে মাঝেমধ্যে মনে হয় মানুষ কি যন্ত্র? মানুষের কি দশটি হাত? আমরা বলি, ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাবে, তাহাই সয়।’ মানুষের মস্তিষ্কও কি সেই রকমই কিছু? একটার পর একটা চিন্তা শুধু বসিয়ে দিলেই হলো? আমাদের শরীর বা মন বা মস্তিষ্ক কোনোটাই অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আমরা জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে নিজেদের ওপর চাপ বাড়াতেই থাকি।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, একসঙ্গে অনেক ধরনের কাজ বা কাজের চিন্তা মানুষের কর্মদক্ষতা নষ্ট করে এবং তখন মানুষ ভুলভ্রান্তিও বেশি করে। নিউরোসাইকোলজিস্টরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট সময়ে এক ধরনের কাজই করতে পারে। যখন আমরা মনে করি যে আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করছি, তখন কিন্তু আমরা দুটি কাজ একসঙ্গে করতে পারছি না। এর পরিবর্তে আমরা পরপর আলাদা আলাদা কাজ বা রোস্টার ডিউটি করে যেতে থাকি।
আধুনিক ও শহুরে জীবন বলতে আমরা বুঝি প্রতিযোগিতা ও চাপ মোকাবিলা করা। এই জীবনে আমরা যে যত বেশি কাজ করতে পারছি, যত বেশি বোঝা নিতে পারছি বা দায়িত্ব পালন করছি, ততই নিজেদের সফল বলে মনে করছি। ভাবছি, এই নানা ধরনের দায়িত্ব পালনের বা কাজ করার মধ্যেই জীবনের সফলতা নিহিত।
বেশ কয়েকটি জরিপে দেখানো হয়েছে, মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ কার্যকরভাবে একসঙ্গে অনেক ধরনের কাজ করতে পারেন। যখন নাকি আমাদের মস্তিষ্ক সামনে-পেছনে, ডানে-বাঁয়ে একসঙ্গে চলতে থাকে, বিশেষ করে কাজগুলো যখন জটিল ধরনের হয় এবং অনেক মনোযোগ দিতে হয়, তখন আমরা অনেক কাজ একসঙ্গে করতে গিয়ে কম মনোযোগী হয়ে পড়ি এবং ভুলও বেশি করি।
অথচ দেখছি, ক্রমেই আমাদের সবার জীবন মাল্টিটাস্কিং হয়ে যাচ্ছে। আমরা একে এড়াতে পারছি না। সাইকোথেরাপিস্টরা বলেই যাচ্ছেন, আমরা যত বেশি মাল্টিটাস্কের মধ্যে থাকব, তত কম কাজ করতে পারব। কারণ, তখন কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। অনেক কাজের চাপ এবং একসঙ্গে অনেক কাজ করে যাওয়া ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, ক্রনিক ব্যথা এর কারণ। এ ছাড়া এর ফলে পারফরম্যান্স নষ্ট হয়, মস্তিষ্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রতিটিই আমরা আমাদের জীবনে দেখতে শুরু করেছি।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে, মানুষ অনেক কাজ একসঙ্গে ভালোমতোই করছে—এ কথা ভাবলেও এটাই সত্যি যে তারা আসলে ভালোভাবে সব কাজ করতে পারছে না। খুব ঝামেলা পোহাতে হয় সব কাজকে সুসংহত করতে, অপ্রয়োজনীয় তথ্য বাদ দিতে এবং এক কাজ থেকে অন্য কাজে যেতে। মানুষের গতি তখন ধীর হয়ে পড়ে। মানুষের মস্তিষ্ক এক সময় একটা কাজই করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক যদি পুরোপুরি বেইমানি না–ও করে, ভুল করার প্রবণতা সমস্যা বাড়িয়ে দেয়, কাজে মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং অনুপুঙ্খ চিন্তা করার ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। একটার পর একটা কাজ উৎপাদনক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়।
এসব তথ্য না জেনে আমরা আমাদের সাংসারিক ও পেশাগত পরিসরে কাজের চাপ বাড়িয়ে তুলছি। এখন সংসার ও কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি। ১৯৬০ সালে যখন কম্পিউটারের জন্য ‘মাল্টিটাস্কিং’ শব্দটি চালু হলো, তখন বোঝা যায়নি এটা মানুষের জন্যও একসময় এভাবে প্রযোজ্য হবে।
শহুরে জীবনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবসরহীন ও ক্লান্ত জীবনযাপন আমাদের। যে নারী বাইরে কাজ করেন, যে নারী শুধু সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেন, যে পুরুষ চাকরি বা ব্যবসা করেন, তাঁদের কত ধরনের চাপ যে সহ্য করতে হয়, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা অকল্পনীয়।
এর কোনোটাই সুখকর নয়। একজন নাগরিককে প্রতিদিন গণপরিবহন, যানজট, গরম, হয়রানি, পথেঘাটের অনিরাপত্তা ও অব্যবস্থা, সন্তানের স্কুল, তাদের আনা-নেওয়া, বাজার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অসুখ–বিসুখ, সন্তানের বেড়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ—সবই মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারী ও পুরুষের কাজের ধরন বদলেছে এবং প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। সংসার পরিচালনার দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়ে গেলেও নারীর দায়িত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
একজন কর্মজীবী নারীর মাথায় যেমন চিন্তা থাকে অফিসের ওয়ার্কিং পেপারটা রেডি করা, মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন, প্রোডাক্ট সময়মতো ডেলিভারি, কারখানার শ্রমিকেরা ঠিকমতো কাজ করছেন কি না, চালান রেডি হয়েছে কি না ইত্যাদি নানা কিছু; তেমনি একই সঙ্গে তাঁকে ভাবতে হচ্ছে আজ কী রান্না হবে? কী বাজার আছে? কী নাশতা দেব? ছাদ থেকে শুকনা কাপড় নামানো হয়েছে কি না? ঝোড়ো বাতাস বইছে, জানালাগুলো কি খোলাই আছে? বাবা ঠিক সময়ে ওষুধটা খেয়েছেন কি? বাচ্চার আজকে পরীক্ষা কেমন হলো ইত্যাদি।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কাজ ও কাজের চাপ থাকবেই, কিন্তু একে ম্যানেজ করে চলাটাই আসল। তাঁরা বলেন, স্ট্রেসের অন্য সমস্যা হলো, স্ট্রেস আমাদের হরমোন প্রণালির ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যে তাতে শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
রেহাই পাওয়ার জন্য খুব বেশি কিছু না, নিজেকে ভালোবাসতে শিখতে হবে, সময় দিতে হবে ও অবসর খুঁজে নিতে হবে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, গান শুনুন, ছবি আঁকুন, সিনেমা দেখুন, গল্প করুন, সেলাই করুন, বই পড়ুন, বেড়াতে যান, নাটক দেখুন, শখের রান্না করুন, ঘুমান, এলোমেলো ঘোরাঘুরি করুন, পার্কে বসে থাকুন, বাগান করুন, শপিং করুন, রেস্তোরাঁয় খেতে যান বা পোষা কুকুর-বিড়াল রাখুন। তা–ও ভালোবাসার মানুষগুলোর পাশে থাকার জন্যই নিজেকে ভালোবাসুন।
শাহানা হুদা যোগাযোগকর্মী