কেন থামছে না পশ্চিমবঙ্গের গণ-আন্দোলন

আর জি কর মেডিকেল কলেজে শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার পর পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে

শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু পরিসংখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে একটা জায়গায় দুজনেরই অসম্ভব মিল।

দুজনেই আগের নির্বাচনে মোটামুটি ৭৪ শতাংশ আসন পেয়েছেন। হাসিনা জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে পেয়েছেন ২২৪, আর মমতা ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪-এর মধ্যে ২১৫। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই জায়গাতেই দুই ‘সম্রাজ্ঞীর’ ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। মমতার এখনো আছে, কিন্তু টলোমলো ভাবটা আর নজর এড়াচ্ছে না। 

অথচ নির্বাচনের নিরিখে দুজনেরই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রায় ছিল না। মমতার কিছুটা থাকলেও, হাসিনার একেবারেই ছিল না। কিন্তু দুজনেই যে ভুলটা করেছিলেন, সেটা একটি বাক্যে ৫০০ বছর আগে ব্যাখ্যা করেছেন নাট্যকার উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার। জুলিয়াস সিজারকে হত্যার আগে তাঁর সহযোগী ব্রুটাস বলেছিলেন, ‘অ্যাবিউজ অব গ্রেটনেস ইজ হোয়েন ইট ডিসজয়েনস রিমোর্স ফ্রম পাওয়ার’—মহত্ত্বের বা মহানুভবতার পতন তখনই হয়, যখন শাসকের ক্ষমতার মধ্যে কোনো অনুশোচনার বোধ থাকে না।

ক্ষমতার মধ্যে একটা ‘রিমোর্স’ বা ভুলভ্রান্তির কারণে মাথা নত করার বোধ অন্তর্হিত হওয়ার কারণে সিজারের মৃত্যু হয়, কাউকে হেলিকপ্টার ধরে দিগন্তে মিলিয়ে যেতে হয়, আর কারও সিংহাসন হঠাৎই টলমল করতে থাকে, যেমন কয়েক দিন ধরে করছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর। এই আলোচনা তাঁকে নিয়েই। 

অর্ধশতক ধরে রাজনীতি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে এমন কথা বলা যাবে না যে স্তাবক পরিবৃত হয়ে থাকার কারণে মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় যেকোনো ক্ষমতাবান মানুষই স্তাবক পরিবৃত হয়ে থাকেন, মমতা তো বটেই। কিন্তু এরপরও তিনি যখন যাবতীয় সমালোচনা উপেক্ষা করে প্রায় ৭০টি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বছরের পর বছর একটি জীর্ণ অর্থনীতিতে চালিয়ে যান, তখন ধরে নিতেই হয় যে দারিদ্র্যের অপরিসীম গভীরতা সম্পর্কে তিনি অবহিত। মানুষের হাতে দু–পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেওয়ার গুরুত্ব কতটা, সেটা জননেত্রী হিসেবে তিনি বোঝেন। 

মমতা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটেছে, তা পশ্চিমবঙ্গে ঘটানো যাবে না। হঠাৎ এ কথা তিনি কেন বললেন? কেন তিনি ধরে নিলেন যে হাসিনাকে যেভাবে সরানো হয়েছে, সেভাবেই তাঁকে সরতে হবে? এর কারণ কোথাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বুঝতে পারছেন বিরোধিতা বাম-রামের কাছ থেকে আসছে না, আসছে সাধারণের কাছ থেকে, যেমনটা ২০০৭ সালে এসেছিল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে। 

অথচ সেই জননেত্রী গত এক সপ্তাহে এমন কিছু কাজ বা মন্তব্য করলেন, যা থেকে স্পষ্ট যে অন্তত এই সময়ে তাঁর ক্ষমতার মধ্যে অনুশোচনা নেই। গোটা রাজ্য অনুতপ্ত, মর্মাহত, অশ্রুসিক্ত। এই বেদনা যে অচিরেই ক্রোধ হয়ে ফেটে পড়বে তা না বোঝার কোনো কারণ নেই, বিশেষত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি নিজেই বারবার এই ক্রোধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যখন তাঁর সাবেক দল কংগ্রেসের কর্মীদের ওপরে গুলি চলেছে, যখন নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরে কৃষকেরা শহীদ হয়েছেন। ২০২৪ সালে সেই সামগ্রিক ক্রোধকে অগ্রাহ্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গের অবিসংবাদী নেত্রী। 

না হলে ৯ আগস্ট কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের ওপরে শারীরিক অত্যাচার, ধর্ষণ ও হত্যার পরে ওই কলেজেরই অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে লম্বা ছুটিতে না পাঠিয়ে, শোকজ বা সাসপেন্ড না করে আরেকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা কেন পাঠালেন?

সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে একাধিক ইচ্ছাকৃত অপরাধ বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগগুলো এই মুহূর্তে তদন্তের অন্তর্গত। এর মধ্যে না ঢুকে দেখা যাক রাজনৈতিকভাবে কী কী ভুল মমতা গত দিন কয়েকে করেছেন, যা সাধারণ মানুষকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেছে। 

প্রথমত, পরবর্তী সময়ে যার বিরুদ্ধেই দোষ প্রমাণিত হোক না কেন, সামাজিক মাধ্যম-প্রভাবিত সময়ে মানুষ নির্দিষ্ট বিষয়ে সরকারের অবস্থান তৎক্ষণাৎ জানতে চান। 

গত কয়েক দিনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর অবস্থান সন্দীপ ঘোষের পক্ষে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের বিপক্ষে। এর ফলে তৃণমূলবিরোধী জোরালো ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। 

দ্বিতীয়ত, মমতা বলেছেন, ‘বাম-রাম’ অর্থাৎ বামফ্রন্ট এবং বিজেপি চক্রান্ত করছে। আদতে বিষয়টি তা নয়। দেড় যুগ ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। একটা স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। নির্বাচনে সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে না বিরোধীদের ব্যর্থতার কারণে। এমনটা সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের আমলেও হয়েছিল, যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সগর্বে বলেছিলেন, ‘আমরা (বিধানসভায়) ২৩৫, ওরা ৩০।’ এই মন্তব্যের কয়েক মাসের মধ্যে বামফ্রন্টের পতন শুরু হয়। 

নির্বাচনে হারজিত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা একটি দলের জনপ্রিয়তা সব সময় বোঝা যায় না। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এই কথা সত্যি। প্রায় ৭৫ শতাংশ আসন পেয়েও মাঠপর্যায়ে তাঁর পায়ের নিচে থেকে যে মাটি সরে গিয়েছিল, সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি মুজিবকন্যা।

তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা বিরোধী বিএনপি-জামায়াতের চক্রান্ত। একই কথা বলেছেন মমতা, বিরোধীদের চক্রান্ত। বাম-রামের যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে তারা গত নির্বাচনে বেশি আসন পেত। তারা পায়নি। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলনকে মমতা বিরোধীদের চক্রান্ত বলছেন। জুলাই মাসে যে ভুল করেছিলেন হাসিনা, আগস্টে তা করছেন মমতা। 

বস্তুত মমতা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটেছে, তা পশ্চিমবঙ্গে ঘটানো যাবে না। হঠাৎ এ কথা তিনি কেন বললেন? কেন তিনি ধরে নিলেন যে হাসিনাকে যেভাবে সরানো হয়েছে, সেভাবেই তাঁকে সরতে হবে? এর কারণ কোথাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বুঝতে পারছেন বিরোধিতা বাম-রামের কাছ থেকে আসছে না, আসছে সাধারণের কাছ থেকে, যেমনটা ২০০৭ সালে এসেছিল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে। 

ইতিহাসে বারবারই দেখা গেছে ‘রিমোর্স’ থেকে ‘পাওয়ার’ যখনই বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তখনই শাসক চক্রান্ত দেখেছেন। হাসিনা দেখেছেন, বুদ্ধদেব দেখেছিলেন। তিনি নিজে ৪২ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন, এটা ভুলে গিয়ে ‘আরব বসন্ত’ শুরুর সময় পশ্চিমা বিশ্বের চক্রান্ত দেখেছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি, দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনে খালিস্তানিদের চক্রান্ত দেখেছিল বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গে দেখছেন মমতা। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে বিরোধীরা পরিস্থিতি কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে, কারণ সেটাই তাদের কাজ। 

কিন্তু আর জি কর ইস্যুতে সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে বিরোধীদের কাজটা আরও সহজ করে দিচ্ছেন মমতা নিজেই। এমনকি তাঁর দলের যেসব নেতা-নেত্রী আর জি কর ইস্যুতে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। যেমন নেওয়া হয়েছে রাজ্যসভার সাবেক এমপি এবং মুখপাত্র শান্তনু সেন ও তাঁর স্ত্রী কাকলির বিরুদ্ধে। এই সবই তৃণমূলবিরোধী ন্যারেটিভ আরও শক্তপোক্ত করছে। 

তবে তৃণমূল কংগ্রেসের একটা বড় সুবিধা এখনো রয়েছে। বামফ্রন্ট ও বিজেপি কেউই বিরোধী দল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে মাথা তুলতে পারছে না। এর নানা পৃথক কারণ রয়েছে। কিন্তু একটা বড় কারণ হলো গ্রামগঞ্জে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ভাঙতে না পারা।

শহরের মানুষ যেভাবে তৃণমূলের বিরোধিতা করছেন, গ্রামের মানুষ এখনো তা করছেন না হয়তো মমতার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার কারণেই। কিন্তু ধীরে ধীরে শহরের ক্ষোভ গ্রামে বিস্তার করবে। মমতার আরও একটি সুবিধা হলো পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের এখনো দেড় বছর বাকি। অর্থাৎ ঘর গোছানোর সময় পাচ্ছেন মমতা, যেমনটা পাচ্ছেন বিরোধীরাও। 

তবে তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে আগামী দিনে মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়বে। এই ক্ষোভ প্রশমিত করতে মমতা নানান পদক্ষেপ নিতে পারেন। কিন্তু সেই পদক্ষেপের মধ্যে যদি মাথা নত করে মানুষের কাছে যাওয়ার অঙ্গীকার না থাকে অর্থাৎ ‘রিমোর্স’ না থাকে, তবে অবধারিতভাবেই বিপদে পড়বেন তিনি। যেমনটা পড়েছিলেন জুলিয়াস সিজার থেকে মুয়াম্মার গাদ্দাফি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে শেখ হাসিনা। ইতিহাসের বার্তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে তার ফল ভোগ করতে হবে সব শাসককে। মমতাকেও। 

শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা