বৈষম্য যত বাড়বে, দাবদাহও বাড়তে থাকবে

সারা দেশে অসহনীয় গরম পড়েছে, চলছে দাবদাহ। গরমে, দাবদাহে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। কোথাও পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, কোথাও নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ সমস্যাগুলো কি শুধুই প্রাকৃতিক, নাকি এতে মানুষেরও ভূমিকা আছে? আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, উন্নয়নদর্শন বা জীবনযাপনের পদ্ধতির সঙ্গে প্রকৃতির বিরূপতার কি কোনো সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন গওহার নঈম ওয়ারা

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের প্রধান খাল। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় প্রকল্পের পানি উত্তোলনকারী তিনটি পাম্প বিকল হয়ে পড়ায় মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে খালটি পানিশূন্য হয়ে পড়েছেছবি: শাহ আলম

বৈশাখের ভোর। তখনো সূর্য তার রুদ্রমূর্তি ধরেনি। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া এক ডোবায় খালি হাতে কাদায় মাছ ধরছিলেন লিয়াকত আলী। কুমারখালী উপজেলার নন্দুলালপুর ইউনিয়নের পুরোনো চড়াইকল গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছরের এই প্রবীণের সঙ্গে তাঁর নাতিরাও ছিল।

ফজরের নামাজের পরপরই ডোবায় মাছ ধরার আয়োজনে লেগে গিয়েছিলেন লিয়াকত আলী। ছেলেরা মাতেনি, তাই দুই নাতিকে সম্বল করে তাঁর মাছ ধরার ‘প্রজেক্ট’।

পূর্বপরিচিত লিয়াকত আলী সত্তরের নির্বাচনে কুঁড়েঘরের পক্ষে নির্বাচনী সভা ও প্রচারে থাকতেন তাঁর বাবা জিন্নাত আলীর সঙ্গে। ন্যাপ নেতা সৈয়দ আলতাফ হোসেনের এক নির্বাচনী সভায় এসেছিলেন রেলশ্রমিক নেতা কমরেড জসিম। কমরেড জসিমের ছন্দময় বক্তৃতা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন কুমারখালী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী লিয়াকত আলী।

অসহ্য গরমে কাদাজলে মাখামাখি লিয়াকত আলী আমাকে দেখেই কমরেড জসিমের গলায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘লাগাইবা তেঁতুল আর চাইবা আম, তা হবার লয়।’

আরও পড়ুন

কথা ছিল, দাবদাহের কারণ আর জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে কথা হবে। হাতে সময় কম, পানটি হয়ে ঝিনাইদহ যেতে হবে। তাই বুঝি কাদামাখা শরীরেই তিনি দাবদাহের কারণ কমরেড জসিমকে উদ্ধৃত করে জানিয়ে দিলেন।

কাদা ধুতে ধুতে ব্যাখ্যা করলেন, তাঁর মতে, একাত্তরে দেশটা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। দূরের-কাছের ইটভাটাগুলোর চিমনিগুলো দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘দিনরাত কাঠ জ্বালিয়ে ইট পুড়াবা আর ছায়া সুনিবিড় ঠান্ডা জনপদ চাইবা, সেটা কেমনে সম্ভব?’ আবার তাঁর মুখে চলে আসে কমরেড জসিমের বহুল ব্যবহৃত বাগ্‌ধারা, ‘সোনার পাথরবাটি’ খুঁজলে কাজ হবে না।

বলতে থাকেন, ‘জেলা ও উপজেলা শহর, সর্বত্র ধনাধন পেল্লাই পেল্লাই ইমারত উঠে যাচ্ছে। পানির কী ব্যবস্থা? প্রত্যেক বাড়িতে ইমারতে এখন সাবমারসিবল দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। মানে, ভূগর্ভের পানি ডাকাতি হচ্ছে। তোমাদের ঢাকায় আরএমজিরা করছে, এখানে দালানমালিকেরা করছে।’

এখন যে গরম—৩৯-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তার চেয়ে অনেক বেশি গরমেও চাপকল কাজ করত। ১৯৬০ সালে ঢাকায় তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন একটু বেশি চাপ দিতে হতো, কিন্তু পানি পাওয়া যেত। এখন কোনো সাধারণ চাপকলে পানি উঠছে না। পানির স্তর নামতে নামতে এখন চাপকলের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।

বৈষম্যের পাল্লায় যিনি ওপরে আছেন, যাঁর পকেটে ক্যাশ আছে, তিনি এখন সাবমারসিবল বসিয়ে পরিবেশ বিষিয়ে আরেক ধাপ ওপরে উঠে যাচ্ছেন। সাধারণ চাপকলের মালিকেরা হারাচ্ছেন তাঁদের পানির স্বাধীনতা; কল থাকলেও তাতে পানি নেই। অধিকাংশ বাড়িতেই পানির সংকট চলছে।

কুমারখালী উপজেলা জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী মনে করেন, যত্রতত্র সাবমারসিবল স্থাপন ও ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণেই পানির এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুষ্টিয়া অফিসের প্রাক্কলনিক কর্মকর্তা জানালেন, আগে যেখানে ১৫ থেকে ১৮ মিটারের মধ্যে পানি পাওয়া যেত, এখন সেটি ২৮ থেকে ৩৬ মিটার পর্যন্ত চলে গেছে।’

গ্রামের একটি বাড়ির আঙিনায় দেখা গেল, মানুষের লম্বা লাইন। এই বাড়ির সাবমারসিবল কাজ করছে, তাই আশপাশের লোকজন পানির পাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মজার ব্যাপার, যত বেশি সাবমারসিবল ব্যবহার হবে, আশপাশের নলকূপগুলোতে তত বেশি পানি কমে যাবে। যার কারণে তাঁরা পানিশূন্য হচ্ছেন, তাঁর কাছেই তাঁদের হাত পাততে হচ্ছে। অন্য কথায়, জল ভিক্ষা করতে হচ্ছে।

কুষ্টিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জেলায় ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪০০টি গভীর ও অগভীর সাবমারসিবল সরকারিভাবে বসানো হয়েছে। তবে এপ্রিলে নষ্ট ও অকেজো হয়েছে কুষ্টিয়া সদরে ১৭টি অগভীর ও ১টি গভীর নলকূপ, কুমারখালীতে ৩৪টি, খোকসায় ২৮টি, মিরপুরে ১১টি এবং ভেড়ামারায় ৪০টি অগভীর ও ১টি গভীর নলকূপ। এটা সরকারি নলকূপের হিসাব। বেসরকারি পর্যায়ে কী পরিমাণ নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে, এর তথ্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে নেই।

আরও পড়ুন

পানির স্তর নেমে যাওয়ার অন্য কারণেও আছে। উজানে পানি প্রত্যাহার করায় গড়াই নদ শুকিয়ে গেছে। পদ্মায় মূল স্রোত থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে সামান্য পানি আছে। পদ্মার এই অঞ্চলে পানির স্তর ধরে রাখতে সহায়তা করে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প। কিন্তু এই প্রকল্পের তিনটি মেশিন নষ্ট থাকায় বড় একটা পানির স্তর নেমে গেছে বা ‘লেয়ার ফল’ হয়েছে।

ফারাক্কায় শুষ্ক মৌসুমে পানির হিস্যা নিয়ে ফারাক্কা নিয়ন্ত্রণকারী দেশের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

মনে রাখতে হবে, গত ৫০ বছরে দুই পক্ষের পানির ব্যবহার এবং চাহিদা বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। দুই পক্ষকেই পানি ভাগাভাগির পাশাপাশি পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিয়েও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের কথা ভাবতে হবে। ভাবতে হবে নদীর প্রয়োজনের কথা। পাহাড় থেকে সাগরে পৌঁছাতে নদীর প্রয়োজনীয় পানিটুকু তাকে দিতেই হবে।

এখন কি গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে, না আমরা রাখাল বালককে অনুসরণ করছি।

চিত্রশিল্পী রাফি হকের শৈশব কেটেছে কুষ্টিয়ায় টিনের ছাপরায়। তিনি বলেছেন, ‘চৈত্র-বৈশাখের দাবদাহ তখনো ছিল। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের বাড়ির সামনের পিচের রাস্তা গলে যেত। আমরা পিচ দিয়ে মার্বেল বানিয়ে খেলেছি। ভরদুপুরে রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা যেত না। মনে হতো, আগুনে পা দিয়েছি, যেন পা পুড়ে যেত। তখন সারা কুষ্টিয়া শহরে একটি বাড়িতে শুনেছি এয়ার কন্ডিশন ছিল।

তখন স্কুলে গরমের ছুটি দিত। এক মাসের ছুটি। সবচেয়ে দীর্ঘ ছুটি। আমরা বলতাম, “আমের ছুটি”। আমের ছুটি ছিল আমাদের কাছে “প্রকৃতির পাঠ”। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা হতো আমের ছুটিতে।...কোনো কোনো দিন ভীষণ ঝড় উঠত। আমার খুব ভয় করত, যখন কুষ্টিয়াতে ঝড় উঠত। কারণ, আমাদের বাড়িটা কাঁচা ছিল। ঝড় উঠলে মনে হতো, একটা বিশালাকার দৈত্য বাড়িটাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে।...’

এখন গরমে বিটুমিন গলে যাওয়ার খবরে আমরা বিচলিত হচ্ছি। বলছি, আগে কখনো হয়নি। যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সহনীয় সড়কে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। পরে সড়কে আরও বেশি তাপমাত্রা সহনশীল ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

কিছু কিছু রাস্তা বেশ কয়েক বছর আগে তৈরি। সেখানে মূলত ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। যশোর থেকে নড়াইল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে এক কিলোমিটারের মতো সড়কে বিটুমিন গলে গেছে। বিটুমিন গলে যাওয়া অংশে বালু ছিটিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। এখন থেকে বাংলাদেশের কোনো সড়কেই আর ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা ঠিক হবে না।

সবজি চাষে দাবদাহের প্রভাব

চুয়াডাঙ্গা এখন সবজি আর নার্সারিতে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হানুরবাড়াদী গ্রামের এক খামারি জানালেন, গরমে কলাগাছের কাঁদি পড়ে যাচ্ছে। বেগুন, শসা ও করলাও রোদে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত সেচ দিয়েও ফসল রক্ষা করা যাচ্ছে না। একই গ্রামের অন্য এক কৃষক ছয় বিঘা জমিতে বিনা-২৫ জাতের ধানের আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, হঠাৎ করে ধানে মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এটা হওয়ার কথা নয়, তবু হচ্ছে। এর সঙ্গে তাপমাত্রার কোনো কার্যকরণ আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে কোন কোন ফসলের কী কী ক্ষতি হচ্ছে, তা আমরা এখনো নিরূপণ করতে পারিনি। তবে দু-এক দিনের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারব।’ তাঁরা যত তাড়াতাড়ি কাজটি করবেন, ততই ভালো। আশা করি তাঁরা ঢাকার দিকে তাকিয়ে না থেকে কাজে নেমে যাবেন।

সব স্কুল ছুটি দেওয়ার আদেশ জারি করা নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট চড়াইকলের লিয়াকত আলী। বললেন, ঢাকা দিয়ে দেশ মাপার সূত্র বাদ দিতে হবে। পঞ্চগড়ের শিশু বা পাহাড়ের শিশুদের কেন ঢাকার গরমের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।

আমাদের চেয়ে অনেক গরম ঝাড়খন্ডে। সেখানে ইতিমধ্যে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে ফেলেছে। সেখানে স্কুল একেবারে বন্ধ না রেখে সকাল থেকে চালু রাখার কথা বলা হয়েছে। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্কুল চলাকালে রোদের মধ্যে কোথাও প্রার্থনা বা খেলাধুলার আয়োজন করা যাবে না। খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের দাঁড় করানো যাবে না।

সরকার জানিয়েছে, এই সময়ের মধ্যে শিক্ষাসংক্রান্ত কোনো ক্ষতি হলে তা কীভাবে পূরণ করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাদের লক্ষ্য, যেভাবেই হোক ছেদহীন পড়ালেখা নিশ্চিত করা। করোনাকালে আমরা দেখেছি, পড়াশোনায় ছেদ পড়লে তার পরিণতি কী হয়। তারপরও আমাদের শিক্ষা হলো না।

পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসির ব্যবহার। অফিসে এসি, গাড়িতে এসি, বাড়িতে এসি, বাজারে এসি, মসজিদ-মন্দির-গির্জায় এসি। ভাটার ধোঁয়ার মতো এসব এসির গরম বাতাস গ্রীষ্মের গরমকে আরও অসহনীয় করে তুলছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝটিকা অভিজ্ঞতা বলছে, চুপ করে বসে থাকার সময় নেই। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে স্থানীয়ভাবে একটা জয়েন্ট টাস্ক কমিটি করে কৃষি, প্রাণী পালন, মাছ চাষ, ফুল চাষ প্রভৃতি খাত ধরে ধরে কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনে এবারের অভিজ্ঞতা আর ভুলগুলো নথিভুক্ত করা। শেখা আর গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মনে রাখতে হবে, মরদেহ দিয়ে দুর্যোগ মাপার দিন এখন আর নেই। কম মরেছে মানে, কম দুর্যোগ—এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এবারের দাবদাহের ‘ঘা’ সহজে শুকাবে না।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক