দাবির বন্যা সামলাতে সরকারকে যা করতে হবে

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা গোষ্ঠী দাবি দাওয়া নিয়ে সড়কে আন্দোলন করছেছবি : প্রথম আলো

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকারপ্রধান গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করেন। যদিও এর আগে দুজন রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় থাকাকালে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং বর্তমান সরকার—উভয়ের ছয় মাস পূর্ণ হলো।

এই ছয় মাসে সরকারের অন্য অনেক ডেবিট-ক্রেডিটের মধ্যে যে বিষয় সবচেয়ে লক্ষণীয়, তা হচ্ছে নানা শ্রেণি-পেশা ও গোষ্ঠীর স্বার্থকেন্দ্রিক (অ)শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়, যেকোনো দাবিতে গণজমায়েতভিত্তিক আন্দোলনের রাজনীতি এ সময়ে এক নতুন মোড় নিয়েছে। কারণে-অকারণে, যখন-তখন ঢাকায় এই গোষ্ঠীভিত্তিক আন্দোলন জনজীবনে অভিশাপ হয়ে আবির্ভূত হতে দেখা যাচ্ছে, যার বেশির ভাগেরই যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকে আন্দোলনের এই নতুন ঢেউকে বর্তমান সরকারের দুর্বলতা (ক্যাপাসিটি ট্র্যাপ) ও সমন্বয়হীনতা দিয়ে মূল্যায়ন করছেন।

কিন্তু এর পেছনে আছে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিশেষ করে বিগত সরকারের তথাকথিত ‘উন্নয়নতন্ত্র’ ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের সঞ্চিত বঞ্চনাবোধ ও অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ।

পতিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪–দলীয় জোট সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ছিল সীমাহীন। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জনগণের যেকোনো দাবিকে শেখ হাসিনার তুচ্ছজ্ঞান করা। উদাহরণ হিসেবে সর্বশেষ ২০২৪ সালে ১৪ জুলাই গণভবনে চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয় কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের বিরোধিতা করে আন্দোলনরত দেশের প্রায় সব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন, ‘তাঁরা আন্দোলন করে টায়ার্ড হলে তখন তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসব।’

অধিকন্তু, একই সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনার মন্তব্য কারোই অজানা নেই; মন্তব্যে তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’–এর সঙ্গে তুলনা করেন। এমনকি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের বেতনসংক্রান্ত দাবির আন্দোলন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে ‘মনে হচ্ছে, শিক্ষকদের বেতন একটু বেশি বাড়িয়ে ফেলেছি, তাই এখন তাঁরা সম্মানের প্রশ্ন তুলছেন।’

অন্যথায় আন্দোলনের নামে ‘মব জাস্টিস’-এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বদলে সমাজে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অতএব সরকারের শুধু দাবি মেনে নেওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং একটি কাঠামোবদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা চালুর মাধ্যমে সব ন্যায্য দাবির সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই জরুরি।

এ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক ও অপমানসূচক মন্তব্যে শুধু সাধারণ শিক্ষকসমাজই নয়, খোদ শেখ হাসিনার নিজ দলের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থকও বিরক্ত ছিলেন। যেহেতু তাঁর শাসনামলে প্রকাশ্যে সমালোচনা প্রায় অসম্ভব ছিল, তাই অনেককেই অপ্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যেত।

কিন্তু আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান সরকার রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়; বরং বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া একটা আপত্কালীন সরকার। ফলে একের পর এক, কারণে-অকারণে এরূপ অরাজনৈতিক আন্দোলন ও দাবি তোলার মাধ্যমে ঢাকার মতো এমন একটা প্রায় পরিত্যক্ত বসবাস–অযোগ্য শহরে অযাচিত যান চলাচল বন্ধ করে জনদুর্ভোগ বাড়ানো কতটা যুক্তিসংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সব মহলেই।

কথা সত্য যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দাবিভিত্তিক আন্দোলন বৃদ্ধির পেছনে বর্তমান সরকারের আন্দোলন মোকাবিলায় ব্যর্থতা স্পষ্ট। বিশেষ করে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সচিবালয় ঘেরাওয়ের পরপরই যখন সে সময় পর্যন্ত স্থগিত থাকা পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সেসব বিষয়ে পরীক্ষা ছাড়াই পাসের দাবি মেনে নেওয়া হয়, তখন এটি একটি খারাপ নজির তৈরি করে, যা অন্য অনেক ক্ষেত্রে আজ অবধি আন্দোলনের নেতিবাচক উদ্দীপনা (নেগেটিভ ডমিনো ইফেক্ট) দিয়ে যাচ্ছে।

এর পর থেকেই মূলত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ বিশেষত নিজ নিজ শ্রেণি ও গোষ্ঠীভিত্তিক দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। এসব জমায়েত গণ-আন্দোলনের মতো মনে হলেও আসলে এগুলো বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীভিত্তিক স্বার্থকেন্দ্রিক সুযোগের সদ্ব্যবহার, যার পেছনে একক কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা বা ঐক্যবদ্ধ গণদাবির কাঠামো নেই।

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, জনগণের মধ্যে একধরনের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে আন্দোলনে নামলেই দাবি পূরণ হবে। মূলত সরকারের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সর্বোপরি সমন্বয়ের অভাবই এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন খাতের আন্দোলন ও তা সামালে অপরিপক্ব দুর্বল প্রচেষ্টা, যা মূলত এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রধান কারণ।

বিশেষ করে কোনো আন্দোলন শুরু হলেই তড়িঘড়ি করে তা মেনে নেওয়ার প্রবণতা সরকারকে আরও দুর্বল করে তুলছে। জনগণের মনে যখন এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে রাস্তায় নামলেই দাবি আদায় হবে, তখন এ ধরনের জনদুর্ভোগ তৈরির মাধ্যমে আন্দোলন একটি অপকৌশলে পরিণত হয়।

এর ফলে যাঁরা ন্যায্য দাবির পক্ষে আন্দোলন করেন, তাঁদেরও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

আন্দোলনের সাংবিধানিক অধিকার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জনপরিসরে এর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একটি সুস্পষ্ট অবস্থান গড়ে উঠেছে, যা আন্দোলনকারীদের প্রতি নেতিবাচক ও তির্যক মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এ প্রবণতা সরকারের দুর্বলতার সুযোগে ঘটছে বলেই অনেকের অনুমান। কিছু ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর বিশেষ স্বার্থে অগণিত মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বঞ্চনাবোধ কিংবা বৈষম্যবোধ থেকে গোষ্ঠীগত আন্দোলনের নামে যদি প্রায় প্রতিদিনই জনদুর্ভোগ বাড়ে, তবে তা গণতান্ত্রিক অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে, যা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।

এ ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘মব জাস্টিস’-এর ধারণা প্রাসঙ্গিক। সংঘবদ্ধভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধের হুমকি, অধিকার আদায়ের নামে রাস্তাঘাট ব্যারিকেডের মাধ্যমে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে গোষ্ঠীগত দাবি আদায়ের চেষ্টা সুবিধাবাদেরই নামান্তর।

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হওয়া উচিত আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নির্ধারণ করা। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, আন্দোলন করলেই সব দাবি পূরণ করা হবে না। বরং কীভাবে সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনদুর্ভোগ না বাড়িয়ে দাবি উপস্থাপন করা যাবে, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। আন্দোলনের দাবি পূরণের জন্য যদি যথাযথ সংলাপ ও আলোচনা ফোরামের ব্যবস্থা থাকত, তবে দিন দিন পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে উঠত না।

বর্তমান সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতাও স্পষ্ট। যেনতেনভাবে সংস্কারের নামে কমিশন গঠন, শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা অসংগতি উপেক্ষা করা, শিক্ষাবিষয়ক কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না দেওয়া, স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের ব্যর্থতা, গণহত্যার বিচারে দীর্ঘসূত্রতার প্রকটতা, শুধু জনতুষ্টির জন্য স্বল্পমেয়াদি সমাধানের দিকে ঝোঁকা এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপের অভাব—এ সব কটি বিষয়েই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ইতিমধ্যে ম্লান করে দিয়েছে।

দেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ও সরকারের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ পরিস্থিতির জন্য উভয় পক্ষই কমবেশি দায়ী। একদিকে জনগণের বঞ্চনাবোধ, অসন্তোষ ও সরকারের প্রতি আস্থার অভাব আন্দোলনকে অনেকাংশে উসকে দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের অপরিকল্পিত ও দ্রুত আন্দোলনের দাবির প্রতি সংহতি আন্দোলনের মাত্রা ও সংখ্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে। যদিও আন্দোলনের সাংবিধানিক ভিত্তি রয়েছে, তবে একে সঠিক পথে পরিচালিত করা বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত।

অন্যথায় আন্দোলনের নামে ‘মব জাস্টিস’-এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বদলে সমাজে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অতএব সরকারের শুধু দাবি মেনে নেওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং একটি কাঠামোবদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা চালুর মাধ্যমে সব ন্যায্য দাবির সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই জরুরি।

ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।