গাজায় চলমান ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের বিষয়ে ভারত যে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, সেটি দিল্লির পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের বাঁকবদলকে স্পষ্ট করে।
স্বাধীনতার পর কয়েক দশক ধরে ভারতের যে বিশ্বদৃষ্টি জারি আছে, তা মূলত ভারতের ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আদল পেয়েছে।
ভারত ২০০ বছর একটি বিদেশি শক্তির উপনিবেশ হিসেবে কাটিয়েছে। শীতল যুদ্ধের সময় দেশটি সেই ঔপনিবেশিক দেশটির পক্ষ নেয়নি। কারণ, এর মধ্য দিয়ে ভারত বৈশ্বিক নীতিনির্ধারক কোনো শক্তির পক্ষে নাম লিখিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তিকে বলি দিতে রাজি ছিল না।
এই আধুনিক বিশ্বে এখন কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন একটি মোহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ‘জোট নিরপেক্ষতা’র (যেটিকে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্যমূলক দূরত্ব বজায় রাখার ধারণা বলা যেতে পারে) জন্ম হয়েছে। তবে শীতল যুদ্ধের সময়ের ভারতের জোটনিরপেক্ষ থাকাটা সম্ভবত এখনকার চেয়েও অনেক কঠিন ছিল।
ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটানোর একটি নেতৃস্থানীয় কণ্ঠস্বর হিসেবে ভারত সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে একটি নৈতিক অবস্থান নিয়েছিল। ভারতের এই অবস্থানকে প্রায়ই পশ্চিমাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। তবে সে সময়ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারতের অবিচল আনুগত্য এবং নিজ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে থাকা বৈচিত্র্যের প্রতি দেশটির শ্রদ্ধা প্রদর্শন পশ্চিমা উদারপন্থীদের মুগ্ধ করে আসছিল।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত প্রশ্নে ভারত সেই জোটনিরপেক্ষ নীতির পথে অবিচল ছিল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে তৎকালীন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—এই দুই ভাগে বিভক্ত করার যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, ভারত তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। কারণ, দেশভাগের যন্ত্রণা ভারতের উপলব্ধিতে ছিল। কারণ, ওই বছরই আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের নামে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিল।
এ কারণে ভারত চেয়েছিল ফিলিস্তিনে একটি অবিভক্ত স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক, যেখানে ইহুদি ও আরবরা পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে।
ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে কনস্যুলার লেভেলে চার দশক ধরে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। অবশেষে ১৯৯২ সালে ভারত ইসরায়েলে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। এ ছাড়া প্রথম অন-আরব দেশ হিসেবে ভারত ১৯৭৪ সালে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) স্বীকৃতি দেয়। ভারতই প্রথম অন-আরব দেশ, যে কিনা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল (১৯৮৮ সালে)।
কিন্তু পাকিস্তানের মাটিকে কেন্দ্র করে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে ধীরে ধীরে উষ্ণ করে তোলে। কারণ, ভারতের মতো ইসরায়েলকেও ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর জের ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বাড়তে শুরু করে। তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে।
তবে ভারতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমানের ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি থাকার কারণে ভারতের সরকারগুলো পিএলওর প্রতি সমর্থন বজায় রেখে এসেছে।
পিএলওর চেয়ারম্যান ও ফিলিস্তিনের জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত যখন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি চেয়েছিলেন, তখন ভারত দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সমর্থক হয়ে ওঠে।
হাতে গোনা যে কয়টি রাষ্ট্র বর্তমানে রামাল্লা ও তেল আবিব—এ দুই স্থানেই রাষ্ট্রদূত নিয়োজিত রেখেছে, তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম।
তবে ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইদানীং নিবিড়তর হয়েছে। ইসরায়েল ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আহরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল এখন ভারতের গোয়েন্দা সহযোগিতার একটি বিশ্বস্ত অংশীদার। বলা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী সরকার অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের শায়েস্তা করতে যেসব নজরদারি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, সেগুলোর সরবরাহকারী দেশ হলো ইসরায়েল।
মোদিই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি ইসরায়েল সফর করে সেখানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নেতানিয়াহুও দুবার ভারত সফর করেছেন। এসব ঘটনা এই দুই নেতার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কের আভাস দেয়।
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা এবং দুই শতাধিক লোককে অপহরণ করার পর মোদি ত্বরিতগতিতে টুইট করেছিলেন, ‘ইসরায়েলের দুঃসময়ে তার পাশে আছি।’ এরপর তিনি ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানিয়ে আরও একটি টুইট করেন। মোদির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সমর্থকেরা (ভারতের মুসলমানদের প্রতি যাদের বিদ্বেষের কথা গোপন কিছু নয়) ইসরায়েলের কঠোর প্রতিক্রিয়ায় উল্লাস প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু গাজায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং আশপাশের এলাকা, হাসপাতাল ও উপাসনালয় ধ্বংসের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ভারত তার একপেশে অবস্থান নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে। ইসরায়েলের হামলার বেশ কয়েক দিন পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি জারি করেছে। তাতে ভারত ‘ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপদ ও স্বীকৃত সীমানার মধ্যে বসবাসকারী ফিলিস্তিনের একটি সার্বভৌম, স্বাধীন এবং কার্যকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সরাসরি আলোচনা পুনরায় শুরু করার’ আহ্বান জানায়।
মোদির টুইটার-আঙুল অবশ্য এবার আর আগের মতো দ্রুততায় ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। তিনি যখন আবার টুইট করলেন, তখন তিনি তাতে আল-আহলি হাসপাতালে বোমা হামলার কারণে নিরীহ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ফোন করেছিলেন বলে বর্ণনা দিয়েছেন।
আব্বাস (যাঁর দল ফাতাহ ২০০৭ সালে হামাসের দ্বারা গাজা থেকে বিতাড়িত হয়েছিল) রামাল্লায় রয়েছেন এবং গাজা ছিটমহলের ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারপরও মোদি স্পষ্টতই ধারণা করেছেন, এর আগের টুইটে ইসরায়েলের প্রতি তাঁর ঝুঁকে পড়ার বিষয়টির সঙ্গে আব্বাসের সঙ্গে তাঁর টেলিফোনের কথোপকথনটি একটি ভারসাম্য তৈরি করবে।
মোদির টুইট অনুসারে, তিনি এখন ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী নীতিগত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা দেওয়ার জন্য ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, তখন ভারত সেই প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।
কারণ হিসেবে ভারত বলেছে, প্রস্তাবটি ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্য অনেক দেশও এ কারণে জাতিসংঘের প্রস্তাবটির সমালোচনা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ভোট দিয়েছে।
এদিক থেকে ভারত ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্র ফ্রান্সের চেয়েও বেশি ইসরায়েলপন্থী আচরণ করেছে।
এর মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারত তার ঐতিহ্যগত অবস্থান থেকে কতটা সরে এসেছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং দেশটির কংগ্রেস পার্টির একজন সংসদ সদস্য