সেফটি বা নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি, যন্ত্রপাতি ঠিকমতো আছে কি না, রক্ষণাবেক্ষণ করছে কি না, আধুনিক কি না ইত্যাদি। সেফটির নীতি হচ্ছে, যেকোনো দুর্ঘটনা থেকে মানুষ, সমাজ কিংবা পরিবেশকে সুরক্ষা প্রদান করা। কিন্তু এই সুরক্ষা নিশ্চিত করা কি কেবল যন্ত্রপাতি দিয়ে সম্ভব? তাহলে ধরুন, আপনি আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনলেন কিন্তু দক্ষ ও সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নেই, সঠিক পরিকল্পনা নেই, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, তাহলে কি আপনার এই আধুনিক যন্ত্রপাতি আপনার, আপনার প্রতিষ্ঠানের কিংবা মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে? নিশ্চয়ই না!
১৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন ছিঁড়ে একটি গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু, চকবাজারে প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লেগে ৬ শ্রমিকের অকালমৃত্যু এবং গুলিস্তানে হল মার্কেটের নির্মাণকাজের রড পড়ে বেশ কয়েকজন পথচারী গুরুতর আহত হয়েছেন। এভাবে প্রতিদিনই দেখছি সড়ক, নৌ, অগ্নিদুর্ঘটনা ও বিল্ডিং ধসে শত শত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি ও পরিবেশের বিপর্যয়। এই দুর্ঘটনার হার প্রতিদিনই বাড়ছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য জোর দাবি জানাই, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য হইচই করি। এই করলে, সেই করলে দুর্ঘটনা রোধ হবে বলে চিৎকার করতে থাকি। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির জন্য সভা-সমাবেশ করি। কিছুদিন পর আবার আমরা হারিয়ে যাই। যে অবস্থায় ছিল, আবার সেই অবস্থায় থাকে সবকিছু। নিয়ম থাকে কিতাবের জায়গায়, পরিদর্শক থাকে পরিদর্শকের জায়গায়, ব্যবস্থাপক থাকে ব্যবস্থাপকের জায়গায়। আবার যা হওয়ার, তা–ই হয়।
এভাবে আর কত দিন চলবে এই অব্যবস্থাপনা? এই অব্যবস্থাপনা কি একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়? আজ প্রতিটি জায়গায় দেখতে পাই অব্যবস্থাপনার স্বর্গরাজ্য। হোক সে উড়ালসেতু নির্মাণ, ভবন নির্মাণ, কলকারখানা কিংবা যানবাহন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই একটি নির্দিষ্ট কালচার থাকে। এই কালচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে প্রত্যেক ব্যবস্থাপক এবং প্রত্যেক ব্যক্তির আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনে কখনো পিছপা না হওয়া। কালচারের ওপর নির্ভর করছে প্রতিষ্ঠানের সফলতা, গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি।
প্রতিষ্ঠানের জীবনযাত্রার সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেটি হলো সেফটি কালচার। সেফটি কালচার হচ্ছে কতগুলো বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি, যা সবাইকে লালন ও ধারণ করতে হয়। প্রতিষ্ঠানকে সেফটি কালচারের বিষয়ে বীজ বুনে দিতে হয় তার প্রত্যেক ব্যবস্থাপক ও কর্মীর ভেতর। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপকের ভূমিকাই মুখ্য। প্রতিষ্ঠানের কালচার থেকেই সেফটি কালচার তৈরি হয়। মোদ্দাকথা, সেফটি কালচার হচ্ছে সব দুর্ঘটনা রোধের একমাত্র মূলমন্ত্র। কোম্পানির উৎপাদন বাড়াতে, আর্থিকভাবে লাভজনক ও ব্র্যান্ডিং করতে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির ম্যানেজমেন্ট স্কুলের ইমেরিটাস অধ্যাপক ইগর সিচিন ১৯৮০ সালে অর্গানাইজেশন কালচার বিষয়ে একটি মডেল প্রণয়ন করেন। মডেলটির তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে হচ্ছে মানুষের ভেতর লুক্কায়িত বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা আর শেষ ধাপ হচ্ছে মানুষের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে অবলোকন করা।
উড়ালসেতু, ভবন বা যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ কর্তৃপক্ষ কিংবা কলকারখানার কর্তৃপক্ষের নিয়ম-নীতি মানার কোনো মনোবৃত্তি নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোয় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, দক্ষ জনবল নেই, দায়িত্বশীলতা ও জনগণের প্রতি সেবার মনোবৃত্তি নেই। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ নখহীন বিড়ালের মতো কাজ করছে। আর কত দুর্ঘটনা দেখব? কত মৃত্যুর মিছিল দেখব? কত অব্যবস্থাপনা দেখব? এই সব দুর্ঘটনার শতকরা ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভেতর সেফটি কালচার থাকে।
এটিকে আইসবার্গ থিওরি বলা হয়। অর্থাৎ মানুষের আশি শতাংশ বৈশিষ্ট্যই ভেতরে লুক্কায়িত থাকে আর বিশ শতাংশ বৈশিষ্ট্য আমরা কেবল দেখতে পাই। ইগর সিচিনের অর্গানাইজেশন কালচারই সব ম্যানেজমেন্ট স্কুলে পড়ানো হয়। সেই অর্গানাইজেশন কালচার থেকেই আবার সেফটি কালচার তৈরি হয়েছে এবং এটিরও একইভাবে তিনটি ধাপ রয়েছে। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর থেকেই মূলত সেফটি কালচারের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এখন সব জায়গায়ই সেফটি কালচারের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। সেফটি কালচার কোনো কারিগরি বিষয় নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। সেফটি কালচারের ওপর নির্ভর করছে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাবিষয়ক কার্য সম্পাদনের দক্ষতা ও সুরক্ষা।
সেফটি কালচারের সাতটি নীতির মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হচ্ছে—প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি সেফটি কালচার থাকবে; অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ নিয়ামক দ্বারা সেফটি কালচার সবাইকে প্রভাবিত করবে; সেফটি কালচার সময়ের সঙ্গে পরিবর্তশীল হওয়ায় এটিকে নিয়মিতভাবে তদারক ও মূল্যায়ন করতে হবে; প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জনে বাধা ও ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করে তদানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থাপককে প্রথমে সেফটি কালচার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে হবে এবং সব কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। ব্যবস্থাপকের মাধ্যমেই তাঁর অধীনস্থ কর্মীদের উৎসাহী করে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কি না, তা বিবেচনায় নিতে হবে এবং নিরাপত্তাকে দুর্বল করে এমন কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
তাহলে প্রতিষ্ঠানে সেফটি কালচার আছে কি না, তা বুঝব কেমন করে? প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত সভায় নিরাপত্তাবিষয়ক আলোচ্যসূচি আছে কি না, কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা, যন্ত্রপাতির সুবিধা, যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট, সেফটি কমিটি গঠন, তাদের কার্যক্রম তদারক, রীতিমতো প্রশিক্ষণ প্রদান করছে কি না, মহড়া করছে কি না ইত্যাদি।
সেফটি কালচার জরিপ, সাক্ষাৎকার, কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণসহ চারটি পৃথক পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করতে হয়। প্রতিটি পদ্ধতিতে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে প্রতিষ্ঠানের ভালো ও দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই হয়ে উঠবে সফল ও নামীদামি। সেফটি কালচার পালন যে শুধু কলকারখানার মালিকপক্ষই করবে, তা কিন্তু নয়। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকেও সমানভাবে পালন করতে হবে। উভয়ের ভূমিকাই তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকপক্ষেরই সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আজ দেখতে পাই, উড়ালসেতু, ভবন বা যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ কর্তৃপক্ষ কিংবা কলকারখানার কর্তৃপক্ষের নিয়ম-নীতি মানার কোনো মনোবৃত্তি নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোয় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, দক্ষ জনবল নেই, দায়িত্বশীলতা ও জনগণের প্রতি সেবার মনোবৃত্তি নেই। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ নখহীন বিড়ালের মতো কাজ করছে। আর কত দুর্ঘটনা দেখব? কত মৃত্যুর মিছিল দেখব? কত অব্যবস্থাপনা দেখব? এই সব দুর্ঘটনার শতকরা ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভেতর সেফটি কালচার থাকে। সেফটি কালচার পুরোপুরিই মানুষের কর্মদক্ষতা, সচেতনতা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়মনীতি মানার ওপর নির্ভরশীল। বাকি বিশ শতাংশ যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। যন্ত্র যতই ভালো হোক না কেন, মানুষ যন্ত্রের প্রতি সংবেদনশীল না হলে ভালো যন্ত্রও অকেজো হতে বেশি সময় লাগে না। সেফটি কালচার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থকড়ির প্রয়োজন পড়ে না। দরকার শুধু মন-মানসিকতার পরিবর্তন, সঠিক পরিকল্পনা ও তদানুযায়ী বাস্তবায়ন। অবকাঠামো নির্মাণ, কলকারখানা, সড়কপথ ও নৌপথে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার মনে হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ অধিদপ্তরসমূহ দিয়ে আর সম্ভব নয়। সময় এসেছে একটি পৃথক ও স্বাধীন নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কিংবা নিরাপত্তা কমিশন প্রতিষ্ঠা করা।
আমরা আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক দেখতে চাই না, পরিবারের সারা জীবনের জন্য কান্না শুনতে চাই না। নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ নৌযান ও নিরাপদ কলকারখানা—সর্বোপরি একটি নিরাপদ পরিবেশ দেখতে চাই।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম লেখক ও অধ্যাপক নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়