ইউনূস সরকারের ১০০ দিনে জনমনে আস্থা ফিরল কতখানি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শপথগ্রহণ। ৮ আগস্টফাইল ছবি

স্বৈরাচারের বাংলাদেশি আইকন দেশ ছেড়েছেন সেই গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের উত্তাল দুপুরে। তবু পুরোপুরি স্বস্তি আসেনি সমাজে। রাষ্ট্রীয় জীবনের আত্মবিশ্বাসও ফেরেনি।

তা না হলে দৃশ্যত দিল্লি থেকে ফ্যাসিবাদী ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ‘ফাঁস’ করা টেলিফোন কথোপকথনের হুমকিতে সারা দেশ কাঁপে কী করে? প্রশাসন তটস্থ, জনগণ অস্থির হয়ে পড়ে কেন?

দেশের মানুষ আওয়ামী আমলের গোষ্ঠীপ্রীতি থেকে কতটা মুক্তি পেল এবং অতঃপর তারা বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক সুযোগ পাওয়ার সুযোগ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পাচ্ছে কি না, সে মূল্যায়নের সময় কিন্তু এসে গেছে।

৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার প্রথম ১০০ দিনে কী করতে পারল না পারল, তার নির্মোহ আলোচনা তুললে আবার কেউ কেউ বলে বসতে পারেন, তাহলে তো হাসিনা আমলেই জনজীবনে অধিক মাত্রায় শৃঙ্খলা ছিল।

অতি খাঁটি কথা! তবে ঠিক বিপরীত অর্থে: প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে যা চলছিল, তা স্থিতিশীলতা নয়, ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতিতে গড়া অপশাসনের শৃঙ্খলা (পড়ুন, শৃঙ্খল)।
ওই ব্যবস্থার প্রতি ন্যূনতম গণ-আস্থা থাকলে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে তা খান খান হয়ে যেত না।

তারপরও এখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনার ‘স্মৃতি কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে’। তাঁর আমলের যত কেলেঙ্কারি এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার শহীদ ও তাঁদের পরিবারের গল্প রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গলা ছেড়ে বলছে না কেন, যাতে কালেকটিভ মেমোরিতে জারি থাকে!

দুঃশাসনের ভূত বর্তমান ও পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে তাড়া করতেই থাকবে, যদি না হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতির দৈত্যকে কলসিতে ভরে সাগরের তলদেশে রাখা হয়।

অবশ্য মেয়াদ স্বল্প বা দীর্ঘ যা-ই হোক, বিপ্লবের আগে-পরের দুই সরকার ও শাসকদের পারফরম্যান্সের তুলনা করা যেতেই পারে ‘যদি কিছু মনে না করেন’।

গণবিরোধী ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার, হত্যা ও গুম, জুলুমশাহি, গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, ভোট চুরি, রাজনৈতিক সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থান নষ্ট—এসব কাজ কোন আমলে সংঘটিত হয়েছে?
মানুষের ধারণা ও বোঝাপড়া, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত ও ন্যায়পরায়ণতার সূচক দিয়ে যে কেউ এটা বিশ্লেষণ করতে পারেন।

হাসিনা এখন অতীত। তাঁর শাসনামলে হারিয়ে যাওয়া গণমানুষের আস্থা ও আশাবাদ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি নিয়েই ক্ষমতার দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।

মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও রক্ত ঝরার বেদনা বিপ্লবের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এই অভাবনীয় ঘটনার ফলে জনমনের প্রাথমিক স্বস্তি ইউনূস সরকারের জন্য ছিল সুবিধাজনক অবস্থান, কৃতিত্ব নয়।

একটি নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার পর সুষ্ঠু, কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সামনে।

করণিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এই সরকার কয়েকটি কমিশন গঠন, একঝাঁক নিয়োগ এবং ফ্যাসিবাদী হাসিনা ও তাঁর দোসরদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।

তবে এক দশকের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ সরকার ক্ষমতা সুসংহত করতে পেরেছে, এমনটা মনে হয় না। আমলাতন্ত্র ও বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা তার নজির।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সেবাপ্রাপ্তিতে দুর্নীতির উপস্থিতি এবং আওয়ামী আমলে অর্জিত অবৈধ অর্থসম্পদ উদ্ধারে ব্যবস্থা না নেওয়া, চলমান শাসনের বিচ্যুতিই প্রমাণ করে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যেমন খুব আস্থাশীল হওয়া মুশকিল, তেমনি উন্নতি দেখা যায় না ব্যবসায়িক পরিবেশেও যেখানে উদ্যোক্তা ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ হতে পারতেন ইতিমধ্যেই।

প্রধান উপদেষ্টা পদে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত ইমেজ বিশ্বকে মুগ্ধ করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কোনো পেশাগত বা একাডেমিক আলোচনা আমরা শুনলাম না।

শেখ হাসিনার পরাজিত ও ক্রুদ্ধ সমর্থকেরা প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচারী বা সংবিধানবহির্ভূত শাসক আখ্যা দিলে তাতে তাঁর ও বাংলাদেশের মানুষের অবাক ও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তাঁর সরকার রাজনৈতিক অনাস্থার মুখে যদি প্রস্থানের পথ খোঁজে, তাহলে তা জাতির জন্য অমঙ্গলেরই হবে।

হাসিনার স্বেচ্ছাচারী শাসনে যেহেতু বিজাতীয় শক্তিরও আশীর্বাদ ছিল এবং পররাষ্ট্রনীতি ছিল তাঁর পকেটে, তাই পরিবর্তনের বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক রিসেট করার জন্য জাতির অন্তর্গত তাগিদ ছিল।

যে আশা ও তার জন্য আত্মত্যাগের প্রতিজ্ঞা নিয়ে ছাত্র ও সাধারণ মানুষেরা দেড় দশকের উৎপীড়ককে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে, সেই জনগণের সঙ্গে সরকারি নেতৃত্বের সরাসরি সংযোগ বা সংলাপের কোনো আয়োজন এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ছিঁড়ে যাওয়া সামাজিক আবরু প্রতিস্থাপনের উদ্যোগও সেভাবে নেই।

ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। ইউনূস সরকারের উদ্যোগগুলো, বিশেষ করে সংস্কার কার্যক্রমকে, টেকসই বা কালজয়ী করতে হলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতিশ্রুতি ও অংশীদারত্ব অপরিহার্য।
এ ক্ষেত্রে, কমিউনিকেশন গ্যাপ বা কিছুটা অনিশ্চয়তা মানুষকে আশাহত করে।

প্রফেসর ইউনূসের সরকার, তাঁর উপদেষ্টাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যে শুধু অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দাপ্তরিক কাজ করবেন তা নয়; তাঁরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করবেন, এমনটাই কাঙ্ক্ষিত।

শেখ হাসিনার পরাজিত ও ক্রুদ্ধ সমর্থকেরা প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচারী বা সংবিধানবহির্ভূত শাসক আখ্যা দিলে তাতে তাঁর ও বাংলাদেশের মানুষের অবাক ও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তাঁর সরকার রাজনৈতিক অনাস্থার মুখে যদি প্রস্থানের পথ খোঁজে, তাহলে তা জাতির জন্য অমঙ্গলেরই হবে।

আমরা কি সংস্কারের সংস্কৃতিতে সংস্কৃত হব নাকি অগত্যা (কু) সংস্কারাচ্ছন্নই থেকে যাব, এমন দুর্ভাগা উভয় সংকটে যেন না পড়ি আমরা, আমাদের তরুণেরা। ফ্যাসিবাদের বিষবৃক্ষ ও তার ডালপালা গজানোর ভবিষ্যৎ সুযোগ থাকাটা মোটেও কাম্য নয়।

আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনূস সরকারের জন্য নিজেদের কর্মের মূল্যায়ন ও নতুন ভাবনা যুক্ত করাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঠিক করার পথে এই সরকার যদি রাজনৈতিক অংশীজনের সম্মতিসহ শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়, জনগণ আস্থা হারাবে না।

  • খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক।