জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পরিবর্তনে অতি আশাবাদী কেউই হয়তো বিশ্বাস করতে চাননি, বিপ্লবের অসমাপ্ত অবস্থায়ই প্রতিবিপ্লব ঘটে অথবা সৃষ্টি হয় এমন এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি; সোজা বাংলায় যাকে বলে ‘নৈরাজ্য’।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থাকে কোন আয়নায় দেখব আমরা?লাগামহীন দাবিদাওয়া আর বিচ্ছিন্ন প্রতিক্রিয়ার সমাবেশ ও খণ্ড খণ্ড মিছিলের দাপটে নগরজীবন বিপর্যস্ত হতে দেখছি।
চট্টগ্রামে ইসকনের যুদ্ধংদেহী প্রতিবাদের মধ্যে এক আইনজীবীকে হত্যা করার ঘটনাও দেখলাম।
এসব ঘটনায় যার যার জায়গা থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য শ্রেণি–পেশার মানুষ।
তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? বিশেষ করে যখন নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আছে একাধিক পক্ষের টানাপোড়েন?
যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা দুঃখজনক। অনিশ্চয়তায় সরকারের প্রতি জন–আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম। ব্যবসা-বাণিজ্যে ভীষণ ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
তবে সব মিলিয়ে যদি শক্ত করে বলি, তাহলে বলব, এ অবস্থা খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না।
কেন এমন হলো তা নির্ণয় করতে গিয়ে ‘কুতুবদের’ বিভ্রান্ত দশা দেখে অবাকই হতে হচ্ছে।
অথচ বিপ্লব-পরবর্তী নৈরাজ্যের কারণ মোটামুটিভাবে রাজনৈতিক ইতিহাসের ‘টেক্সট বুক কেস’, যা এর ছাত্রদের মুখস্থ বলে দেওয়ার মতো বিষয়।
প্রথমত, অন্যায় সমাজ ও শাসনব্যবস্থা ভাঙা বিপ্লবের পর এত দিনের নিপীড়িত জনতা প্রতিবাদ ও দাবি উত্থাপনের উপলক্ষ খুঁজে পায়। দ্বিতীয়ত, বিপ্লবের সমর্থক কিছু ব্যক্তিও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ-সুবিধা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, এই সময়টাতে পরাজিত শক্তি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এবং অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালায়।
দেখুন তো, এ লক্ষণগুলো বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায় কি না?
তবে গোলমালের বিষয় হচ্ছে, বিপ্লব ও নৈরাজ্যের সম্পর্ক যেন শুভ এবং অশুভ শক্তির প্রতিনিধিত্ব করা দুই সৎভাইয়ের।
কোনো প্রচলিত পন্থায় মসনদে গেড়ে বসা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। ফলে ‘অপ্রচলিত পন্থা’ সক্রিয় হয়েছে।
সেই পন্থায় শুধু তাঁকেই উৎখাত করা হয়নি, ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মাধ্যমে তাঁর পুরো শাসনব্যবস্থাকেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট রাস্তায় নেমে এসে জাতি পরিবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
দৃশ্যপটে টমাস জেফারসন, মাও সে–তুং কিংবা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মতো নেতা সংগঠক ও বিপ্লবী দল না থাকলেও ২০২৪ সালের বাংলাদেশ যা দেখেছে, তা নতুন প্রজন্মের বিপ্লব।
ওই পরিস্থিতিতেও যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়নি, সেই কৃতিত্ব বাংলাদেশের জনগণের। পাঁচ লাখ মানুষ হত্যা করা হবে বলে আওয়ামী নেতারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
তাঁদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করেছে বিপ্লবের পক্ষের মানুষ, নৈরাজ্যবাদীরা নয়।
যেহেতু কোটি মানুষ প্রতিদিন আন্দোলনের জন্য রাস্তায় নামে না, তাই পরবর্তী অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় অগ্রিম ব্যবস্থা নিতে (বা সে কথা বলতে) পারতেন অগ্রবর্তী গোষ্ঠী, ক্ষমতাধর ব্যক্তি, প্রভাবশালী সুশীল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের কর্ণধারেরা এবং অবশ্যই প্রশানযন্ত্র।
জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে অনেক ভদ্রলোক বিপ্লব বলতে দ্বিধান্বিত; সম্ভবত এই ভয়ে যে বিপ্লবের কাছাকাছিই অবস্থান করে নৈরাজ্য এবং তাতে রাষ্ট্র এবং নেতৃত্বের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
যাহোক, বিপ্লবের পরের প্রথম দুটি সম্ভাব্য অবস্থা অর্থাৎ যাচ্ছেতাই প্রতিবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর কারও কারও হালুয়া-রুটি দখলের প্রতিযোগিতা অকেজো করতে সরকারের শক্ত অবস্থান এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট ছিল।
তৃতীয় শঙ্কাটি হলো পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ। এই শঙ্কা কীভাবে রোধ করা যায়, তা নিয়ে অধিক প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতা ও তাঁদের সহযোগীদের এতটা বিপুল অবৈধ অর্থ এবং দেশি, বিদেশি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে যে তাঁদের জন্য নৈরাজ্য সৃষ্টি করা খুব কঠিন কাজ নয়।
ফ্যাসিবাদী শক্তি বা আর যারাই নাশকতা করুক, তারা কিন্তু পরিবর্তনের বিপক্ষেরই শক্তি, অন্য কথায় প্রতিবিপ্লবী। বিপ্লব-পরবর্তী সামাজিক অস্থিরতার সুযোগ নিতেই চাইছে তারা।
তাদের তৎপরতায় ‘নগর পুড়িলে’ দেবালয় এড়ানো যাবে না।
সুতরাং ইউনূস সরকারকে এখন ভালো করে দেখাতে হবে যে বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো কোন ম্যান্ডেট তাকে দিয়েছে এবং জনগণের ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের হাত কতটা লম্বা হতে পারে।
জনপ্রশাসন ইতিমধ্যেই সুসংহত এবং স্থিতিশীল হওয়া উচিত ছিল। যাঁরা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের সহযোগী ছিলেন, তাঁরা তো মনস্তাত্ত্বিকভাবেই পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করতে অপারগ হবেন।
আমলাতন্ত্রে বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হলেও সবাই ন্যায়বিচার পাননি এবং ক্ষেত্রবিশেষে যোগ্য এবং গণমুখী হিসেবে প্রমাণিত কর্মকর্তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে দলাদলির কারণে। কার্যকর জনপ্রশাসন ছাড়া সরকার কাজ করবে কীভাবে?
অনুমান করা যায়, নৈরাজ্য সৃষ্টিতে অবৈধ অর্থ ব্যবহৃত হয় এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে। তাই এই অর্থ উদ্ধার করা আবশ্যক।
যৌথ বাহিনীর অংশগ্রহণে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সিভিল সোসাইটি এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত টিম অবৈধ অর্থ, সম্পদ, বাড়ি, জমি—এসব চিহ্নিত এবং তালিকা করে সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে পারে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ও গণতন্ত্রের চেতনায় বিশ্বাসী, বাংলাদেশকে ভালোবাসা, রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন কিছু কাজের মানুষের কাছ থেকে প্রধান উপদেষ্টার উপদেশ নেওয়ার সুযোগ আছে। সরকারের এযাবৎকালের উদ্যোগগুলো ও ফলাফল পর্যালোচনা করা এবং কার্যকর ও কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উত্তরণে নিজস্ব দিকনির্দেশনা ঠিক করা হলে কাজ করতে সুবিধা হবে। সাম্প্রতিক নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে ইউনূস সরকারের জন্য ‘ঘুম ভাঙানোর ডাক’।
৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোট বাতিল করে ঘরে বা গোপন আস্তানায় বস্তা ভরে রাখা অবৈধ টাকার মজুতকে অকেজো করে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, দুষ্টু লোকেরা শাস্তির ভয়ে সেই বাতিল নোটের বদলে নতুন নোট নিতে হয়তো ব্যাংকেই আসবে না।
এই হারিয়ে যাওয়া নগদ অর্থের পরিমাণ যদি হয়, ধরা যাক, ৬০,০০০ কোটি টাকা—সরকার এই পরিমাণ নতুন নোট ছেপে তরুণ উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও ‘ফ্রেশ ব্লাড ইনজেকশন’ করা হলে ভালো ফল আসতে পারে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ও গণতন্ত্রের চেতনায় বিশ্বাসী, বাংলাদেশকে ভালোবাসা, রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন কিছু কাজের মানুষের কাছ থেকে প্রধান উপদেষ্টার উপদেশ নেওয়ার সুযোগ আছে।
সরকারের এযাবৎকালের উদ্যোগগুলো ও ফলাফল পর্যালোচনা করা এবং কার্যকর ও কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উত্তরণে নিজস্ব দিকনির্দেশনা ঠিক করা হলে কাজ করতে সুবিধা হবে।
সাম্প্রতিক নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে ইউনূস সরকারের জন্য ‘ঘুম ভাঙানোর ডাক’।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল এ দেশে, তা রাজনৈতিক শক্তির সহযোগিতা এবং জনগণকে নিয়মিত অবহিত রাখার মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে নেওয়া সম্ভব।
অস্থির লোকদের একটু বোঝা দরকার, সাময়িক অস্থিরতা প্রমাণ করে না, অপকর্মের সেঞ্চুরি করা হাসিনার শাসন কোনো অর্থেই কাম্য ছিল।
বরং যদি পড়তে পারি, বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনের ভাষা হতে পারে এ রকম—জুলাই-আগস্টের পরিবর্তন যে নতুন পরিবেশ ও সুযোগ তৈরি করেছে, আমরা তা হারাতে প্রস্তুত নই।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক।