উন্নয়ন অর্থশাস্ত্র, সরকারের দলিলপত্র, অর্থনীতিবিদদের কথা-লেখা-গবেষণা, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভাষ্য, সংবাদমাধ্যমের কথা ও বার্তা—সর্বত্রই দুটি কথা খুব শোনা যায়, ‘বিদেশি সাহায্য’ ও ‘দাতা সংস্থা’। দুটি পরিচয়ই ভুল। আসলে যাকে ‘বিদেশি সাহায্য’ বলা হয়, তা প্রধানত অন্য কোনো রাষ্ট্র বা বিদেশি কোনো সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ।
ঋণকে কেন সাহায্য বলা হবে? আমরা কি মহাজনদের ঋণকে সাহায্য বলব? কিংবা বর্তমানে কি আমরা অগ্রণী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক বা গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের ঋণ কর্মসূচিকে ‘সাহায্য কর্মসূচি’ বলি? কিংবা ঋণ দেয় বলে কি এসব সংস্থাকে দাতা বলা হয়? না। দাতা মানে হাতেম তাই, হাজী মুহম্মদ মহসীন, রণদাপ্রসাদ সাহা—তাঁদের বোঝায়। এসব সংস্থা কি তাঁদের মতো? না।
তাহলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএসএইডের ঋণ কেন ‘সাহায্য’, তারা কেন ‘দাতা’ বলে অভিহিত হতে থাকে? কেউ কেউ কিছু অনুদানের কথা বলবেন। সেগুলোও নিছক দান নয়, তার মধ্যে নানা কাহিনি থাকে, শর্ত থাকে, কেনাবেচার বিষয় থাকে।
আসলে এসব সংস্থার আদ্যোপান্ত না জানার জন্য কঠোর গোপনীয়তা আর অবিরাম প্রচারে এসব সংস্থাকে ‘মহান’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। মনে হয়, এসব সংস্থা বিনা স্বার্থে দেশে দেশে মানুষের কল্যাণে দান করে যাচ্ছে। এটি ভুল।
বস্তুত, সাহায্য নামের এসব ঋণ কর্মসূচি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখার অন্যতম শর্ত। এ ঋণের সঙ্গে সম্পর্কিত বহুজাতিক কোম্পানির সম্প্রসারণ, বিশ্বকর্তা রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য। এ ছাড়া তাদের বহু কর্মসংস্থানও এর ওপর নির্ভরশীল। প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ নানা কাজ চায় পরামর্শক সংস্থা। এসব ঋণে নানা জিনিস নির্দিষ্ট তালিকা অনুযায়ী কিনতে হয়। কম্পিউটার থেকে গাড়িসহ বহু ধরনের জিনিস বিক্রির সুযোগ পায় তালিকাভুক্ত বিক্রেতারা। প্রকল্পে নির্মাণকাজ যুক্ত থাকলে আরও ভালো, বড় কাজ পেয়ে যায় নির্মাণ সংস্থা।
আবার গ্রহীতা দেশে এসব ঋণ গ্রহণ করতে আমলা-মন্ত্রী-পরামর্শকদের অস্থির আগ্রহ। ঋণ প্রকল্পের সমীক্ষায় অংশীদার থাকে দেশি কিছু বিশেষজ্ঞ এবং কেনাকাটায় থাকে আমলা ও ব্যবসায়ী সংস্থা। শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-কেনাকাটায় বিদেশ সফর আমলা–মন্ত্রী–পরামর্শকদের বড় প্রাপ্তি। বিদেশ সফরের উপাদান না থাকলে ঋণের প্রকল্প পাস করাই কঠিন হয়। পুকুর কাটা দেখতে, গাছ কিনতে, শিক্ষাব্যবস্থা দেখতে, লিফট কিনতে কিংবা জানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ যাওয়ার চর্চা তো এমনি এমনি হয়নি।
ফিজিবিলিটি বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা একটা গালভরা নাম। এর সঙ্গে সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। সমীক্ষায় যদি দেখা যায় কাজটা করা যাবে না, তারপরও সংশ্লিষ্টরা চাইলে সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। বাংলাদেশের কৃষির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত বিদেশি বিশেষজ্ঞ হিউজ ব্রেমার নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন এভাবে: বাংলাদেশের আমলা-পরামর্শকেরা খুব সজাগ যে একটা সুখী সুখী রিপোর্ট দিলেই তাঁদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে।
অনেকে সরল বিশ্বাসে ভাবছেন, সরকার যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি আর সর্বজনের অংশগ্রহণ অস্বীকার করে জাতীয় বিপর্যয় তৈরি করছে, তখন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানের শর্ত সরকারকে এগুলো করতে বাধ্য করবে। প্রকৃতপক্ষে এসব সংস্থা যেসব শর্ত দেয়, তার দুটি অংশ আছে। একটি অংশ, যেটা তারা সংবাদমাধ্যম ও জনগণের জন্য জোরে জোরে বলে। কিন্তু এগুলো পূরণ না হলে তাদের কিছু আসে–যায় না, এগুলো তাদের আসল অ্যাজেন্ডাও নয়।
তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, চূড়ান্ত রিপোর্টে ‘উপযুক্ত নয়’ থেকে কীভাবে ‘নয়’ কেটে ‘উপযুক্ত’ বানিয়ে দিলেন সচিব! এতে এই বড় প্রকল্প পাস হয়ে গেল, কারও কারও লাভ হলো, কিন্তু ফলাফল হলো সর্বনাশা। বলাই বাহুল্য, এই অভিন্ন রোগে বিদেশি সুবিধাভোগী পরামর্শক ও ব্যবসায়ীরাও আক্রান্ত থাকে।
তাদের সুবিধা বেশি, ক্ষতি হলেও দায় নেই। ইউএনডিপির এক মূল্যায়ন রিপোর্টে অ্যালান লিন্ডকুইস্ট বিশ্বব্যাংক–এডিবির বিভিন্ন প্রকল্প পর্যালোচনা করে লিখেছিলেন, যোগ্যতা যা–ই থাকুক দেশিদের তুলনায় বিদেশি পরামর্শকদের বেতন ৬ দশমিক ৮ থেকে ২৫ গুণ বেশি হয়। আর দেশি প্রতিষ্ঠানের সমতুল্য কর্মকর্তাদের তুলনায় তা ৫৭ থেকে ৭৩ গুণ পর্যন্ত হয়। বিদেশি ঋণনির্ভর যেকোনো প্রকল্প পাস করতে তাকে লাভজনক দেখাতে হয়। সে কাজ দুই পক্ষ মিলেই করে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, কারিগরি সহায়তা অনেক সময় বৃহৎ একটা নকশা বাস্তবায়নের সূচনা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে এর বড় দৃষ্টান্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। এই খাতের উন্নয়নের কথা বলে ১৯৮২ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পথ হচ্ছে তা রপ্তানি করা, কেননা এত গ্যাস ব্যবহারের পথ বাংলাদেশে নেই! আর এই খাত উন্নয়নে ব্যক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ অবশ্যই যুক্ত করতে হবে।
এডিবিও এ রকম আরেকটি সমীক্ষা করে একই রকম সিদ্ধান্তে এসেছিল। ক্রমে এ ধরনের নীতি ও চুক্তিই করা হয়েছিল। শুধু জনপ্রতিরোধের কারণে রপ্তানি করতে পারেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি খাতে রূপান্তর—রাষ্ট্রীয় অপচয় ও উৎপাদন খরচ কমবে বলে বিশ্বব্যাংক দাবি করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এর ফলাফল দেখা যায় উল্টো—রাষ্ট্রের অপচয়, খরচ, ভর্তুকি, সবই কমার বদলে বাড়ে; গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হয়।
বাংলাদেশে মানুষ বেশি, জমি কম, নদী–নালা বেশি—এ কথা সবাই জানে। কিন্তু তার সঙ্গে সংগতি রেখে উন্নয়নের পরিকল্পনা হয় না, খণ্ড খণ্ড প্রকল্প হয় বরং উল্টো। নইলে যোগাযোগব্যবস্থায় নৌপথই তো প্রধান গুরুত্ব পাওয়ার কথা, দ্বিতীয় গুরুত্ব পাওয়ার কথা রেলপথ। গত ৫০ বছরে নৌপথ অর্ধেক গায়েব, রেলপথও তেমন বাড়েনি, সড়ক–মহাসড়ক বেড়েছে বহুগুণ, সঙ্গে সেতু। এগুলো বহু নদী খেয়ে ফেলেছে, আরও খাবার ব্যবস্থা চলছে। এসবে সর্বজনের ক্ষতি কিন্তু ঋণদাতা, গাড়ি ব্যবসায়ী, আমলা, মন্ত্রী, ঠিকাদার, প্রকৌশলী, পরামর্শকদের লাভ।
পাটশিল্প বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব শিল্পের ভিত্তি তৈরি করতে পারত। পাট খাত উন্নয়নের প্রকল্পে ঋণ দিয়ে বিশ্বব্যাংক এই শিল্পের বিপর্যয় ঘটিয়েছে। লাভ হয়েছে, হচ্ছে দুর্নীতিবাজ আমলা এবং জমি–কারখানার দখলদারদের। ঢাকা মহানগর উন্নয়নে, বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত করায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প এসেছে। অনেক কেনাকাটা, সফর হয়েছে, অথচ শহরে ট্রাফিক বাতিও অকার্যকর, বুড়িগঙ্গা এখন নর্দমা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জানা ব্যবস্থাগুলো না নিয়ে এখন বিশ্বব্যাংকের ঋণে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে পরামর্শকদের জন্যই বরাদ্দ চার শতাধিক কোটি টাকা।
অনেকে সরল বিশ্বাসে ভাবছেন, সরকার যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি আর সর্বজনের অংশগ্রহণ অস্বীকার করে জাতীয় বিপর্যয় তৈরি করছে, তখন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানের শর্ত সরকারকে এগুলো করতে বাধ্য করবে। প্রকৃতপক্ষে এসব সংস্থা যেসব শর্ত দেয়, তার দুটি অংশ আছে। একটি অংশ, যেটা তারা সংবাদমাধ্যম ও জনগণের জন্য জোরে জোরে বলে। কিন্তু এগুলো পূরণ না হলে তাদের কিছু আসে–যায় না, এগুলো তাদের আসল অ্যাজেন্ডাও নয়। এগুলোর মধ্যে আছে সুশাসন, দুর্নীতি দমন, জবাবদিহি, জনগণের অংশগ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ইত্যাদি।
আর যেগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে বা ফিসফিস করে বলা হয়, সেগুলোই আসল অ্যাজেন্ডা। এগুলো বাস্তবায়িত না হলে টাকা ছাড়ই হবে না। এগুলোর মধ্যে মূল বিষয় দুটি—এক. সর্বজনের সম্পদ বা প্রতিষ্ঠান বা পরিষেবা ব্যক্তিমালিকানায় বিশেষত দেশি–বিদেশি বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে হস্তান্তর। দুই. এগুলোকে মুনাফার ভিত্তিতে পরিচালনা। এর ধারাতেই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসা পণ্যে পরিণত হয় এবং ক্রমাগত এগুলোর দাম বাড়তে থাকে। সর্বজনের স্বার্থে ভর্তুকির তারা বিরোধী, কিন্তু বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য এর বহুগুণ বরাদ্দেও আপত্তি করে না।
বাংলাদেশে অর্থকরী খাত, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত, রেলওয়ে, ওয়াসা—সব কটিতে বহু বিদেশি ঋণযুক্ত প্রকল্প আছে। বহু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সফর, গাড়িসহ নানা কিছু কেনাকাটা, সমীক্ষা চলছেই। সবখানেই উন্নয়নের শিরোনাম আছে। কিন্তু আমরা পাচ্ছি ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার আর সর্বজনের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবহন ব্যয়বৃদ্ধি। হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পর নদী, বন, বাতাস, ওয়াসার পানি এবং রেলওয়ের অবস্থা চোখের সামনেই দেখছি। সর্বজনের বিপদ বাড়লেও এসবের সুবিধাভোগী তো আছেই, ক্ষমতাবান কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী।
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক