তরুণ শিক্ষকেরা কেন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। একটু এদিক–সেদিক হলেই দেশজুড়ে সমালোচনা, সমাজের সব স্তর থেকে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া। পত্রিকার পাতায় ‘গণরুম’ নিয়ে শিরোনাম হয়, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থী যখন হলে এসে বলেন, ঢাকায় তাঁর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, পকেটে আছে এক শ টাকার নোট, সেই শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কীভাবে হলো, সে খবর কিন্তু পত্রিকায় আসে না।

শিক্ষকদের নিয়েও আছে অনুযোগ। শিক্ষক কেন ক্লাসে দেরি করে আসবেন, কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেবেন, কেন রাজনীতি করবেন ইত্যাদি অনুযোগের শেষ নেই। কিন্তু শিক্ষকেরাও এ দেশের আলো–হাওয়ায়, এ দেশের সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষ। শিক্ষকেরা তো সন্ন্যাসী নন, ধোয়া তুলসীপাতাও নয়। অন্য আর সবার মতো তাঁদের আবেগ-অনুভূতি আছে, মানবিক দোষ-ত্রুটি আছে, দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা আছে, আছে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা।

শিক্ষায় যে বাজেট থাকার কথা রাষ্ট্র থেকে, সেটি দেওয়া হয় না; গবেষণায় যে বরাদ্দ আছে, সেটি প্রয়োজনীয় বাজেটের ধারেকাছেও নেই; মানসম্পন্ন গবেষণা যে পর্যায়ে সম্ভব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে স্নাতকোত্তর পর্যায় নিয়ে পরিকল্পনা বা অবকাঠামো কখনোই পর্যাপ্ত ছিল না। তারপরও সবাই আক্ষেপের সুরে বলবে, কেন গবেষণা কম? কেন উদ্ভাবন কম? অবস্থা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ‘দামে কম, মানে ভালো’ কাকলি ফার্নিচারের মতো। বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকবে না, সেরা ফলাফল অর্জন করে এসেও মানসম্পন্ন জীবনযাপনের নিশ্চয়তা থাকবে না, কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার মান বজায় রাখার প্রত্যাশা ঠিকই পূরণ করে যেতে হবে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মানুষের এ অভিযোগগুলোই আসলে এর বড় শক্তি। এ বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে পড়লে, শিক্ষার্থীরা কোনো অপরাধে জড়িয়ে গেলে, শিক্ষকেরা ন্যায়সংগত কাজ না করলে, সমাজে সৃষ্টি হওয়া উদ্বেগ আর অস্থিরতাই প্রমাণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষ কতটা নিজেদের মনে করে। যেদিন আর মানুষের অভিযোগ থাকবে না, সেদিন বুঝতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মরে গেছে; জনগণ যেদিন এর পতন মেনে নেবে, সেদিন বুঝতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

কিছুদিন পরপর গণমাধ্যমে খবর আসে, ছুটি শেষে কাজে যোগদান না করার, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এতজন শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। প্রকৃত অর্থে এটি কি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের অব্যাহতি দিল নাকি তাঁরাই আসলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অব্যাহতি দিলেন, উপযোগী না হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন? 

তবে এটিও মানতে হবে যে শিক্ষকেরা শখের বশে শিক্ষকতা করেন না, এটি তাঁদের পেশাও বটে। তাঁদের জীবনযাপন, বর্তমান-ভবিষ্যৎ এ পেশায় থাকা সুবিধা-অসুবিধার ওপর নির্ভর করে। উন্নত বিশ্বে কোথাও যোগদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিমা বিশাল এক ভূমিকা রাখে। কোন কোন চিকিৎসার খরচ প্রতিষ্ঠান দেবে, পরিবারের অন্য সদস্যরা সেটি কী হারে পাবে ইত্যাদি নানান বিষয় বিবেচনায় থাকে।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিমার বিষয়টি এখনো অতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় পেনশনের বিষয়টি। কিন্তু সে সবেধন নীলমণি পেনশন নিয়েও বর্তমানে যে ধরনের পরিকল্পনা আলোচিত হচ্ছে, শিক্ষকেরা শুরু থেকেই যেটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন, তাতে করে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত হয়ে পড়বে।

প্রস্তাবিত ও বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। বলা হচ্ছে, বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকেরা এই কর্মসূচির আওতায় পড়বেন না। কিন্তু শিক্ষকদের প্রতিবাদ যতটুকু না তাঁদের নিজেদের পেনশনের অনিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে, তার চেয়ে বেশি ভবিষ্যতে যঁারা এই শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইবেন, তাঁদের অনিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে। অসন্তোষ থাকার পরও এই প্রত্যয় স্কিম শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে, নতুনেরা তো আগ্রহ হারাবেনই, পুরোনোদেরই নতুন করে চিন্তা করার সম্ভাবনা থাকে।

বর্তমান ব্যবস্থাতেই, নানা কারণে, অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। আমার নিজের ইনস্টিটিউটে, তুলনামূলকভাবে নতুন বিষয়, সফটওয়্যার প্রকৌশলের প্রথম ব্যাচের চারজন শিক্ষার্থী পরবর্তীকালে আমাদের সহকর্মী হিসেবে যোগদান করেন। তাঁদের দুজন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে এখন তাঁরা সেখানকারই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাকি দুজনের পিএইচডি চলমান। এমন না যে তাঁরা দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে চান না। চান, কিন্তু ওই যে বললাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রক্ত-মাংসের মানুষ, জীবন নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদেরও হিসাব-নিকাশ আছে, একটি রাষ্ট্র তার শিক্ষকদের সঙ্গে কী আচরণ করছে, সে ব্যাপারে তাঁদের পর্যবেক্ষণ আছে।

কিছুদিন পরপর গণমাধ্যমে খবর আসে, ছুটি শেষে কাজে যোগদান না করার, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এতজন শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। প্রকৃত অর্থে এটি কি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের অব্যাহতি দিল নাকি তাঁরাই আসলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অব্যাহতি দিলেন, উপযোগী না হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন? 

শুধু শিক্ষকেরা নন, সব পেশার মানুষেরাই সন্তুষ্ট থাকুক, সসম্মানে নিজেদের পেশায় নিয়োজিত থাকুক। কিন্তু একটি কথা ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই। প্রথম সারির মেধাবীরা যদি শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনার আমার সন্তানেরাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মই কিন্তু সর্বোচ্চ মেধাবীদের কাছ থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।

আবাদি জমি নষ্ট করে শহর বাড়ানো বাবুদের নিয়ে গাওয়া সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সে গানের মতো আবার না আমাদের বলতে হয়, ‘তখন কিন্তু কেঁদেও পাবে না একটু সবুজ ফিরে, ধানের বদলে দুলবে হাওয়ায় বিশ্রী নকল হিরে।’

ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

[email protected]