রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা মনে করেন, সামরিক বাহিনী তাদের জন্য অনেক কটি উদ্দেশ্য সাধন করে দিতে পারে। পুতিনের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী শুধু তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার নয়, ব্যক্তিগত সম্পদ তৈরিতেও এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়। তবে তিনি খুব ভালো করেই জানেন, সেনাবাহিনী তঁার ওপর কী ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর রুশ রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও সেটিকে নজরদারিতে রাখার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন পুতিন। সামরিক বাহিনীও এর বাইরে নয়। পুতিনের এই কৌশল কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়া ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অনড় ও অনমনীয় কমান্ড কাঠামোর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, অভ্যুত্থানের পথ বন্ধ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরোনো ঐতিহ্যের অবশেষ বজায় রাখা। রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পুনঃ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চলমান সংঘাতের গতিমুখ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে। এখন এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। রাশিয়া দাবি করেছিল, শুধু দনবাস অঞ্চলে মস্কো নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এখন মনে হচ্ছে, দনবাসে নয়, গোটা যুদ্ধেই পরাজয় ঘটতে পারে রাশিয়ার।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর এক গাদা সমস্যা সম্পর্কে সবাই আগে থেকেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু এরপরও ইউক্রেনীয় বাহিনী যে গতিতে তাদের ওপর পাল্টা আঘাত হেনেছে, তা অনেককেই বিস্মিত করেছে। সুনির্দিষ্ট করে বলতে, ইউক্রেনের অগ্রযাত্রার মুখে রাশিয়ার সেনানায়কেরা তঁাদের সেনাবাহিনীকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই মুহূর্তে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্ব বড় সংকটে পড়েছে। শুধু মাঠের দক্ষতা নয়, বৃদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে মাত করে দিয়েছে। খারকিভে ইউক্রেনের বাহিনীর সফলতার মূলে রয়েছে রুশ গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতারণা। এ কারণেই সংকটময় মুহূর্তে রাশিয়া তার সেনাবাহিনীকে পুনঃস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার এই পরাজয় নতুন আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র খুলে দিল। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সামর্থ্য সীমিত। এতে তারা কতটা অর্থপূর্ণ প্রতিরক্ষা তৈরি করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এ বিপর্যয়ে রাশিয়া ওই অঞ্চলে তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল রোমান বার্ডনিকভকে বরখাস্ত করেছে।
এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাঁর তিন সপ্তাহের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি হলো। রাশিয়ার এমন প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক হলেও এই সমস্যার মূল অনেক গভীরে। কারণ, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ‘সর্বাধিনায়ক’ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
রাশিয়ার সামরিক অবকাঠামো সরাসরি পুতিনের অধীনে। এর বেশির ভাগটাই ইউক্রেন আগ্রাসনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রাথমিক আগ্রাসন ছিল অত্যন্ত উঁচু মাত্রার।
রাশিয়ার চারটি সামরিক সদর দপ্তরের সব কটিই কমবেশি এতে অংশ নিয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিকতা প্রচুর সময়ক্ষেপণ ঘটিয়েছে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অংশ যেমন স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় প্রচণ্ড ভুগতে হয়েছে রুশ সেনাদের। বিপরীতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী অনেক বেশি নমনীয়, যখন যেটা প্রয়োজন সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে তারা সক্ষম।
মাঠের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কমান্ডারদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসহীনতা সম্মুখসারির সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেয়। এ পর্যন্ত শত্রুর গুলিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কমান্ডার হারিয়েছে রাশিয়া। কনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি আত্মবিশ্বাস না থাকায় তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত বলে মনে করা হয়নি। সে কারণে সেনাদের নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য জে৵ষ্ঠ কমান্ডাররা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেছেন। এ ক্ষেত্রে কার্যকর যোগাযোগপ্রযুক্তি না থাকায় জেনারেলদের সরাসরি শত্রুর গোলার মুখে পড়েছেন।
২০২২ সালে এসেও রাশিয়ার সেনাবাহিনী তাদের সোভিয়েত আমলের কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শীর্ষ থেকে আদেশ আসার বিষয়টি হায়ারার্কির (ক্ষমতার উচ্চক্রম) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটা খুব গভীরের সমস্যা, শিগগিরই এটি সমাধান করা সম্ভব নয়। খারকিভের সাম্প্রতিক বিপর্যয় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কমান্ড–সংক্রান্ত ব্যর্থতার ফল। এ ধরনের বিপর্যয় আগেও ঘটেছে। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের জন্য সংকটটাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। রাশিয়ার অনেক মানুষ এমনকি সেনাবাহিনীর জে৵ষ্ঠ কমান্ডাররা যুদ্ধের এই ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু সেই প্রশ্নকে ভুল সংশোধনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে নমনীয়তা ও স্বাধীনতার যে ঘাটতি, সেটি মোটেই আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং রাশিয়ার নেতৃত্বের মানসিকতার প্রতিফলন। সেনাবাহিনীর মধ্যে যাতে অভ্যুত্থান না হয়, তার প্রস্তুতি হিসেবে এটি পরিকল্পিতভাবে রক্ষা করা হয়েছে। এই কৌশল যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থতা ডেকে আনলেও ইউক্রেন যুদ্ধের বিপর্যয়ের ফলে রাশিয়াতে যে ঘটনাপ্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে, তার উত্তাপ থেকে সুরক্ষিত রাখছে পুতিনকে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● খ্রিস্টোফার মরিস টিচিং ফেলো, স্কুল অব স্ট্র্যাটেজি, ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ