জাপানে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের কাছে সুন্দর আবহাওয়ার দিনটি খুবই আনন্দের। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে দিনটি সবাই ভীষণ উপভোগ করে।
অন্যান্য সংস্কৃতিতেও এমনটা থাকতে পারে।
বৈরী বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্মকে যেমন ব্যাহত করে, তেমনি মানসিকভাবে সে নিরানন্দ বোধ করে।
সুতরাং দৈনন্দিনের আবহাওয়া মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিকতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
অনিয়ন্ত্রণযোগ্য বৈশ্বিক উষ্ণায়নে আবহাওয়ার ‘অশান্তি’ মানবজাতির দুর্দশা কি বাড়াচ্ছে? এমনটাই আভাস দিয়েছে জার্মান পররাষ্ট্র অফিস।
জলবায়ু, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উপাত্তের সংমিশ্রণে একটি সর্বজনীন সূচকের মাধ্যমে তারা জলবায়ুর পরিবর্তনে বিশ্বে সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘাতের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে চিহ্নিত করেছে। তাদের গবেষণা বলছে, পরিবর্তিত জলবায়ুতে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, হিন্দুকুশ ও হিমালয় অঞ্চল, দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় সামাজিক উত্তেজনা–অস্থিরতার তীব্রতা বাড়বে বা অব্যাহত থাকবে।
একসময় বৈশ্বিক আবহাওয়া নিয়ম মেনে চলত। অর্থাৎ জলবায়ু ছিল ‘স্থিতিশীল’।
পরিবেশের ওপর মানুষের মাত্রাতিরিক্ত খবরদারি ও জীবাশ্ম জ্বালানির অত্যধিক ব্যবহারে জলবায়ুর স্থিতিশীলতা এখন নেই, ফলে উষ্ণায়নের হার নিত্যনতুন রেকর্ডের জন্ম দিচ্ছে।
যেমন ২০২৩ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০০-২০১৯ সালে চরম ও বৈরী আবহাওয়ার দরুন বিশ্বে ২ দশমিক ৮৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এর মূল কারণ গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নির্গমন।
চরম আবহাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিশ্ব অর্থনীতি প্রতি ঘণ্টায় হারাচ্ছে ১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ২০ বছরে মোট ১৮৫টি চরমতম আবহাওয়ার ঘটনায় বিশ্বে ৬০ হাজার ৯৫১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
অন্যদিকে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির ১৬ শতাংশ ছিল তাপপ্রবাহ–সম্পর্কিত, ১০ শতাংশ বন্যা ও খরা আর ২ শতাংশ ছিল দাবানলের কারণে।
আন্তর্জাতিক থেকে স্থানীয় পর্যায়ে উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কর্মপন্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, কিন্তু তাপমাত্রার বৃদ্ধি কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বৈরী আবহাওয়ায় বিশ্ব হারাবে বছরে ৩ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এ তো গেল অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির কথা। এ ছাড়া পরিবর্তিত জলবায়ু বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অস্থিরতা, শ্রেণি-গোষ্ঠী সংঘাত ও আন্তরাষ্ট্রীয় তিক্ততা বাড়াচ্ছে।
সেটা কীভাবে? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনার কৃষিজমি রয়েছে এবং চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানির জোগানও রয়েছে বা বৃষ্টি হচ্ছে।
স্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে প্রতিবছর ফলন ভালোই হচ্ছে আর আপনি পরিবার নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করছেন।
জলবায়ুর উষ্ণায়ন যেহেতু তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতকে অনিয়মিত করছে, স্বাভাবিকভাবে আপনার জমির ফলনও ব্যাহত হবে।
এ কারণে আপনাকে পরিবারের ব্যয় মেটাতে ঋণ করতে হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়া নিয়তি হয়ে উঠলে আপনি একসময় নিঃস্ব হয়ে যেতে পারেন বা জীবিকার পথগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মনুষ্য-কর্মকাণ্ডে পরিবর্তিত জলবায়ু, বিশেষ করে অনিয়মিত–আকস্মিক বৃষ্টি ও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, সারা বিশ্বে এভাবেই মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।
ফলে জলবায়ুর কারণে সামাজিক সংঘাতের ঝুঁকি ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।
গবেষণা বলছে, তাপমাত্রার বৃদ্ধি, অনিয়মিত ও ভারী বর্ষণ, খরা এবং অন্যান্য জলবায়ুজনিত অস্বাভাবিকতা উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত, এমনকি উন্নত দেশগুলোয় নাগরিক সংঘাত, আন্তসাম্প্রদায়িক সহিংসতা, দুর্ধর্ষ অপরাধ, আন্তরাষ্ট্রীয় কলহ ও সামাজিক অস্থিরতাকে দিন দিন অসহনীয় করছে।
উষ্ণায়নের দরুন ডাকাতি, শারীরিক আক্রমণ ও সম্পদ-সংশ্লিষ্ট অপরাধের প্রমাণ মেলে জাপান, তাইওয়ান, ভারত, মালয়েশিয়া ও নিউজিল্যান্ডে।
আফ্রিকার লেক চাদ বেসিনে দীর্ঘ সময় খরার দরুন অন্তঃ ও আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাত ১৮৮৫-২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিল নিয়মিত ঘটনা।
আবার জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘন ঘন সংঘটনে সম্পদহানি মানুষের অভিযোজনের ক্ষমতাকে হ্রাস করে।
ফলে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মধ্যে বেঁচে থাকার নিমিত্তে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধিতে শান্তি বিনষ্ট হয়।
এমন উদাহরণ বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। এমন প্রমাণ উপমহাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশেই (মেকং অববাহিকা) বাড়ছে, মূলত সম্পদের অভাবে।
আফ্রিকা মহাদেশে বৃষ্টির স্বল্পতায় পানির দুষ্প্রাপ্যতা আন্তসাম্প্রদায়িক সহিংসতার অন্যতম কারণ। এই উদাহরণগুলো মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল।
আবার সুশাসনের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও বেকারত্ব পরোক্ষভাবে পরিবর্তিত জলবায়ুতে সামাজিক সংঘাতকে বেগবান করছে।
পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের অভাব ও রাজনৈতিক প্রান্তিকতায় বাস্তুচ্যুতি নিয়মে পরিণত হয়, ফলে উৎস ও গন্তব্যস্থল উভয় প্রান্তেই নানাবিধ অশান্তির উদাহরণ কম নেই।
বলা বাহুল্য, জলবায়ুজনিত সামাজিক সংঘাত ও অস্থিরতা অতীতে আফ্রিকায় বেশি হলেও এশিয়া এখন চ্যাম্পিয়ন।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি কীভাবে সামাজিক অস্থিরতাকে উসকে দিচ্ছে, সে ব্যাপারে কাজ কম।
তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততার দরুন সুপেয় পানির অভাব, ফসলহানি বা অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে কিছু সামাজিক অস্থিরতার কথা জানা যায়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণা অপ্রতুল।
আমি সাতক্ষীরার শ্যামনগরে দেখেছি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও ভূমির অবনমনের কারণে বসতভিটা ও আবাদি জমির আয়তন কমছে, মহাজনদের চতুরতায় মানুষ নামমাত্র মূল্যে জমিজিরাত বিক্রি করে শহরমুখী হচ্ছে।
এ বছর বন্যায় লুট ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায়, এগুলোও জলবায়ুজনিত ‘অশান্তি’র নমুনা।
আমাদের একটি গবেষণায়ও দেখেছি সমুদ্রসমতলের উচ্চতা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগছে, তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধি।
এই তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৮ শতাংশকে অবশ্যই সম্পদে পরিণত করা সম্ভব ছিল বা আছে। কিন্তু আমরা তাঁদের মেধা ও অপার সম্ভাবনাকে যথাযথ ব্যবহার না করে শুধু দেশেরই ক্ষতি করছি না, তাঁদের ভবিষৎকেও বিপদাপন্ন করছি। পৃথিবীর কোনো জাতি এমনটা করেছে কি না, তা জানা নেই। গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে নগণ্য অবদানের দেশগুলোকে টিকে থাকতে হলে কার্যকর জলবায়ু অ্যাকশনের বিকল্প নেই।
সামনের দিনগুলোয় এগুলো গুণিতক হারে বাড়বে। এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় আমরা কতটুকু সক্ষম?
সম্পদের যথাযথ ব্যবহার না করে আমরা শুধু গাল ফুলিয়ে দেশি-বিদেশি ফোরামে বলছি, ‘আমরা কম নির্গমন করি, কিন্তু খুবই ঝুঁকিতে আছি’, ‘৩৫ শতাংশ ভূমি সমুদ্রে চলে যাবে’ বা ‘কোটি কোটি লোকের বাস্তুচ্যুতি ঘটবে’ ইত্যাদি। কেন বলছি, যদি কিছু মেলে!
কিন্তু পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছি কি বা নিজেদের সক্ষমতা কি বাড়ছে? দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু আমরা এখনো ঝুঁকি মোকাবিলায় অনেক পিছিয়ে।
যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন কোটি কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটবে বা ঘটছে, ফলে শহরের ওপর চাপ বাড়ছে–বাড়বে। এ ব্যাপারে আমরা কী করেছি?
সাবেক সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়মের কথা গণমাধ্যমে চাউর হয়েছে অনেকবার। এটাকে ‘পরিকল্পিত’ উপায়ে সীমিত সম্পদের সাড়ে সর্বনাশ বলা যেতে পারে।
ফলপ্রসূ পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা যদি বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে নিকটবর্তী এলাকায় অভিগমনে সক্ষম হই, তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের ওপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হবে।
কিন্তু আমরা লুটপাটের ধারণায় বেশি উজ্জীবিত। এ কারণে ধনী-গরিবের বৈষম্য যেমন বাড়ছে, তেমনি গরিব আরও গরিব হচ্ছে। অথচ আমাদের ছিল পর্যাপ্ত জনসংখ্যা, অনেক উন্নত দেশের জন্য যা স্বপ্ন।
আমাদের মোট জনসংখ্যার অন্তত ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ তরুণ (১৫-২৯ বয়স গ্রুপ)।
এই তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৮ শতাংশকে অবশ্যই সম্পদে পরিণত করা সম্ভব ছিল বা আছে। কিন্তু আমরা তাঁদের মেধা ও অপার সম্ভাবনাকে যথাযথ ব্যবহার না করে শুধু দেশেরই ক্ষতি করছি না, তাঁদের ভবিষৎকেও বিপদাপন্ন করছি।
পৃথিবীর কোনো জাতি এমনটা করেছে কি না, তা জানা নেই।
গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে নগণ্য অবদানের দেশগুলোকে টিকে থাকতে হলে কার্যকর জলবায়ু অ্যাকশনের বিকল্প নেই।
ধনী দেশগুলো ফলপ্রসূ অভিযোজনপ্রক্রিয়ার পদ্ধতি বাতলালেও তহবিল ছাড়ের ব্যাপারে গোঁজামিলের আশ্রয় প্রথম থেকেই নিচ্ছে।
সুতরাং আগামী দিনগুলোয় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের সব চাপ সামলাতে হবে, সেটা প্রায় নিশ্চিত।
তাই ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান সামাজিক সংঘাত নতুন মাত্রা যোগ করবে। আর আমাদের মতো জনবহুল দেশকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলা করতেই চলে যাবে সময়।
পরিবর্তিত জলবায়ুতে আবহাওয়ার ‘অশান্তি’ মোকাবিলায় আমাদের নিয়তি কি বিদেশনির্ভরই থাকবে?
ড. আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সের গবেষণা পরিচালক।