দুর্নীতির এই বাড়বাড়ন্ত অবস্থার পেছনে কী

বাংলাদেশে দুর্নীতি অকস্মাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নয়। কিন্তু সময়ে সময়ে এ নিয়ে আলোচনার যে ঝড় ওঠে, এই দফার আলোচনা তার চেয়ে খানিকটা বেশি বলেই প্রতিভাত হয়। সাম্প্রতিককালে দুর্নীতিবিষয়ক আলোচনার একটি প্রেক্ষাপট হচ্ছে ২১ মে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেছিল।

জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটি নেওয়া হয়েছে সেকশন ৭০৩১ (সি)-এর আওতায়। স্মরণ করা দরকার, ফরেন রিলেশনস অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের এই বিধির উপশিরোনাম হচ্ছে: অ্যান্টি-ক্লেপ্টোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস।

আজিজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে এই আইনের ব্যবহারে যেটা লক্ষণীয়, তা হচ্ছে ‘ক্লেপ্টোক্রেসি’ বিশেষ্যটির ব্যবহার। সাধারণ জ্ঞান থেকেও এটা বোধগম্য যে সাধারণভাবে দুর্নীতি, এমনকি যদি তা বড় আকারের আর্থিক দুর্নীতিও হয়, তবে তাকে ক্লেপ্টোক্রেসির আওতায় আনা সম্ভব নয়। দুর্নীতির সঙ্গে ক্ষমতার একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র ছাড়া ক্লেপ্টোক্রেসি প্রতিষ্ঠা বা বিস্তার লাভ করে না। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি, যুক্তরাষ্ট্র এদিকটার ওপর জোর দিতেই ক্লেপ্টোক্রেসি বিশেষ্যটি ব্যবহার করেছিল।

সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদের হিসাব বেরিয়েছিল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন ব্যবস্থার আগেই। গত ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠ এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু বেনজীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি; বরং ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর একধরনের সুনসান নীরবতাই চলছিল। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে একধরনের গা ছাড়া ভাবই দেখা গিয়েছিল।

কিন্তু অবস্থার বদল ঘটে গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে। এ সময় দুদক নড়েচড়ে বসে। গণমাধ্যমগুলোর ‘তদন্তে’ বেরোতে থাকে কী বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী সাবেক পুলিশপ্রধান! ঝড়ের গতিতে চলে দুদকের তদন্ত আর ক্রোকের নির্দেশ। সবাই বুঝতে পারেন, ইতিমধ্যে বেনজীর তাঁর বিশাল অর্থ ব্যাংক থেকে সরিয়ে নিয়ে সপরিবার বিদেশে চলে গেছেন। এটাও বোঝা যায়, বেনজীরের বিরুদ্ধে যা-ই হচ্ছে সেই সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক’, তাঁকে সরকার ‘খরচের খাতায়’ পাঠিয়ে দিয়েছে (এ কে এম জাকারিয়া, ‘বেনজীর কেন খরচের খাতায়’। প্রথম আলো, ২৯ মে ২০২৪)

বেনজীরের ব্যাপারে আলোচনার মধ্যেই আরও কিছু সরকারি কর্মকর্তার সম্পদের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ তোলা হয়েছে। তাঁদের একজন হচ্ছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তাঁর ‘অঢেল সম্পদ’ নিয়ে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদের পটভূমিকায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের সম্পর্কে গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ের প্রকাশিত বা প্রচারিত অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রসঙ্গে’।

বিবৃতির সারবস্তু সহজ ভাষায় বললে পুলিশের অ্যাসোসিয়েশন পুলিশের কর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিরূপ খবর প্রকাশ পাক, তা চায় না​। এই সময়ে যেটি আরও বেশি স্পষ্ট হয়, সেটি হচ্ছে আছাদুজ্জামান মিয়ার মাথার ওপর থেকে রাজনীতির ছাতা সরে যায়নি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ২১ জুন। তাঁর ভাষায়, ‘পুলিশকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের মতলব আছে। ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ বানানোর যে চক্রান্ত চলছে, এটা আওয়ামী লীগকে হটানোর জন্য ষড়যন্ত্র কি না, সেটা ভেবে দেখতে হবে।’ (প্রথম আলো, ২১ জুন ২০২৪)

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, তাঁর সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। তিনি বলেছেন, ‘যারাই দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্সের’ বক্তব্য অবশ্য নতুন নয়; গত ১৪ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, ব্যবস্থা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী যদিও এ দফায় বলেননি ঠিক কবে থেকে এই অভিযান শুরু হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্রায় নিয়মিত সরকারের মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাপারে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো তারই প্রতিফলন কি না, সে প্রশ্ন করা যায়। তা-ই যদি হয়, তবে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মান, এমনকি স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ যে সত্য, তা সরকারের ঘনিষ্ঠজনেরা স্বীকার করেন। সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে গত ২৭ জুন সেটাই বলেছেন। কিন্তু তাঁর আপত্তি এগুলো নিয়ে লেখালেখি। তাঁর ভাষায়, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হঠাৎ করে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রোপাগান্ডা হচ্ছে। এটা ষড়যন্ত্রের অংশ, কিন্তু তারপরও এগুলো সত্য।’ (প্রথম আলো, ২৭ জুন ২০২৪)

ঘটনা সত্য হলে সে বিষয়ে খবর কেন প্রোপাগান্ডা হবে, তা বোধগম্য নয়। দুর্নীতিবিষয়ক এসব ঘটনার সর্বশেষ বিষয় হচ্ছে, সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের ২ জন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী আছেন। তাঁকে নিয়েও ইতিমধ্যে অনেক খবর বেরোচ্ছে।

এই ফাঁসের ঘটনা ঘটছে ২০১৫ সাল থেকে। ফাঁসের ঘটনা নিয়ে আগেও কথা হয়েছে, কিন্তু পুলিশের কোনো ধরনের তৎপরতা দেখা যায়নি। এখন তাদের কর্মতৎপরতার গতি দেখার মতো। আর এই তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, এ বিষয়ে কমিশনের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা কিছুই জানতেন না? এটা কেবল এ ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন অন্যান্য কথিত দুর্নীতিবাজের ব্যাপারেও।

তাঁরা সরকারের অংশ হিসেবে থেকেছেন, ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাঁদের যাঁরা নিয়োগ দিয়েছেন, পুরস্কৃত করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাঁরা এর কিছুই জানতেন না! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আগামী কিছুদিন বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কথিত দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে আলোচনা, এমনকি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশও অব্যাহত থাকবে।

এগুলো যে বাংলাদেশের সমাজে-প্রশাসনে ব্যাপক আকারে শিকড় গেড়ে বসা দুর্নীতির যৎসামান্যই প্রকাশ করছে, সেটাও নাগরিকেরা জানেন। তাঁদের প্রতিদিনের জীবনেই তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন। এই খবরাদির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনেরা এমন ধারণাই দেবেন যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান কঠোর। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুদকের ভূমিকা ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল’ ধরনের।

এসব দুর্নীতির সঙ্গে যে ক্ষমতাকাঠামোর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা আছে, সে প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আজিজ আহমেদের ক্ষেত্রে ক্লেপ্টোক্রেসি বিশেষ্য ব্যবহার করে ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ নিয়ে এখন যাঁরা আলোচনা করছেন, তাঁরা কি সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছেন? এমন এক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ওপরে ক্ষমতাকাঠামো দাঁড়ানো, যেখানে এই ব্যবস্থাকে যাঁরা টিকিয়ে রাখছেন, তাঁদের এ ধরনের ‘সুবিধা’ দিতে হবে। তা কেবল উচ্চপর্যায়ের সিভিল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা ভোগ করবেন, তা নয়। যেটা জরুরি, সেটা হচ্ছে, এটা স্পষ্ট করে বলা যে এসব দুর্নীতি বিস্তার লাভ করছে বিরাজমান শাসনব্যবস্থার জন্য।

আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কোনো কোনো ব্যক্তির দুর্নীতির ঘটনার বর্ণনা যেন এই ধারণা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য না করে যে এগুলো ক্ষমতাসীনদের অজ্ঞাতে ঘটেছে এবং সামগ্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই; বরং ক্ষমতাসীনেরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ক্ষমতাসীনেরা তা-ই চান, কেননা এ ধরনের ধারণা ক্লেপ্টোক্রেসিকে বৈধতা দেবে।

মনে রাখতে হবে, ক্লেপ্টোক্রেসি একজন-দুজন দুর্নীতিবাজ তৈরি করে না, ক্লেপ্টোক্রেটিক-ব্যবস্থায় দুর্নীতিবাজের সংখ্যা হয় অগুনতি; ব্যবস্থার বদল না হলে এ সংখ্যা বাড়তেই থাকে।

● আলী রীয়াজ ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি