ইউক্রেনকে শিগগিরই দুটি বিকল্পের একটিকে বেছে নিতে হবে। বিকল্প দুটি হলো তারা লড়াই চালিয়ে যাবে নাকি যুদ্ধকে প্রলম্বিত করবে? ইউক্রেন যদি এখন রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার দরজা খোলা রাখে, তাহলে তারা খারকিভ, কিয়েভ, নিপ্র, ওদেসা ও লিভ—গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচ শহরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হবে। তাদের সেনাবাহিনীও টিকে থাকবে।
ইউক্রেন যদি রাশিয়ার সঙ্গে একটা বন্দোবস্তে পৌঁছাতে পারে, তাহলে তারা কৃষিপণ্য ও রপ্তানিপণ্য রপ্তানি করে তাদের দেশের জন্য প্রচুর বিদেশি মুদ্রা আয় করতে পারবে। তাতে করে বিদেশে নির্বাসিত বেশির ভাগ ইউক্রেনীয় দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে এটাও নির্ভর করবে, একটা শান্তিচুক্তি হয়ে যাওয়ার পর ইউক্রেনের অবকাঠামো কতটা অক্ষত আছে, তার ওপর।
যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হয়, একটি দেশের শিল্পের অবকাঠামোর মেরুদণ্ড ততটাই ভেঙে পড়ে। আবার যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে শরণার্থীদের দেশে ফেরার সম্ভাবনা কমে যায়। কেননা, দক্ষ জনশক্তির বেশির ভাগই অন্যত্র কাজ খুঁজে নেয় অথবা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। যুদ্ধ যদি চলতেই থাকে, তাহলে ইউক্রেন তাদের বড় শহরগুলো সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নটি সামনে আসছে। তারা তাদের অর্থনীতি সচল রাখতে পারবে কি না কিংবা স্বাধীন একটা সরকার বজায় রাখতে পারবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
পশ্চিমাদের সহযোগিতার ভরসা খুব বেশি দিন করা ঠিক হবে না ইউক্রেনের। পশ্চিমারা তাদের যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটা তারা কবে পাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো একটা মন্দা ও বাজেটঘাটতির মধ্যে রয়েছে। যুদ্ধ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ইউক্রেনের পুনর্গঠন ব্যয় নিশ্চিত করেই আরও অনেক বেশি বাড়বে। আর বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য প্রতিশ্রুত সহযোগিতা ছাড় করতে কয়েক দশক সময় লেগে যাবে।
ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে যুদ্ধকে প্রলম্বিত না হতে দিয়ে একটা বন্দোবস্তের চেষ্টা করা। অনেকে মনে করেন, যত দিন পর্যন্ত সময় লাগুক, যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া হবে—বাইডেনের এই অঙ্গীকারের পেছনে আগামী নির্বাচনে তাঁর প্রচারণার বিষয়টি রয়েছে। কিন্তু জনমত বলছে, এই কৌশল ভুল।
যুদ্ধের খরচ চালানো, কর্মচারীদের বেতন দেওয়া ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ইউক্রেনকে এখন পুরোপুরি পশ্চিমাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। সহযোগিতা পাওয়ার পরও ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এমন সব বড় সমস্যায় পড়েছে, যেটা সমাধান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। রাশিয়ার হামলা থেকে ইউক্রেনের নাগরিকদের রক্ষা করতে পারছে না দেশটির সেনাবাহিনী। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করতে পারছে না অবকাঠামো। এর সঙ্গে আরেকটি বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে, পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দেশগুলোর গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামরিক রসদের ঘাটতিতে পড়েছে। এই সরবরাহ ঘাটতি বহুমুখী সমস্যা তৈরি করছে।
প্রথমত, নিজেদের মজুত থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করায় ন্যাটো দেশগুলোর নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
দ্বিতীয়ত, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলো ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধে নামতে পারছে না। এর কারণ তাতে করে সাধারণভাবে ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগেই র্যান্ড এবং অন্যান্য থিঙ্কট্যাংক বলেছিল, রাশিয়ার আক্রমণ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা কঠিন হবে এবং এতে ইউরোপের পতন ঘটতে পারে। এখন আক্ষরিক অর্থেই ন্যাটোর গোলাবারুদ শেষ হয়ে এসেছে। ফলে পরিস্থিতি আরও অনেক শোচনীয়।
তৃতীয়ত, ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটোর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে থাকা সবচেয়ে সেরা প্রযুক্তি, যেগুলোকে এত দিন গেম চেঞ্জার বলে মনে করা হতো, সেগুলো যুদ্ধের ফলাফল পরিবর্তনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না।
পরিশেষে, যুদ্ধের যে ব্যয় ও ফলাফল, তাতে করে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতায় টান পড়ছে। ২০০৮ সালে ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যাটোকে সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ন্যাটো সম্প্রসারণের ফলাফল কী হতে পারে, সেটা পুরোপুরি অনুধাবন করা যায়নি। কেননা, এটি ন্যাটো জোট ভেঙে দেওয়ার প্রকৃত ঝুঁকি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র আরও শক্তিশালী ন্যাটোর কথা বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও বড় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা বলছে। এই ধারণার ভিত্তিটা এসেছে জিগনিউ ব্রেজেনস্কির ভূরাজনৈতিক তত্ত্ব থেকে।
ব্রেজেনস্কি মূলত ঊনবিংশ শতকের ভূরাজনৈতিক কৌশলপ্রণেতা ম্যাকিন্ডারের ‘স্ট্র্যাটেজিক বাইবেল’ তত্ত্বের নতুন একটি সংস্করণ প্রস্তাব করেছেন। এর মূল বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ইউরেশিয়ান (ইউরোপ ও এশিয়ার পুরো অংশ) অঞ্চলে তার ক্ষমতা চর্চা করতে হবে। এই প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নোঙর গাড়ার একটি স্থান। এ ছাড়া মধ্য এশিয়া থেকে রাশিয়াকে হটিয়ে সেখানে ভিত্তি গাড়তে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন যেমনটা আশা করে সে রকম করে যদি ইরানের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়তে পারে, তাহলে ককেশাস থেকে রাশিয়াকে বের করে দিতে পারবে। উল্লেখ্য, রাশিয়ার দীর্ঘদিনের মিত্র দেশ আর্মেনিয়াকে মানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কী অর্জন করতে চেষ্টা করছে, সেটা রাশিয়া ঠিকঠাকভাবে বুঝতে পারছে। ওয়াশিংটনের প্রথম মনোযোগের জায়গা ইউক্রেন। কিন্তু মস্কো এ ব্যাপারে সজাগ যে প্রতিবেশী দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা, কূটনীতিক, এনজিও ও সিআইএ–র অবস্থান তাদের ওপর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। রাশিয়ার পাল্টা কৌশল হচ্ছে ন্যাটোকে ভেঙে দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্র যেমন চায় রাশিয়াতে ক্ষমতার পালাবদল ও রাশিয়ার শক্তিকে দুর্বল করে দিতে চায়।
ইউক্রেন অবশ্যই এমন ভূখণ্ড নিজেদের পুনর্দখলে নিতে লড়াই করছে, যেখানে লাখ লাখ রাশিয়ান বাস করেন। রুশভাষী জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করে ইউক্রেনের পক্ষে নিয়ে আসার পরিবর্তে তারা একটি কাঠামোগত শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। স্কুল ও সরকারি অফিসে রাশিয়ান ভাষা ব্যবহারে তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ক্ষেত্রেও তারা সেটা করেছে। রুশ সাহিত্য পাঠের ওপর তারা বিধিনিষেধ দিয়েছে। রাশিয়ান অর্থোডক্স যাজকদের তারা গ্রেপ্তার করেছে।
তথাকথিত নজরদারির অভিযোগে, রাশিয়ানদের সাংস্কৃতিক স্থান এবং রাশিয়ানদের অন্যান্য প্রতীকী স্থাপনা পদ্ধতিগতভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইউক্রেন। ইউক্রেনে রাশিয়ান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ খোলা নেই, মিলমিশের কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইউক্রেনে এখনো অনেক জায়গা আছে যেখানে বিপুলসংখ্যক রুশভাষী বাস করেন। যেমন ওদেসায় মোট ১০ লাখ ২০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে ৬২ শতাংশ ইউক্রেনীয় এবং ২৯ শতাংশ রুশভাষী। একসময় ওদেসার মোট জনগোষ্ঠীর ৩২ শতাংশ ছিল ইহুদি। কিন্তু সেখানকার ইহুদিরা নাৎসিদের হত্যার শিকার হয়। এখন সেখানে ১ দশমিক ২ শতাংশ ইহুদির বাস। রাশিয়ার ভেতরে জোরালো দাবি আছে তাদের সেনাবাহিনী যেন ওদেসার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
৫ অক্টোবর সোচিতে ভলদাই ডিসকাশন ক্লাবে দেওয়া বক্তব্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধে তাঁর লক্ষ্য কী, সেই রূপরেখা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নতুন ভূখণ্ড অধিকারের চেয়ে দনবাস ও ক্রিমিয়াতে সংঘাত থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করা। পুতিনের এই বক্তব্যের মানে এই নয় যে যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে রাশিয়া কেবল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ডের জনসাধারণকে রক্ষা করার কাজটিই করবে।
ইউক্রেন যদি যুদ্ধ অব্যাহত রাখে, তাহলে বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা এখন যে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে, তার থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে, ইউক্রেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে, সামরিক নেতৃত্বের পরিবর্তন হতে পারে, সরকার উৎখাতও হতে পারে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারবে সেটা নিয়েও সন্দিহান অনেকে।
ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে যুদ্ধকে প্রলম্বিত না হতে দিয়ে একটা বন্দোবস্তের চেষ্টা করা। অনেকে মনে করেন, যত দিন পর্যন্ত সময় লাগুক, যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া হবে—বাইডেনের এই অঙ্গীকারের পেছনে আগামী নির্বাচনে তাঁর প্রচারণার বিষয়টি রয়েছে। কিন্তু জনমত বলছে, এই কৌশল ভুল।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে একটা মাত্রায় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল বদলে যায়, সে রকম সমর্থন তারা করবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। ইউক্রেন সরকারের এখন উচিত রাশিয়ার কাছে জানতে চাওয়া তাদের শর্তগুলো কী?
স্টিফেন ব্রায়েন, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত