সংবিধান অনুসারে আগামী তিন-সাড়ে তিন মাসের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন থাকলেও, নির্বাচন কমিশনের নানারকম প্রস্তুতির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, মতবিনিময় সভা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ রকম কিছু অনুষ্ঠানে এবং কখনো কখনো গণমাধ্যমেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বক্তব্য রেখেছেন। সিইসির এসব বক্তব্যে নানারকম প্রশ্ন তৈরি হয়েছে এবং একটি অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
গত ৪ অক্টোবর নির্বাচন ভবনে ‘অবাধ ভোটাধিকার, প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালায় সমাপনী বক্তব্য দেন সিইসি। সেখানে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের লিগ্যালিটি (আইনগত দিক) দেখবে, নির্বাচনের লেজিটিমেসি (বৈধতা/ন্যায্যতা) নিয়ে মাথা ঘামাবে না। (প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০২৩)
নির্বাচন নিয়ে সিইসির এ বক্তব্যকে হালকাভাবে নেওয়া বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাঁর বক্তব্য থেকে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, দেশে আরেকটি ‘একতরফা’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর এ কারণেই তিনি নির্বাচনের লেজিটিমেসি নিয়ে মাথা ঘামাতে চাচ্ছেন না, শুধু লিগ্যালিটি দেখবেন। ‘লিগ্যালিটি’ ও ‘লেজিটিমেসি’ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্ক আছে। যেহেতু বিষয়টি নির্বাচন, তাই সেই বিতর্কে না জড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এটা বিবেচনা করা যেতে পারে।
এরশাদ আমলে বাংলাদেশে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটি ১৯৮৬ সালে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৮৮ সালে। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই অংশগ্রহণ করেনি। দুটি নির্বাচনেই জাতীয় পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। এ দুটি নির্বাচন আইনগতভাবে সঠিক বা ‘লিগ্যাল’ হলেও এগুলোর রাজনৈতিক বৈধতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা, বেশির ভাগ বিরোধী দল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে মেনে নেয়নি। তারা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকারের অধীনে আরেকটি ‘একতরফা’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কয়েক দিনের মাথায় বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে সরকার পদত্যাগ করে। কারণ, সেই নির্বাচনেরও কোনো রাজনৈতিক বৈধতা ছিল না।
এ উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট যে, নির্বাচন শুধু আইনি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়, এর সঙ্গে রাজনৈতিক বৈধতার বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কেউ কেউ বলতে পারেন, ২০১৪ সালে ‘একতরফা’ এবং ২০১৮ সালে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরেও সরকারকে তো পদত্যাগ করতে হয়নি। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিবেচনা রাখতে হবে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণকে নিজের পক্ষে নিয়ে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা ধরে রাখলেই রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করা যায় না। জনগণের সত্যিকারের ম্যান্ডেট ছাড়া যারা এভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, ভবিষ্যতে কোনো না কোনো দিন তারা জবাবদিহির মুখোমুখি হবেন।
২.
গত ১২ অক্টোবর নির্বাচন ভবনের সভাকক্ষে তৃণমূল বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আয়োজিত এক বৈঠকে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সংসদ নির্বাচনে লাখ লাখ ভোটকক্ষ একজন মানুষের পক্ষে পাহারা দেওয়া সম্ভব না। এটা ফেরেশতারা পারে, আমরা পারব না। (দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড, ১২ অক্টোবর, ২০২৩)
ভোটকেন্দ্র ‘পাহারা’ দেওয়া নিয়ে সিইসির এ বক্তব্যটি খুবই ‘হতাশাজনক’। শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশন নয়, বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রশাসন ও পুলিশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে। নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন মনে করলে সামরিক-আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সুপারিশ করতে পারে। এরা সবাই মিলে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে-এটাই প্রত্যাশিত। এরপরও ভোটকেন্দ্রে অপ্রীতিকর কিছু ঘটতে পারে, যেটাকে ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু সিইসি নির্বাচনের আগেই যেভাবে এ ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রমকে ‘মেনে নিচ্ছেন’ বা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখাতে চাচ্ছেন, সেটা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, নির্বাচনের সময় পুলিশ, প্রশাসনসহ নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কথা। কিন্তু সিইসির বক্তব্য থেকে এমনটাই প্রতীয়মান হয়, তিনি এদের ওপর যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারছেন না। আর এ কারণেই তিনি ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়া নিয়ে নিজের ‘হতাশা’ বা ‘অপারগতা’ প্রকাশ করেছেন।
৩.
সিইসি সম্প্রতি বিবিসি বাংলা’কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। বিষয়টি তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘দুটো দল পাঁচটা দল, দশটা দল ছোট-খাট দল বাংলাদেশের বিভিন্ন দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে মূল বিরোধী দল যে বিএনপি তাদের সমকক্ষ ওরা নয়। এটা আমরা অস্বীকার করি না বা কেউ অস্বীকার করবে না...ওই দলটা যদি অংশগ্রহণ না করে তাহলে একটা অনিশ্চয়তা বা একটা শঙ্কা একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যেতে পারে এতে কোনো সন্দেহ নেই’। (বিবিসি বাংলা, ১২ অক্টোবর, ২০২৩)
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে সিইসির বক্তব্য ছিল যথেষ্ট যুক্তিসংগত এবং বাস্তবসম্মত। কিন্তু পরিহাসের ব্যাপার হলো কয়েক দিন যেতে না যেতেই তিনি তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেন। প্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে একটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে তিনি বলেন, কে এল কে এল না তা নয়, জনগণ ভোট দিলেই বড় সফলতা (প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর ২০২৩)
সিইসির এমন ‘স্ববিরোধী’ বক্তব্যে নানারকম প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাঁর বক্তব্যে দলীয় পক্ষপাতিত্বের প্রতিফলন হয়েছে। সাংবিধানিক সংস্থার প্রধানের এমন অবস্থান থাকলে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হবে, সেটা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়। (প্রথম আলো, ১৫ অক্টোবর ২০২৩)
শেষকথা
দেশের বেশির ভাগ বিরোধী দল মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। এ কারণে তারা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে সরকারের দাবি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু এ নির্বাচন কমিশন গঠনের শুরু থেকেই তা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন ছিল। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সাম্প্রতিক বক্তব্যে সেই প্রশ্ন ও বিতর্ক আরও বেড়েছে। এ রকম অবস্থায় শুধু সাংবিধান রক্ষার অজুহাতে আরেকটি ‘একতরফা’, ‘অসম্পূর্ণ’ এবং ‘ইললেজিটিমেট’ নির্বাচনই কি আমাদের ভবিতব্য?
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক