তফসিল ঘোষণার পর দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। যেমন মনে করা হয়েছিল, তেমন একটি পথরেখা ধরেই আওয়ামী লীগ এগোচ্ছে। তাদের পথটি হচ্ছে, যোকোনো মূল্যে একটি নির্বাচন করে ফেলা।
জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও কানাঘুষা দূর করেছে। কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বে নতুন জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বেশ চমক সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে বিএনপির জোট ভাঙা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে যে পর্যায়েরই হোক, বিএনপির কিছু নেতা ও ছোট কিছু দলকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নিয়ে তারা মাঠে সক্রিয় আছে। এই প্রক্রিয়ায় একই সঙ্গে ভয়ভীতি, প্রলোভনসহ সব কৌশলই কাজে লাগানো হচ্ছে বলে আলোচনায় আছে। এর বাইরে কিছু ‘কিংস পার্টি’ তৈরিই আছে। এসব উদ্যোগ কার্যকর করা এবং যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সমন্বিত (দলীয়, প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রযন্ত্রগত) শক্তি ও আর্থিক সামর্থ্য আওয়ামী লীগের রয়েছে।
তবে এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন। কারণ, আরও একটি একতরফা নির্বাচনের বোঝা বাংলাদেশ বইতে পারবে কি না, সেই সংশয় ও আলোচনা জোরালোভাবে উঠতে শুরু করেছে।
২.
রাজনীতি এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, বিএনপি এখন কী করবে? দলের শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাসহ হাজার হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। তড়িঘড়ি বিচার করে নেতাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা কার্যত ঘরছাড়া অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির জনসভা পণ্ড হওয়ার পর এ পর্যন্ত ছয় দফায় ১২ দিন অবরোধ এবং দুই দফায় ৩ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। আগামী রবি ও সোমবার আবার দুই দিনের অবরোধের ডাক দিয়েছে তারা।
এসব কর্মসূচিতে বিএনপিকে মাঠে দেখা যায়নি, অথবা তাদের মাঠে থাকতে দেওয়া হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি একের পর এক দুদিন করে হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচি দিয়েই যাবে? এ ধরনের আন্দোলনের পরিণতি কী? এর মাধ্যমে কি দাবি আদায় সম্ভব হবে?
বিএনপির ডাকা এসব কর্মসূচি কতটা সফল হচ্ছে বা আদৌ সফল হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। এতে সরকারি দল আত্মতৃপ্তি পেতে পারে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির জন্য এসব কর্মসূচি ক্ষতিকর। আর করোনার কারণে ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য হরতাল ও অবরোধ অনেকটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো।
প্রতিদিনই কিছু না কিছু যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। কারা এসব করছে, তা নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ও প্রশ্ন আছে। যেহেতু বিএনপির কর্মসূচির সময় এসব ঘটছে, তাই যারাই করুক না কেন, তার দায় বিএনপির ওপর গিয়েই পড়বে। বিএনপির জন্য ঝুঁকি হচ্ছে, সামনে কোনো ধরনের অঘটন ঘটলে তার দায় থেকেও দলটি মুক্তি পাবে না।
অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে আর পথ কী? বিএনপির কাছে বিকল্প কিছু আছে কি না জানি না। তবে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে বিবেচিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হারুন-অর-রশিদ মনে করেন, রাজনীতি দাবা খেলার মতো এবং সেখানে বিএনপি চালে ভুল করে বসে আছে। তাঁর মতে, এখন বিএনপির সামনে পথ হচ্ছে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া।
এমন একটি পরামর্শ মেনে নেওয়া বিএনপির পক্ষে কতটা সম্ভব? বিএনপির অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নির্বাচন ঠেকানোর সহিংস একটি আন্দোলন করে ২০১৪ সালে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আলোচনায় আছে যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল দেশি-বিদেশি কিছু বন্ধুর পরামর্শ ও আশ্বাসে এবং সেখানে সরকারি দলের তরফেও কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ও প্রাপ্তি বিবেচনায় নিলে আগামী ৭ জানুয়ারি বা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করা বিএনপির জন্য কতটা সহজ?
বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না, তারা জনগণকে তাদের কর্মসূচিতে শামিল করাতে ব্যর্থ হচ্ছে অথবা অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি কাজের কিছু নয়—এসব সমালোচনা দলটির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে। আবার বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়াও তাদের জন্য কঠিন। বিএনপির বিরুদ্ধে আরেকটি শক্তিশালী অভিযোগ হচ্ছে, তারা বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে আমেরিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এর সত্যতা নেই, এমন বলা যাবে না। সবকিছু মিলিয়ে অবস্থাটি বিএনপির জন্য বেশ বেকায়দার।
৩.
বিএনপির যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারত, চীন ও রাশিয়ার প্রকাশ্য সমর্থনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে কী হচ্ছে, তার বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি।
বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান ও নীতি নিয়েছে ভারত যে তার সঙ্গে একমত নয়, তা তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এর কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু এটা এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত আলাদা নীতি ও কৌশল নিয়ে চলবে।
বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে ভারত কোনো রাখঢাক ছাড়াই ভূমিকা রেখেছিল। পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং তখন ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন। এবার তাদের তৎপরতা তেমন প্রকাশ্য নয়। তবে তারা যে সক্রিয় তা বোঝা যায়। এবার দিল্লি থেকে কেউ আসেনি, কিন্তু জাতীয় পার্টির জি এম কাদেরকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি চুপচাপ ছিলেন। তাঁর দিল্লি সফরের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল, তা নিশ্চয় ইতিমধ্যে পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী দেশগুলোর অবস্থানের বিপরীতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার যে অবস্থান, তার হিসাব-নিকাশটি বেশ গোলমেলে। এখানে চীন সম্ভবত সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তারা বাংলাদেশকে রিজার্ভের অর্থ জোগানসহ নানা সহায়তার আশ্বাস দিয়ে রেখেছে। চীন জানে যে বাংলাদেশকে সহায়তা করার এই প্রতিযোগিতায় ভারত তার সঙ্গে পারবে না। এই বাস্তবতা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা বাড়তে পারে। তা ছাড়া চীন কোনো দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার যে কৌশল মেনে চলে, তাতে সব অবস্থায়ই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে। ফলে চীনের কোনো ঝুঁকি নেই।
কিন্তু ভারতের জন্য বিষয়টি সম্ভবত তত সহজ নয়। বাংলাদেশের অতিরিক্ত চীননির্ভরতা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের জন্যই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিরোধিতা করা এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব থেকে দূরে রাখা—এই দুরূহ কাজটি ভারত কীভাবে করবে?
আলোচনায় আছে যে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতিতে বদল এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন সরাসরি এ অঞ্চলে তার ভূমিকা রাখতে চায়, যা ভারত পছন্দ করছে না। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ভিন্ন অবস্থানের পেছনে এটাই কাজ করছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্র এতটা খোলাখুলি ও জোরালো অবস্থান নিয়েছে যে তাদের জন্যও এটা এখন যথেষ্ট স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান থেকে সরবে? নাকি সরার পথ নেই? সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু বা কী করবে? তার ফলাফলই–বা কী?
এসব প্রশ্নের উত্তরগুলো আমাদের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক এতগুলো শক্তির এতটা প্রকাশ্য অবস্থান ও তৎপরতা আগে দেখা যায়নি। এর পেছনে ভূরাজনীতির ভূমিকা রয়েছে ঠিকই কিন্তু দেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ ধারাবাহিকভাবে আমাদের রাজনীতিবিদেরাই তৈরি করেছেন।
৪.
ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের এক ওয়েবিনারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘বর্তমান সংকট সমাধানের কোনো উপায় আমি দেখছি না।’
আর কারও কাছে সংকট উত্তরণের কোনো উপায় বা পথ আছে কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থার মাত্রাটি কী, তা আমরা ধারণা করতে পারছি।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক