ফৌজদারি অপরাধকে ‘রাজনৈতিক’ বা ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসেবে দেখার সুযোগ আছে কি?

‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র–জনতা’র বিক্ষোভকারীদের ওপর ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ এর হামলাছবি: প্রথম আলো

অন্তর্বর্তী সরকারের পুলিশ বাহিনী এ কারণে ধন্যবাদ পেতে পারে যে তারা ঘটনাকে পুরোপুরি আড়াল করেনি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটে। পতিত আওয়ামী লীগে নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে।

১০ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পুলিশের অনুসন্ধানের বরাতে জানানো হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘিরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রদায়িক কারণে। গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত এসব ঘটনা নিয়ে পুলিশের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের অভিযোগ ছিল, ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ১০টি। পুলিশ জানিয়েছে, এসব ঘটনার মধ্যে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার অভিযোগ এসেছে ১ হাজার ৭৬৯টি।

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ৭৬৯টি অভিযোগের মধ্যে ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগের অনুসন্ধান করেছে তারা। বাকি ৩৫৪টির অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান করা অভিযোগগুলোর মধ্যে ১ হাজার ২৫৪টির সত্যতা পাওয়া গেছে। বাকি ১৬১টির সত্যতা পাওয়া যায়নি। যে অভিযোগগুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১ হাজার ২৩৪টি (৯৮ দশমিক ৪ শতাংশ) ঘটনাই ঘটেছে ‘রাজনৈতিক কারণে’। ২০টি (১ দশমিক ৫৯ শতাংশ) ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রদায়িক কারণে।

পুলিশ বলছে, তারা ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট স্থান, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি প্রতিটি স্থান পরিদর্শন করেছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ৬২টি মামলা এবং ৯৫১টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।

তাদের ভাষ্যমতে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ১ হাজার ৭৬৯টি অভিযোগের মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট এক দিনেই ১ হাজার ৪৫২টি ঘটনা ঘটেছে, যা মোট অভিযোগের ৮২ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কে পুলিশ জানায়, ৫ আগস্ট থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশজুড়ে পুলিশের কাছে আরও ১৩৪টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অভিযোগ জমা পড়ে। তারা এগুলো গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে ৫৩টি মামলা ও ৫৩টি সাধারণ ডায়েরি নথিভুক্ত ও ৬৩ জন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলছে, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছে। সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরাও আছেন। এ ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, প্রান্তিক সম্প্রদায় ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর হওয়া সহিংসতার ঘটনার অভিযোগগুলোকে তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে উদ্যোগের অভাব ছিল।

সংবিধান সংস্কার কমিশন যখন রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, তখন ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নামের একটি সংগঠন সেই বহুত্ববাদকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের ওপর হামলা চালাল। আবার হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিক্ষোভকারীরা পরের দিন পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হলেন। এটা বহুত্ববাদী কিংবা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর লক্ষণ নয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ১০ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘৫ আগস্ট থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় দেশে মোট ৮৮টি মামলা করা হয়েছে ও ৭০ জন এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।’ এ ধরনের হামলা হয় সদলবলে, জোটবদ্ধভাবে। সে ক্ষেত্রে ৮৮টি মামলায় মাত্র ৭০ জন গ্রেপ্তার হওয়া যথেষ্ট নয়।

পুলিশের তদন্তে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা হলো, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িক নয়, ‘রাজনৈতিক’। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে হামলা হলেও তা অপরাধ। কারণ যাই হোক না কেন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা ফৌজদারি অপরাধ। যিনি হামলার শিকার হয়েছেন তিনি অপরাধী হলে আইনানুগভাবে তাঁর বিচার করতে হবে। পাল্টা হামলা হতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনার সংবেদনশীলতা রয়েছে এবং এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তির সম্পর্ক রয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও তা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করে।

পুলিশের তদন্তের বিষয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের একজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বললে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক হামলা বলে সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতনকে লঘু করে দেখছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে পর্যায়ক্রমে সংখ্যালঘুদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৪৩তম বিসিএস থেকে যে ১৬৮ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৭১ জন হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ ৪২ দশমিক ২৬ শতাংশ সংখ্যালঘু। অব্যাহতি পাওয়া ৩২১ জন এসআইয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১০৩ জন। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র এই অস্বীকৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কখনো নিজেদের নিরাপদ মনে করবে না।’

সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের কোনো সদস্য আওয়ামী লীগ, কোনো সদস্য বিএনপি, আবার কোনো সদস্য অন্য দল করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে তাঁরা একে অপরকে সহায়তা করেন। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সেই সুযোগ কম। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও আমরা দেখেছি, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ নেতারা এলাকা থেকে পালিয়ে গেছেন। আর সংখ্যালঘুরা মার খেয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বললে অনেকে ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণ দেন। কিন্তু অন্য দেশে সংখ্যালঘুরা মার খেলে সেই অজুহাতে এখানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন কোনোভাবেই জায়েজ হয়ে যায় না।

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ‘রাজনৈতিক’ বা যে কারণেই হোক না কেন সরকারের উচিত প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় সেই অপরাধের বিচার হবে। তাঁর ওপর বা বাড়িঘর-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয়ে হামলা হবে কেন? আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই। ফৌজদারি অপরাধ ‘রাজনৈতিক’ না ‘সাম্প্রদায়িক’—এই দৃষ্টিতে বিচার না করে আইনের দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন যখন রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, তখন ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নামের একটি সংগঠন সেই বহুত্ববাদকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের ওপর হামলা চালাল। আবার হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিক্ষোভকারীরা পরের দিন পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হলেন। এটা বহুত্ববাদী কিংবা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর লক্ষণ নয়।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক