২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিসিএস আন্তক্যাডার বৈষম্যের অবসান হবে কবে

বিসিএস ক্যাডারের পদোন্নতির নৈরাজ্য আজও দূর করা সম্ভব হয়নি। বিসিএসে এক ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের যে বৈষম্য, তা সরকারি চাকরির এক লজ্জাজনক অংশ। একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, একই পরীক্ষা, একই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে একই দিনে যোগদান করা কর্মকর্তাদের মধ্যে যে বৈষম্য, তাকে কোনোভাবে সুস্থ পদ্ধতি বলা যায় না। এই অসুস্থ পদ্ধতি দূর করার কোনো চেষ্টা আগের কোনো সরকার করেনি।

রাজনৈতিক সরকারগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ভিন্নমত বন্ধ করতে সরকারকে যে ক্যাডারের কর্মকর্তারা যতটা সহায়তা করতে পারেন, সেই ক্যাডার সরকারের কাছে তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিসিএস প্রশাসন ও পুলিশ এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক সরকারের সবচেয়ে প্রাধিকারভুক্ত দুই ক্যাডার।

এই দুই ক্যাডারের কর্মকর্তারা তরতর করে পদোন্নতি পান। কোনো কোনো ক্যাডারের সঙ্গে উল্লিখিত দুই ক্যাডারের এতটাই বৈষম্য করা হয় যে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তারা নিজেদের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন। লজ্জায়–অপমানে ক্ষেত্রবিশেষে এই বৈষম্য মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে ওঠে। ২০ বছরে মাত্র একবার পদোন্নতি পাওয়ার রেকর্ড আছে। ১৭ বছরে পদোন্নতি হয়নি এমনও আছে। কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাওয়ার মতো ঘটনাও পাওয়া যায়।

বর্তমান বৈষম্যবিরোধী সরকার দায়িত্ব নিয়েই এই দুই ক্যাডারের ভেতরের বৈষম্য দূরীকরণে হাত দিয়েছে। এই দুই ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের বৈষম্য দূরীকরণ কিংবা অন্য ক্যাডারের মধ্যে যে বৈষম্য আছে, সেটা নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি

রাজনৈতিক সরকারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডার প্রশাসন। কিন্তু প্রায় ১৫ বছরে ক্ষেত্রবিশেষে এই ক্যাডারের চেয়ে পুলিশ ক্যাডার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরা সরকারের সব রকম অনিয়ম-দুর্নীতির রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল। মাঠে যেকোনো বিরুদ্ধ মতকে দমানোর জন্য পুলিশ যথেষ্ট ছিল। বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে পুলিশি সহায়তা। সরকারের পুলিশ–নির্ভরতা যেকোনো সময়ের চেয়ে গত ১৫ বছরে বেশি হয়েছে।

এই নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে তারাও প্রশাসন ক্যাডারের মতো নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। পুলিশ আর প্রশাসন ক্যাডার সরকারের সঙ্গে থাকলে আর কোনো ক্যাডারের কথা না ভাবলেও চলে। এই ভাবনা যে চূড়ান্ত সত্য নয়, ২০২৪–এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান তা প্রমাণ করেছে।

কেবল পদোন্নতির ক্ষেত্রে নয়, অন্য যেকোনো সুবিধার সর্বোচ্চটা দেওয়া হয় এই দুই ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুবিধাও চালু করা হয়েছে। যেমন প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিবদের (পঞ্চম গ্রেডভুক্ত) ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। গাড়ির চালক, তেলের খরচ, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসিক আরও ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। সুবিধা পেলে একই গ্রেডের সব কর্মকর্তার পাওয়া উচিত, নয়তো কারও নয়।

বর্তমান বৈষম্যবিরোধী সরকার দায়িত্ব নিয়েই এই দুই ক্যাডারের ভেতরের বৈষম্য দূরীকরণে হাত দিয়েছে। এই দুই ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের বৈষম্য দূরীকরণ কিংবা অন্য ক্যাডারের মধ্যে যে বৈষম্য আছে, সেটা নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের হাতে অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতি নির্ভর করার কারণেও বৈষম্য বাড়ছে। যেকোনো ক্যাডারের কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদোন্নতি পাওয়ার পর যে স্থানে উন্নীত হন, তার চেয়ে দুই থেকে চার ধাপ ওপরে যান প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

উদাহরণ দেওয়া যাক: শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদোন্নতি অধ্যাপক ৪ নম্বর গ্রেড। স্বাস্থ্য ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদোন্নতি অধ্যাপক ৩ নম্বর গ্রেড। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে চার ধাপ, স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে তিন ধাপ ওপরে প্রশাসন ক্যাডারের অবস্থান। অপরাপর ক্যাডারেও একই বৈষম্য। স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৫ শতাংশ চিকিৎসকও ৩ নম্বর গ্রেডে যেতে পারেন না। শিক্ষা ক্যাডারের তো ৪ নম্বরের ওপরে যাওয়ার কোনো পথই নেই।

বর্তমানে বৈষম্য দূর করতে হলে অনেক ক্যাডারে এক বা একাধিক পদোন্নতি দিতে হবে। শতভাগ সমতা বিধান করা কঠিন। কারণ, সব ক্যাডারে সমসংখ্যক পদোন্নতি হয় না। তারপরও সব ক্যাডারের সমতা বিধানে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

বিসিএস চাকরির একটি রীতি ব্যাচভিত্তিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা। যেমন ২৬তম বিসিএস ছিল বিশেষ বিসিএস। ২৫তম বিসিএসের আগে ২৬তম বিসিএসের নিয়োগ হয়েছিল। ২৫তম বিসিএসের নিয়োগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৫তম বিসিএস কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতা পেতে শুরু করেন। ২৬তম বিসিএস কর্মকর্তারা জুনিয়র হন। অর্থাৎ চাকরিতে বিসিএসের ক্রম গুরুত্বপূর্ণ। একই বিসিএসের সবার পদোন্নতির পরে পরবর্তী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে হবে। পদশূন্য থাকার বিষয়টি যেমন এই দুই ক্যাডারে অনুসরণ করা হয় না, অন্যদের ক্ষেত্রেও তা–ই করতে হবে।

সব মন্ত্রণালয়ের সচিব হন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা, এটিও বন্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ পদে আসীন করতে হবে। একই বিসিএসের কেউ অবসরে যাবেন চতুর্থ, পঞ্চম বা ষষ্ঠ গ্রেডে আর কেউ কয়েক গ্রেড ওপরে সচিব কিংবা সিনিয়র সচিব পদে। এই বৈষম্য কি দূর হবে না? একই বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে যাঁরা উত্তীর্ণ হয়ে একই দিনে ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে একই সঙ্গে পদোন্নতি দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে পদ্ধতি বদলাতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই তা সম্ভব।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক