বিবিসি বাংলা: বিদায় রেডিও, স্বাগত নয়া মাধ্যম

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও সূর্য অস্ত যায়...

প্রবাদ ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। তেমন সুদিন গত হবে, এ কথা কেউ কি ভেবেছিল! সময় এমনই। বিস্ময়ে ভরপুর। দুনিয়াব্যাপী, ব্রিটিশদের ‘জমিদারি’ (উপনিবেশ) আর নেই। শুধু কি তাই! রাজপরিবারের রিজিডিটি বা কট্টরপনায়ও এসেছে বদল। পুরোনো ঐতিহ্য ভেঙে রাজপরিবারে, বধূ হয়ে এসেছেন এক কৃষ্ণকলি। এককালের পদানত উপনিবেশেরই এক অশ্বেতাঙ্গ আজ খোদ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। সময়ে কত কিছুই বদলায়!

সময়ের ঘাত মেনেই বন্ধ হয়ে গেছে বিবিসি বাংলার রেডিও সার্ভিস। ২০২৩ সালের পয়লা দিন থেকে, ‘আপনারা শুনছেন বিবিসি বাংলা’ আর শোনা যাচ্ছে না। ২০২২ সালে ৩১ ডিসেম্বর রাতের অধিবেশন ‘পরিক্রমা’ ছিল বেতারের শেষ আয়োজন।

বিবিসি বাংলা রেডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রোতাদের মন খারাপ। অনেকেই খুব আবেগতাড়িত হয়েছেন। রেডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে ব্যথিত হয়েছেন শ্রোতা ফেরদৌসি বেগম। চার প্রজন্ম ধরে বিবিসি শোনার অভ্যাস ছিল তাঁদের। সে কথা জানিয়ে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই খবরটায় মন খারাপ ছিল অনেক। দাদা, আব্বা, আমি, আমাদের পরের প্রজন্ম বিবিসি বাংলা রেডিও শুনতাম। কী হলো, কেন হলো, জানি না।’

ফেরদৌসি একা নন। এমন আরও অগুনতি শ্রোতা, বিবিসি বাংলা রেডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে ব্যথিত ও বিস্মিত হয়েছেন।

বিবিসি রেডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বাধীন সাংবাদিকতায় এর প্রভাব পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো শ্রোতা। আবার কেউ বলেছেন, রেডিও বন্ধ হয়ে গেলে বিবিসি বাংলার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আস্থা আর আগের মতো থাকবে না। এই উদ্বেগ আর আশঙ্কা কতটুকু সত্য? সময়ই তার জবাব দেবে। বিবিসি বাংলা বেতার কেন বন্ধ হয়ে গেল, আমরা বরং সেটা অনুসন্ধান করি।

ওই নতুনের কেতন ওড়ে: ডিজিটাল ভবিষ্যৎ...

বিবিসি বাংলার সর্বশেষ রেডিও অনুষ্ঠান পরিক্রমায় যোগ দিয়েছিলেন, বিবিসি বাংলা সার্ভিসের বর্তমান প্রধান সাবির মুস্তাফা। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মানসী বড়ুয়া মুস্তাফাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কখন প্রথম বুঝতে পারলেন বা আঁচ করলেন যে, বিবিসির রেডিও সার্ভিস একসময় বন্ধ করে দিতে হতে পারে?’

উত্তরে মুস্তাফা বলেন, ২০০১ সালের দিকে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ডিজিটালের দিকে জোর দেওয়া শুরু করে। তখন স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, রুশ, উর্দু ও হিন্দি ভাষা বিভাগের ডিজিটাল সার্ভিসকে জোরদার করার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘সেখান থেকে আমরা একটা আঁচ পাচ্ছিলাম যে ওই দিকেই হয়তো ভবিষ্যৎটা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এবং যে বাংলাভাষী অঞ্চল আছে ভারতে, দক্ষিণ এশিয়ায় সেখানে ইন্টারনেট পেনিট্রেশন বা ইন্টারনেটের সম্প্রসার অত বেশি ছিল না। এ জন্য বাংলা ভাষাকে ওইভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।’

বিবিসি বাংলা রেডিওতে ডিজিটাল দুনিয়ার ধাক্কাটা তখনো লাগলো না। বরং বাংলা রেডিও আরও জোরেশোরে এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। ২০০৭ সালে এক শ্রোতা জরিপে বিবিসি দেখতে পায়, তাদের শ্রোতাসংখ্যা শুধু বাংলাদেশেই সপ্তাহে প্রায় দুই কোটির কাছাকাছি। ২০০৭ সালে বিবিসি বাংলা আরও একটা নতুন রেডিও অনুষ্ঠান চালু করে। পরে এটার নাম হয়, ‘প্রত্যুষা’।

আরও পড়ুন

রেডিও যে হুমকির মুখে, সেটা কিন্তু ২০০৭ সালেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। সাবির মুস্তাফার ভাষ্যমতে, “২০১০, ’১১, ’১২, ’১৩ সালে এসে আমরা বুঝতে পারলাম যে এখন আমাদের রেডিও থেকে সরে ডিজিটালের দিকে জোর দেওয়া উচিত।’ কারণ, তখন বাংলাদেশে ইন্টারনেট এবং মোবাইল ইন্টারনেট খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছিল। আর অনেকেই তখন নিউজের চাহিদা মেটানোর জন্য ইন্টারনেটের যেসব পাবলিকেশন আছে, সেগুলোর দিকে যাচ্ছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

‘সে কারণেই আমরা ২০১৪ সাল থেকে কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের যত নতুন বিনিয়োগ সব... এই ডিজিটালের দিকেই করেছি। এবং মাঝেমধ্যে রেডিও থেকে কিছু বিনিয়োগ কমিয়ে সেগুলো ডিজিটালের দিকে নিয়ে গেছি” বলছিলেন সাবির মুস্তাফা। কিন্তু পরিবর্তনের এই কাজটা খুব ধীরে করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ব্যাপক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

এর ফলেই বিবিসি বাংলার রেডিও অনুষ্ঠান বন্ধ করে পুরোটাই ডিজিটালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ বন্ধের সিদ্ধান্তটা বিবিসি বাংলা থেকে আসেনি। এসেছে কেন্দ্র থেকে।

ডিজিটাল দুনিয়ায় কিছুই আর আগের মতো থাকছে না। লিগ্যাসি মিডিয়া বা সাবেকি গণমাধ্যমগুলো সারা বিশ্বেই চ্যালেঞ্জে পড়েছে। বাঁচার তাগিদে নিজেদের কনটেন্ট উপস্থাপনে প্ল্যাটফর্মে বদল আনছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ইউটিউবে, ফেসবুকে নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এমনকি টিভি চ্যানেলগুলোও নিজেদের নামে অনলাইনে নিউজ ওয়েবসাইট চালু করতে বাধ্য হয়েছে। পত্রিকার বাস্তবতাও তা–ই।

বলা ভালো, পত্রিকার ওপর চাপ আরও প্রবল। পত্রিকাগুলো বাঁচার তাগিদে অনলাইনে অধিক মনোযোগ দিয়েছে। অনলাইনের জন্য আলাদা টিম করেছে। ফেসবুকে নিজেদের লাইভ অনুষ্ঠান করছে। ফলে নিউ মিডিয়ার এই নয়া জামানায়, রেডিও-টিভি-অনলাইন সব একাকার হয়ে যাচ্ছে।

বাঁচতে হলে জানতে হবে...

পরিবর্তিত বাস্তবতায় গণমাধ্যমগুলোকে টিকতে হলে জানতে হবে বাঁচার তরিকা। সেই তরিকাই বেছে নিয়েছে বিবিসি বাংলা সার্ভিস। তারা রেডিও থেকে সরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মনোযোগ দিয়েছে। এ লেখার আগেই জেনেছি, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সপ্তাহে প্রায় দুই কোটি শ্রোতা ছিল বিবিসির। তখন শ্রোতাসংখ্যা কেন এত বেড়ে গেল? পরে কেনই-বা কমতির দিকে গেল?

এরও স্পষ্ট কারণ আছে। ২০০৬-০৭ সালে ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকাল। রাজনৈতিক সংকট গণমাধ্যমকেও ছুঁয়েছিল। স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের বলার সুযোগ সংকুচিত হয়েছিল। সংকটে আবারও জনগণের তথ্য পাওয়ার নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে ওঠে বিবিসি বাংলা রেডিও। এর আগে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে, ’৯০-এর গণ–আন্দোলনেও বিবিসি ছিল আস্থার প্রতীক।

২০০৭-এর সংকটময় সময়েও বিবিসি বাংলা সার্ভিসের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এটি কোনো বিজ্ঞাপন নেয় না। এর অর্থায়ন হয় ব্রিটেন থেকে। ফলে লাইসেন্স বাতিল করা, বিজ্ঞাপন বন্ধ করা বা জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে বিবিসিকে কুপোকাতের সুযোগ ছিল না। এ সময় বিবিসি এমন সব বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে, যা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পারেনি। সে জন্যই ২০০৭ সালের জরিপে বিবিসির এত শ্রোতা ছিল বলে ধারণা করা যায়।

আরও পড়ুন

এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচন হলো। দেশে এল নতুন সরকার। এল আরও অনেক নতুন গণমাধ্যম। এল ২৪ ঘণ্টার সংবাদ পরিবেশনকারী চ্যানেলও। এর পাশাপাশি দাবানলের গতিতে ছড়িয়ে পড়ল ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন। ফলে সংবাদ পাওয়ার জন্য মানুষের আর সেই সকাল-সন্ধ্যার অপেক্ষা রইল না। যখন প্রয়োজন তখনই হাতের মুঠোয়, স্মার্টফোনে, সংবাদ হাজির। এই প্রতিযোগিতায় বিবিসি রেডিওর পিছিয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

২০০৭–এর পর ২০১৮ সালে বিবিসি আরেকটি শ্রোতা জরিপ করে। এই জরিপে রেডিওর শ্রোতা কমে সাপ্তাহিক ২৬ লাখে নেমে যায়। ২০১৮ এর আগেও আরও দুটি জরিপ হয়। সেগুলোতেও শ্রোতাসংখ্যা বাড়ার কোনো ইঙ্গিত ছিল না। ২০১৮ সালেই বিবিসি বাংলার টেলিভিশন অনুষ্ঠান নিয়ে একটা জরিপ করা হয়। সেই জরিপের তথ্য ছিল আশা–জাগানিয়া। জানা যায়, সে সময় বিবিসি বাংলার টেলিভিশন দর্শক ছিল ৮৫ লাখ।

আরও জানা যায়, ২০২১ সালে বিবিসি বাংলার ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারকারী ছিল ৩৫ লাখের মতো। আর ২০২২ সালে বাংলাদেশে রেডিও, টিভি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে তাদের দর্শক-শ্রোতা-পাঠকসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। এই বিরাট সংখ্যার মধ্যে রেডিওর শ্রোতা যে সবচেয়ে কম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিবিসি বাংলা রেডিওতে আমি দুই পর্বে মোট ৯ বছর কাজ করেছি। কাজ করেছি জার্মান রেডিও ডয়চে ভেলেতেও। দুটি রেডিওই বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু কোনো সার্ভিসই সংবাদ প্রকাশে পিছিয়ে যায়নি। মোড়ক পাল্টে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তারা বরং আরও আটঘাট বেঁধে নেমেছে।

গণমাধ্যম পণ্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহান বলেছিলেন, মিডিয়াম ইজ দি মেসেজ। মানে মাধ্যমই বার্তা। প্রযুক্তির চাবুক খেয়ে সাবেকি মাধ্যমের প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রযুক্তির আশীর্বাদে অডিয়েন্স এখন আগের চেয়ে অনেক স্বাধীন। মাধ্যমও এখন একরৈখিকতা থেকে মুক্ত হতে বাধ্য। নইলে ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল শ্রোতা-দর্শককে পাওয়া যাবে না। গণমাধ্যমের দুনিয়ায় অডিয়েন্সই ঈশ্বর। ঈশ্বরের দেখা পেতে বিবিসি বাংলা রেডিও ছেড়ে পুরোপুরি ডিজিটাল হয়েছে। এতে আর ব্যথিত বা আশ্চর্য হওয়ার কী আছে!

  • আফরোজা সোমা কবি, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক।