যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে মোদি-পুতিনের বন্ধুত্বের অর্থ কী

সম্প্রতি মস্কোয় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়ছবি: এএফপি

জুলাই মাসটা বিশ্বের জন্য ঘটনাবহুল বছর। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রার্থিতা, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা এবং গত সপ্তাহে ভারত-রাশিয়ার বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎ উল্লেখযোগ্য।

২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর এটাই মোদির প্রথম মস্কো সফর। এই সফরে রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০৩০ সালের ভেতর দুই দেশের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদিকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘অর্ডার অব সেন্ট আন্ড্রু’তে ভূষিত করা হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের এই অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো, কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন, পরবর্তীকালে রাশিয়ার সঙ্গে ভারত জোরালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। কাকতালীয়ভাবে ভারতের স্বাধীনতার সময়টা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার শীতলযুদ্ধ সূচনার সময়টা একই। এশিয়ার বড় শক্তি ভারত বৈশ্বিক পরাশক্তির দ্বন্দ্বে জোটনিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। তবে ভারতের জোটনিরপেক্ষ অবস্থান সব সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে খানিকটা ঝুঁকে ছিল, একমাত্র ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মূলত প্রতিরক্ষা খাত ঘিরে। ভারতের সামরিক শিল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। জ্বালানি, সন্ত্রাসবাদ দমন ও মহাকাশ গবেষণায় দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঘটনায় নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে ভারত চলমান যুদ্ধে রাশিয়াকে সহযোগিতা করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের সমালোচনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হয়ে ভারত হিংসার অবসান ও কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানায়। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলোতেও ভোট দানে বিরত থাকে ভারত। এ ছাড়া রাশিয়ার কাছ থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনছে ভারত।

রাশিয়ার সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ভারত কখনো পশ্চিমের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিত্যাগ করেনি। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির ওপর ভিত্তি করে ভারত পশ্চিমের দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোরালো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এখন বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে যা রপ্তানি করে, দেশটি থেকে তার দ্বিগুণ আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত থেকে মূলত ওষুধ, বস্ত্র, মূল্যবান সম্পদ ও কৃষিপণ্য আমদানি করে। আমেরিকার ২ শতাংশ নাগরিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক তাই যুক্তরাষ্ট্র ও এর পশ্চিমা মিত্রদের জন্য মাথাব্যথার কারণ।

রাশিয়ায় মোদির সাম্প্রতিক সফর নিঃসন্দেহে পুরোনো মিত্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রক্ষার অংশ ছিল। কিন্তু সেই সম্পর্কের ধারাবাহিক পরিবর্তন হচ্ছে। সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হতে থাকা সম্পর্ক নিয়ে ভারত চিন্তিত। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও বৈরিতার ক্ষতি কাটাতে বাণিজ্যক্ষেত্রে রাশিয়া অবশ্যই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। যা হোক, সেই নির্ভরতা চীনের ওপর অনেক বেশি।

বাণিজ্য, কূটনৈতিক ও সামরিক—তিন খাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাশিয়ার সঙ্গে চীনের জোরালো সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রাশিয়া এখন চীনের সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেলের জোগানদাতা। ব্রিকস ও সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন—এ ধরনের বহুপক্ষীয় রূপরেখার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। এটা ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই উত্তেজনায় ভরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সীমান্ত বিরোধ নিয়ে সেই সম্পর্ক আরও নিম্নমুখী হয়েছে।

এই আলোকে নরেন্দ্র মোদির মস্কো সফরের উদ্দেশ্য ছিল পুতিনকে এটা আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে ভারত রাশিয়ার পরীক্ষিত ও পুরোনো মিত্র। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার নির্ভরতা কমানোর এবং ভারত ও চীনের মধ্যে যেকোনো বিরোধের সময় রাশিয়ার সমর্থন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটিই ভারতের মূল চাবিকাঠি।

প্রকৃতপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্র খুব গভীরভাবে মোদির মস্কো সফর পর্যবেক্ষণ করেছে। রাশিয়া ও ভারতের বন্ধুত্বের বিষয়ে ওয়াশিংটন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, কৌশলগত দিক থেকে পশ্চিমের কাছে ভারতের গুরুত্ব বাড়ছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পরাশক্তির লড়াইয়ের’ আবহে ভারতের অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে ওয়াশিংটনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গত বছর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের সময় ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর তৈরির ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ঘোষণা করেছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডস উদ্যোগের বিপরীতে পশ্চিমা এই উদ্যোগ দুটির অবিচ্ছেদ্য অংশীদার ভারত।

পশ্চিমের বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষায় ভারতের ভূমিকার কথা বিবেচনা করে হোয়াইট হাউসের দিক থেকে ভারত-রাশিয়া সম্মেলন নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছিল। একই সঙ্গে এই আহ্বানও জানানো হয়েছিল যে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব খাটিয়ে ভারত যেন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নেয়।

বাস্তবে ভারত এমন কোনো কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে না যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বিপদে পড়ে।

  • জাইদ এম বেলবাগি, রাজনৈতিক ভাষ্যকার

আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত