সম্প্রতি মস্কোর অভিজাত এলাকা রুবলয়ভকাসহ বেশ কিছু এলাকায় ড্রোন হামলার যে ঘটনা ঘটেছে, সেটিকে রুশ কর্তৃপক্ষ কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ক্রেমলিন ইউক্রেনকে দায়ী করলেও কিয়েভ এ হামলার পেছনে তাদের কোনো সম্পৃক্ততাকে অস্বীকার করেছে। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর ১৫ মাস পর রাশিয়ার মাটিতে এ ধরনের হামলা শুরু হলো।
রাশিয়ার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, মস্কোয় ৩০টির মতো ড্রোন হামলা হয়েছে এবং একটি ভবনে সরাসরি হামলার ভিডিও ভাইরালও হয়েছে। কিন্তু ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা খুব দ্রুত নিজেদের মতো একটি বয়ান দাঁড় করিয়েছেন।
মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন দাবি করেছেন, আটটি ড্রোনের হামলা হয়েছে। এ হামলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কেননা কোনো লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করার আগেই সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। রাজনীতিবিদ ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভের সমর্থন পেয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এই লজ্জাজনক ঘটনা থেকে জনসাধারণের মনোযোগ অন্য দিকে ঘোরাতে রুশ সেনারা কতজন ইউক্রেনীয় সেনাকে হত্যা করেছে এবং ন্যাটোর কতগুলো অস্ত্র তারা ধ্বংস করেছে, সেই পরিসংখ্যান দিয়েছেন।
রুশদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ড্রোন হামলার ঘটনাকে খুব হালকা ঘটনা বলে চিত্রিত করা হয়েছে। যদিও অল্পবিস্তর আতঙ্কিত হওয়ার লক্ষণ আছে। কিন্তু এই ড্রোন হামলার ঘটনা থেকে ক্রেমলিনের লোকজন কিংবা সাধারণ রুশদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি ভুলক্রমে হলেও বিশ্বাস করেন যে যুদ্ধটা তাদের বাড়ির আঙিনায় চলে এসেছে।
এ ড্রোন হামলার ঘটনা রাশিয়ার আরেকটি অবাস্তব দাবি যে কতটা অসাড়, সেই প্রমাণ সামনে নিয়ে আসছে। রুশরা মনে করে, তারা রুশ সাম্রাজ্যের সাধারণ ইউক্রেনীয়দের সিআইএ, ব্রিটিশ ও নাৎসিদের হাত থেকে রক্ষা করছে। ২০১৪ সাল থেকেই এ ধরনের প্রোপাগান্ডা অনেক বেড়েছে। রাশিয়া নিজেদের ‘পরাশক্তি’ ভাবে ও পশ্চিমাদের ঘৃণা করে।
রুবলয়ভকায় ড্রোন হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কেড়েছে। মস্কোর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত অঞ্চলটিতে রাশিয়ার শাসকশ্রেণির অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করেন। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সেখানেই প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে বাস করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি গোলাপি রঙের প্রাসাদের দিকেই ড্রোন ছুটে আসছে।
যে অঞ্চলকে লক্ষ্যবস্তু করে ড্রোন হামলা হয়েছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। রাশিয়ার রাজনৈতিক শ্রেণি দেশের বাস্তব অবস্থা ও দুর্দশা থেকে কতটা বাইরে বাস করেন, তারই প্রতীক রুবলয়ভকা। গত সপ্তাহে রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন এই বিষয়টিকেই উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার অভিজাত নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি কল্পনার জগতে বাস করেন, যেখানে যুদ্ধ তাদের ওপর বিন্দুমাত্র প্রভাব তৈরি করতে পারে না। ইউক্রেন যুদ্ধে বিজয় পেতে হলে এই মনোভাব বদল করা প্রয়োজন।
স্বাভাবিকভাবেই ড্রোন হামলার এ ঘটনায় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে এসেছে। রাশিয়া কি তাহলে নিজেরাই এ হামলা চালিয়েছে? ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর পর এটা আর বলা সম্ভব না যে পুতিন ও ক্রেমলিনের এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের বিব্রতকর হামলার কোনো কারণ কি আছে? আবার কিছু রুশের কাছে এই হামলা তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংহত করার উদ্যোগ। এ ধরনের হামলা করার মতো সামর্থ্য ইউক্রেনের আছে, সেটা তারা স্বীকার করে না।
আরও ধ্রুপদি ষড়যন্ত্র তত্ত্বও আছে। রাশিোর পক্ষে যুদ্ধের সমর্থনে দাঁড়ানো ব্লগাররা দাবি করেছেন, এই যুদ্ধের পেছনে দায়ী যুক্তরাষ্ট্র এবং এই ড্রোন হামলা তারাই চালিয়েছে।
এসব ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব থেকে যে যুক্তি সামনে আসে, তা হলো, রাশিয়ার সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে এবং রাজনৈতিক শ্রেণি (পুতিন ও তার ক্রোনিরা) এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলার সামর্থ্য রাখেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ ড্রোন হামলার ঘটনাকে বিবেচনা করার মতো ব্যাপার বলেই মনে করছেন না। হ্যাঁ, তাঁদের দাবি তো সঠিকই, কেননা ইউক্রেনে রুশ যা করছে, সে তুলনায় এ হামলা আসলে কিছুই না। কিন্তু ‘যুদ্ধের সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক ঘটছে’ রাশিয়ার এই একগুঁয়ে দাবিকেও কেউ কেউ ব্যঙ্গবিদ্রূপ করছেন। এ থেকে এটা পরিষ্কার, ফাঁকা আওয়াজ আর যুদ্ধ করার সামর্থ্য—এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক আছে।
ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডা নিয়ে যে ব্যঙ্গবিদ্রূপ চলছে, সেটা দেখে এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে উদার গণতন্ত্রের প্রতি রুশদের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এসব লোকের অনেকেই স্তালিনকে দুর্নীতিমুক্ত নেতার দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন। আমি মনে করি, এই ব্যঙ্গবিদ্রূপ বরং যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে সহযোগিতা করে।
এ ড্রোন হামলার ঘটনা রাশিয়ার আরেকটি অবাস্তব দাবি যে কতটা অসাড়, সেই প্রমাণ সামনে নিয়ে আসছে। রুশরা মনে করে, তারা রুশ সাম্রাজ্যের সাধারণ ইউক্রেনীয়দের সিআইএ, ব্রিটিশ ও নাৎসিদের হাত থেকে রক্ষা করছে। ২০১৪ সাল থেকেই এ ধরনের প্রোপাগান্ডা অনেক বেড়েছে। রাশিয়া নিজেদের ‘পরাশক্তি’ ভাবে ও পশ্চিমাদের ঘৃণা করে।
কিন্তু কেউই চিরকালের জন্য বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে সত্যটা বেরিয়ে পড়েই। প্রায়ই সেটা অপ্রত্যাশিত ঘটনার মধ্য দিয়েই বেরিয়ে পড়ে। বাস্তবতা হলো, দেশপ্রেমমূলক প্রচারণা দিয়ে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিলেও মোটা অঙ্কের বেতন ও সুবিধা দিয়েই রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে এখন নতুন নিয়োগ দিতে হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, রাশিয়ান অভিজাতেরা পশ্চিমাদের কঠোর সমালোচনা করলেও সম্পদ ও ছেলেমেয়েদের ঠিকই পশ্চিমা দেশগুলোকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটাও বাস্তব, মস্কো এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুবলয়ভকায়ায় ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটছে।
জেড ম্যাকগিলিন লন্ডনের কিং’স কলেজের রিসার্চ ফেলো এবং রাশিয়ার যুদ্ধ বইয়ের লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত