সাম্প্রতিক কালে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এসব দেশের সরকার কোভিড অতিমারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এর কারণ বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও এর মূল কারণ এসব দেশে অনর্থনীতিচর্চা।
অনর্থনীতি কী?
অর্থনীতি কী, সেটা সবাই জানি। কিন্তু অনর্থনীতি কী? সাধারণভাবে, যেসব নীতি ও কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হলে দেশের অর্থনীতিতে অনর্থ ঘটে, সেগুলোই অনর্থনীতি। বিশেষ করে সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থনীতির তত্ত্ব ও নিয়ম থেকে ব্যত্যয়কে আমরা অনর্থনীতি বলতে পারি।
দেশে অনর্থনীতিচর্চা বেড়েছে
সাম্প্রতিক কালে অনর্থনীতিচর্চা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তাই প্রথমেই সংক্ষেপে পৃথিবীর সব দেশে সরকারের ছয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং এর বিপরীতে বাংলাদেশে অনর্থনীতিচর্চার কিছু উদাহরণ তুলে ধরব।
আইনি ও সামাজিক কাঠামো বজায় রাখা
এ কর্মকাণ্ডের আওতায় সরকার আইন, আদালত ও সম্পত্তির অধিকার, মুদ্রাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং সঠিক তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করে অর্থনীতির বিকাশে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে আইনি কাঠামোর দুর্বলতার বড় উদাহরণ হলো বিদেশি সংস্থার সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী আইন (গভর্নিং ল) হিসেবে বিলেতের আইনসহ ভিনদেশি আইনি কাঠামো গ্রহণ, সালিস নিষ্পত্তির ক্ষেত্র হিসেবে লন্ডন ও সিঙ্গাপুরের মতো স্থান নির্ধারণ। আইনি দুর্বলতা ছাড়াও বিচারকদের যোগ্যতা, নিরপেক্ষতা ও সততার অভাব, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও মামলাজট এ জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
সঠিক তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহে ব্যর্থতার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো, দেশে মার্কিন ডলারে মোট দেশজ উৎপাদনের আকার বেশি দেখানোর জন্য ডলারের দাম ধরে রাখা হয়েছিল এবং একই সঙ্গে মাথাপিছু আয় বেশি দেখানোর জন্য লোকসংখ্যা কম দেখানো হয়েছিল। এসবই করা হয়েছিল মাথাপিছু জিডিপি বেশি দেখিয়ে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে এ প্রচারণার জন্য। এখন সেটার ধাক্কা সামলাতে টাকার দ্রুত ও ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। আইএমএফের শর্তগুলো, যেমন কর রাজস্ব বাড়ানো, মুদ্রামান ও সুদের হার বাজারনির্ভর করা, ভর্তুকি প্রত্যাহার ইত্যাদি দেখলে বোঝা যাবে এগুলো আর কিছু নয়, অনর্থনীতি থেকে অর্থনীতিতে ফেরার দাওয়াই মাত্র। তাই সংগতভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কি আইএমএফ কেইনস কথিত বাতিলকৃত অর্থনীতিবিদ?
প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা
এখানে সরকারের কাজ হলো অ্যান্টি ট্রাস্ট আইন বলবৎ ও কার্যকর এবং একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা। প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য হলো ক্রেতা যাতে মানসম্মত পণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে পেতে পারেন। সরকারি সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দাম, সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন পণ্য ও সেবা ক্রয়।
বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা কেবল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে সীমিত। বড় ব্যবসায়ীদের কার্টেল কীভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ায়, তা আমরা জানি। সরকারি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত বলা চলে। বিস্ময়কর হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার নির্বাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
সামাজিক পণ্য ও সেবার ব্যবস্থা করা
প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সর্বজনীন পণ্য ও সেবা, যা বাজারব্যবস্থা সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম, তা সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব। সামাজিক পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে অনর্থনীতি অনুসরণের দৃষ্টান্ত হলো, আমাদের হাসপাতাল ও স্কুলগুলোর বেহাল অবস্থা, বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে অবিশ্বাস্য বিলম্ব ও আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি।
আয় ও সম্পদের পুনর্বণ্টন
দেশে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সীমিতকরণের লক্ষ্যে, ধনীদের থেকে উচ্চ হারে কর আদায়, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সৃষ্টি, স্বল্প মূল্যে মৌলিক চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে আয় ও সম্পদের পুনর্বণ্টন করা সরকারের অন্যতম একটি কাজ। ধনীদের থেকে কর আদায়ে নীতি ব্যর্থতার একটি বড় ফলাফল হলো ক্রমাগতভাবে কর ও জিডিপির অনুপাত হ্রাস। অপ্রতুল কর রাজস্বের কারণে কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর প্রসার করা যাচ্ছে না।
আবার যৎসামান্য কর্মসূচির সুফল দরিদ্রদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না পথিমধ্যে বেহাত হওয়ার কারণে। ফলে আয়বৈষম্য বেড়েছে, জাতীয় আয়ের ১৬.৩ শতাংশ কুক্ষিগত হয়েছে ১ শতাংশ মানুষের হাতে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বিনিয়োগ আরেকটি বড় অনর্থনীতি। এখন অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া ভৌত অবকাঠামো কেবল কঙ্কালমাত্র।
বাহ্যিকতা সংশোধন ও পরিবেশ সংরক্ষণ
সিগারেটের মতো নেতিবাচক বাহ্যিকতার জন্য কর আরোপ, যাতে করে এসব পণ্য কম উৎপাদিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা ও মৌলিক চিকিৎসার মতো ইতিবাচক বাহ্যিকতার ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করা, যাতে করে এসব পণ্য ও সেবার উৎপাদন বাড়ে। পরিবেশের ওপর উন্নয়ন কার্যক্রমের বিরূপ প্রভাব চিহ্নিত করা ও উপশমের ব্যবস্থা নেওয়া।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
সরকারের বাজেট ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও বেকারত্ব লাঘব করা সরকারের একটি মৌলিক কর্তব্য।
এ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যাচ্ছে যে বাজেট, আর্থিক ও মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকার স্বাধীনতা হারিয়ে কায়েমি স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাদের পরামর্শে সুদের হার ‘নয়–ছয়’ নির্ধারিত হচ্ছে, খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল হচ্ছে, মানি লন্ডারিং বাড়ছে। তাই সাধারণ মানুষ আর্থিক নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রার মান ও বিনিয়োগ কমছে। এ কারণে বেকারত্ব বাড়ছে।
রাজনীতিবিদেরা অনর্থনীতি পছন্দ করেন কেন
অর্থনীতিবিদেরা পরামর্শক হিসেবে কাজ করলেও ওপরে উল্লিখিত ছয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কিন্তু রাজনীতিবিদদের হাতে।
এখন কথা হলো, রাজনীতিবিদেরা অনর্থনীতি পছন্দ করেন কেন? এর প্রধান কারণগুলো হলো এক. রাজনীতিবিদদের অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞানের অভাব অথবা সবজান্তা ভাব। ফলে তাঁরা আমলা কিংবা অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন বা পরামর্শের ধার ধারেন না।
দুই. বিষয় সম্পর্কে জানলেও তাঁরা কায়েমি স্বার্থের বশীভূত (রেগুলেটরি ক্যাপচার)। অর্থাৎ, যাঁদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তাঁরাই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিন. স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) সম্পর্কে ধারণার অভাব বা তা পরিহার করতে ব্যর্থতা। চার. জনতুষ্টি ও দুর্নীতির প্রবণতা।
অর্থনীতিবিদ জন কেইনসের দম্ভোক্তি
প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ কেইনস তাঁর জেনারেল থিওরি অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট অ্যান্ড মানি গ্রন্থে দাবি করেছেন, ‘অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তাধারা যখন সঠিক, এমনকি ভুল হলেও তা যেমনটি মনে করা হয়, তার থেকে বেশি শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে তারাই দুনিয়া শাসন করে।
বাস্তববাদী মানুষ, যারা নিজেদের কারও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাবমুক্ত মনে করে, তারা আসলে কোনো না কোনো বাতিলকৃত অর্থনীতিবিদের আজ্ঞাবহ দাসমাত্র।’ যদি তা-ই হয়, তবে রাজনীতিবিদেরা অনর্থনীতিচর্চা করে পার পেয়ে যান কীভাবে?
তবে কি আইএমএফ বাতিলকৃত অর্থনীতিবিদ
তবে কি কেইনস ভুল বলেছিলেন। আমার তা মনে হয় না। অর্থনীতি অনেকটা প্রতারিত প্রেমিকের মতো, প্রতিশোধপরায়ণ! তাই অনর্থনীতি অনুসরণকারী রাজনীতিবিদেরা তাঁদের স্বার্থের কারণে দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেন। তা থেকে উত্তরণের পথ বন্ধ হয়ে গেলে রাজনীতিবিদেরা আবার সাহায্যের জন্য অর্থনীতিবিদদের দ্বারস্থ হন।
যেমন শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। আইএমএফের শর্তগুলো, যেমন কর রাজস্ব বাড়ানো, মুদ্রামান ও সুদের হার বাজারনির্ভর করা, ভর্তুকি প্রত্যাহার ইত্যাদি দেখলে বোঝা যাবে এগুলো আর কিছু নয়, অনর্থনীতি থেকে অর্থনীতিতে ফেরার দাওয়াই মাত্র। তাই সংগতভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কি আইএমএফ কেইনস কথিত বাতিলকৃত অর্থনীতিবিদ?
আমরা চাই দেশে অনর্থনীতিচর্চা বন্ধ হোক। সুস্থ অর্থনীতির ধারায় ফিরে দেশ এগিয়ে যাক।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ [email protected]