সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী পার্ক ও কারওয়ান বাজার এলাকায় সার্ক ফোয়ারা লাগোয়া পান্থকুঞ্জ—বেহাল পার্ক দুটি দেখে স্কুলজীবনে পড়া রিপভ্যান উইংকেলের গল্পটি মনে পড়ে গেল। ভবঘুরে স্বভাবের রিপভ্যান একদিন তার গ্রাম লাগোয়া পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন সে দেখল তার দাড়ি–গোঁফ বেজায় লম্বা হয়েছে, চকচকে বন্দুকটায় মরচে ধরেছে, চারপাশের চেনা দৃশ্যগুলো অতি অচেনা হয়ে উঠেছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতির কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে রিপ গ্রামের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু গ্রামে এসে সে কিছুই চিনতে পারে না। একসময় রিপ বুঝতে পারে তার ঘুমটা স্বাভাবিক ছিল না। এক ঘুমেই পেরিয়ে গিয়েছিল কুড়ি বছর!
পার্ক দুটির এমন নাজুক পরিস্থিতি দেখে মনে হয় আমাদের দুই সিটি করপোরেশনও রিপের মতোই ঘুমিয়ে পড়েছে! নাহয় এমন জনবহুল একটি নগরের দুই নগর কর্তৃপক্ষ উদ্ভিদ ও প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রশ্নে কীভাবে বছরের পর বছর এমন নির্বিকার থাকতে পারে। কতটা উদাসীন হলে একটি শহর এমন হতশ্রী ও দূষণে জর্জরিত হতে পারে? একটি পার্ক সংস্কারের জন্য আসলে কত বছর দরকার?
শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী পার্কটি সংস্কারকাজের জন্য প্রায় তিন বছর বন্ধ রয়েছে। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে মূলত কতগুলো পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, বুয়েট এবং সিটি করপোরেশন—এই তিন প্রতিষ্ঠান এখন পরস্পরকে দুষছে। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না।
বর্তমানে এই পার্কের সবচেয়ে হতাশাজনক দৃশ্য কাচের দেয়াল। প্রথম নকশায় এভাবেই কিছু জায়গায় কাচের দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো আমাদের মতো একটি দেশের পার্কে কাচের দেয়াল দেওয়া কতটা যৌক্তিক? নকশা প্রণয়নকারীকে অবশ্যই ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত, কেন তিনি মনে করছেন পার্কটিতে কাচের দেয়াল দিয়ে বায়ু চলাচলের পথ বন্ধ রাখতে হবে। এখন আবার কেন মনে করা হচ্ছে নকশা পরিবর্তন করা প্রয়োজন!
পার্কটির এমন সব নৈরাজ্য দেখে মনে হয়েছিল নকশাবিদ সম্ভবত বিদেশের কোনো শহরে থাকেন। দেশের নিসর্গ-প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর কোনো সংযোগ নেই। শুধু তা–ই নয়, প্রথম নকশা অনুযায়ী পুরোপুরি কাচের দেয়াল নির্মাণ করা হলে বেশ কিছু গাছও কাটা পড়ত। দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কাকে বলে! ঢাকার মতো এমন একটি প্রকৃতিবিমুখ শহরে এই একচিলতে সবুজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি উপলব্ধিই করতে পারেননি। পার্কের প্রধান অনুষঙ্গ উদ্ভিদ হলেও এখানে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় আছে উদ্ভিদগুলোই।
গত কয়েক বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সংস্কারকৃত পার্কগুলোর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এসব কাজে অবকাঠামোকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন পার্কে উদ্ভিদবৈচিত্র্যকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যান্য দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছে। কোটি কোটি টাকার এসব প্রকল্পে উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য কত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার আনুমানিক একটি হিসাব থেকেই বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। অধিকাংশ পার্কেই কাজটি দায়সারাভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এবার আসি পান্থকুঞ্জ পার্কে। ত্রিভুজাকৃতির পার্কটিতে সকাল-বিকেল হাঁটাচলা বা ব্যায়াম করতেন আশপাশের মহল্লার প্রবীণেরা। তপ্ত রোদে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতেন পথচারীরা। কিন্তু ২০১৮ সালের দিকে হঠাৎ দেখি পার্কটি টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পার্কটি সংস্কার করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় তখন সংস্কারকাজে প্রায় ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। তবে ‘জল সবুজে ঢাকা’ এমন আজগুবি শিরোনামে চমকে উঠেছিলাম। কোথায় জল, কোথায় সবুজ! জল আর সবুজ কি শুধু পার্কেই থাকবে, না পুরো দক্ষিণ সিটিতেও থাকবে—এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে দু–তিন বছর পেরিয়ে গেল।
এমন একটি প্রকল্পের উদ্ভাবকের উর্বর মস্তিষ্কের তারিফ না করে পারি না! কারণ, তিন বছর পর পার্কটি আপনা-আপনিই সবুজ জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। ভেতরের খোঁড়া অংশে বৃষ্টির পানি জমে অনেকটাই জল সবুজের পার্ক হয়ে উঠেছে! ভেতরে পোকামাকড়, মশার লার্ভা গিজগিজ করছে। পথচারী এবং ভাসমান মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করছে।
ভেতরে হাঁটাচলা বা ঘোরাঘুরির কোনো পরিবেশ নেই। বসছে মাদকাসক্তদের আড্ডা। তবে সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নকশা চূড়ান্তের পর ডিএসসিসি জানতে পারে, পার্কটির একাংশের ওপর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যাবে। দু–তিনটি খুঁটি পার্কের সীমানায় বসবে। এমন তথ্য পাওয়ার পর কাজ বন্ধ করে দেয় ডিএসসিসি। এসব খোঁড়া যুক্তি আর কত দিন? এসব জেনেও তারা অনায়াসে আরও দুই বছর পার করে দিল।
গত কয়েক বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সংস্কারকৃত পার্কগুলোর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এসব কাজে অবকাঠামোকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন পার্কে উদ্ভিদবৈচিত্র্যকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যান্য দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছে। কোটি কোটি টাকার এসব প্রকল্পে উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য কত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার আনুমানিক একটি হিসাব থেকেই বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। অধিকাংশ পার্কেই কাজটি দায়সারাভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
রাখা হয়নি কোনো উদ্ভিদ ও পরিবেশবিশেষজ্ঞ। অথচ বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা উচিত ছিল। সড়ক বিভাজক, ফুটপাত ও সড়কদ্বীপের ক্ষেত্রেও করপোরেশনের একই মনোভাব লক্ষণীয়। সব বরাদ্দ অবকাঠামোর জন্যই, উদ্ভিদের জন্য নয়। সেখানে করপোরেশনের কর্মীরাই ঠিক করেন কোথায় কী গাছ লাগাবেন এবং তা কতটা দায়সারাভাবে সম্পন্ন করা যাবে।
এই বেহাল দুই পার্ক নিয়ে নগরবাসী যখন চরম ক্ষুব্ধ, ঠিক এমন একটি সময়ে রেকর্ড পরিমাণ উষ্ণতায় জ্বলছে গোটা রাজধানী। এমন একটি সময়ে উত্তরের মেয়র ঘোষণা দিলেন দুই লাখ গাছ লাগাবেন তাঁরা। ধন্যবাদ জানাই তাঁকে। কিন্তু তিনি কী পরিকল্পনা করেছেন কোথায় এসব গাছ লাগাবেন বা গাছের কোনো তালিকা কি তৈরি করেছেন?
অথবা লাগানোর পর সেগুলো কে দেখভাল করবে? কাজটি অবশ্যই বিষয়-বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত রেখে করা উচিত। শুধু ঘোষণাতেই যেন থেমে না থাকে বৃক্ষরোপণ। আমরা জানি, একটি শহরের সার্বিক সৌন্দর্য শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাতে উদ্ভিদেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
মোকারম হোসেন প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক এবং সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব