চলমান গৃহযুদ্ধের মধ্যেই মিয়ানমারের ভূমিকম্প জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত জান্তা সরকারকে বিপজ্জনক ও অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এই ভূমিকম্পে রাজধানী শহর নেপিডোর সঙ্গে অন্য বড় শহর সাগাইং ও মান্দালয় যেভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার সঙ্গে কি জান্তা সরকারের পতন হবে?
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ভূমিকম্প উপদ্রুত এলাকাগুলোতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে, যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৫ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ৭১৫ জন। এ ছাড়া ৩৪১ জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ধারণা করা যায়, গত শুক্রবার রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার এ ভূমিকম্পে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা রাজনৈতিক প্রভাব ফেলবে সেই চিন্তা থেকেই অনেকটা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জান্তার সহযোগিতার (যে সহযোগিতা এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে শুরু করেছে) আবেদন সত্ত্বেও জান্তার সেনারা বিমান হামলা ও গোলা হামলা অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার একটি হাসপাতালেও হামলা হয়েছে। একটা অভূতপূর্ব দুর্যোগের মধ্যে এ ধরনের হামলা শক্তিমত্তা নয়, বরং দুর্বলতার লক্ষণ বলে মনে হয়। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের কবলে মিয়ানমারের জনগণ যখন আক্রান্ত হন, তখন জান্তা সরকারের নাজুকতা আরও বড় করে প্রকাশিত হয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক পরিবর্তন একটা দৃশ্যমান বাস্তবতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মূল ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে এমন একটি দেশে যেখানে সরকার অবৈধ অথবা সরকার পরিচালনার কাঠামোগুলো ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়ে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বারবার সামরিক শাসকদের কাঠামোগত দুর্বলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্রোহ, আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি ও দেশের ভেতরের অসন্তোষকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা অনেক সময় নিজেদের মধ্যে ফাটল ধরার পরও স্থিতিশীলতা দেখাতে চান। মিয়ানমারের জান্তা সরকার সামরিক মহড়া, কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং চীন ও রাশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে নিজেদের শক্ত অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
ভূমিকম্প-পরবর্তী একটা দৃশ্যপট যখন আসবে তখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তাদের আংশিক যুদ্ধবিরতি দ্রুত প্রত্যাহার করে নিতে পারে এবং দুর্বল হয়ে পড়া সামরিক শাসকদের রাজধানী নেপিডো এবং প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের দিকে অগ্রসর হতে পারে। ‘স্বর্গীয় অনুমোদন’ ধারণাটি বৌদ্ধ ও কনফুসিয়াস ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। এই মতবাদ অনুসারে একজন শাসকের বৈধতা তার শাসন পরিচালনার সক্ষমতা ও জনগণের মঙ্গল নিশ্চিতের ওপর নির্ভর করে।
প্রাক-আধুনিক চীনে রাজবংশীয় শাসকেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যথাযথ সাড়া দিতে না পারলে তাঁরা তাঁদের ম্যান্ডেট হারাতেন, পরিণতিতে তাঁদের পতন হতো। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারের জনগণ গভীরভাবে নিয়তিবাদী। সে কারণে একই ধরনের পরিণতি তারা এড়াতে পারে না।
বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়ই কর্তৃত্ববাদী শাসনের অক্ষমতাকে প্রকাশ করে দেয়। বিশেষ করে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সেটা দেখা যায়। ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসে মিয়ানমার লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। তৎকালীন জান্তা সরকার বিদেশি ত্রাণ সংস্থাগুলোকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। তারা ভয় পেয়েছিল আন্তর্জাতিক তদন্ত ও মার্কিন আক্রমণের। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবসৃষ্ট দুর্যোগে রূপ নিয়েছিল।
এবারের ভূমিকম্পের বিপর্যয়ও সেটার মতোই। এর আগে বন্যা, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে জান্তা সরকার যেভাবে বাজেভাবে পরিচালনা করেছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলা যায়, শুক্রবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ভাগ্যে চরমতম ভোগান্তি অপেক্ষা করছে। ২০০৮ সালের চেয়েও আজকের মিয়ানমার আরও বেশি বিভক্ত, সামরিক শাসকদের ক্ষমতার মুঠো আরও অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র মান্দালয় ও নেপিদো যাওয়ার পথগুলো সাম্প্রতিক বন্যা ও নতুন ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবকাঠামো এভাবে ভেঙে পড়া সশস্ত্র বিদ্রোহ গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটা আশীর্বাদ। বিশেষ করে আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সমন্বয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের জন্য।
এই গোষ্ঠীগুলো এরই মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সুসংহত আক্রমণ পরিচালনার সক্ষমতা দেখিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সাম্প্রতিক বিজয় ও জান্তা সরকারের কাছ থেকে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার মাধ্যমে তার প্রমাণ তারা দেখিয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আন্থনি ডেভিসের মতে, গেরিলা যুদ্ধ এমন এক পরিবেশে বিকশিত হয় যেখানে নিয়মিত বাহিনীর চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভূমিকম্পে পথঘাট ধ্বংস হওয়ায় এখন মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে বিমান হামলার ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হবে। কিন্তু জ্বালানির স্বল্পতা আর অন্যান্য লজিস্টিক সমর্থনের ঘাটতিতে সেটা টেকসই হবে না। এদিকে প্রতিরোধী বাহিনীগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত। বৈরী পরিবেশের সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে চলবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই যে তারা ভূমিকম্প উপদ্রুত এলাকায়গুলোতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাসে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সরবরাহ পথগুলো যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তাদের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি হো চি মিন ট্রেইল (ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনাম থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় জিনিসপত্র পৌঁছানোর জন্য যোগাযোগ নেটওয়ার্ক) ভিয়েত কং বা ভিয়েতনামি গেরিলাদের বিজয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
একইভাবে মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পাহাড়-বন পরিবেষ্টিত মিয়ানমারের বৈরী ভূখণ্ডের সুবিধা ব্যবহার করছে। ভূমিকম্প তাদের সেই সুযোগটা আরও বাড়িয়ে দেবে।
কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা অনেক সময় নিজেদের মধ্যে ফাটল ধরার পরও স্থিতিশীলতা দেখাতে চান। মিয়ানমারের জান্তা সরকার সামরিক মহড়া, কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং চীন ও রাশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে নিজেদের শক্ত অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
যাই হোক, ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারে যে বিদেশি সহায়তা আসছে তাতে করে জান্তা সরকারের প্রতি বিভ্রম ভেঙে পড়তে পারে। কেননা, বিদেশি ত্রাণ সহায়তা পরিচালিত হয় স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে। তারা নিরপেক্ষভাবে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক তদারকিটা বাড়ে।
ফার কিম বেং, ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার (আইআইইউএম) আসিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত