মার্কিন নির্বাচনে মুসলিম ভোটের দাম বাড়ল যেভাবে

‘যদিও মুসলমানরা আমেরিকান জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ; তারপরও তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোট ব্যাংক।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে দোদুল্যমান ভোটার অধ্যুষিত যে কয়টি এলাকায় ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে থাকে সেসব এলাকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

যদিও মুসলমানরা আমেরিকান জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ; তারপরও তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোট ব্যাংক। কারণ তাঁরা এমন সব দোদুল্যমান অঞ্চল বা সুইং স্টেটগুলোতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছেন যেখানে অতি অল্প ভোটের ব্যবধানে নির্বাচনী ফল নির্ধারিত হয়ে থাকে।

এই নির্বাচনী চক্রে মুসলিম সম্প্রদায় একটি একক রাজনৈতিক ইস্যুতে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। সেই ইস্যুটি হলো গাজা যুদ্ধ।

এই বাস্তবতায় যে প্রার্থীই মুসলিম ভোটারদের বড় অংশের ভোট পেতে চাইবেন, তাঁকেই ফিলিস্তিনে রক্তপাত বন্ধের জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবিগুলোকে আমলে নিতে হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমগেজ অ্যান্ড চেঞ্জ রিসার্চ এবং ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং (আইএসপিইউ)-এর একটি যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদনে এমনটিই বলা হচ্ছে।

গত জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ের শুরু নাগাদ জরিপটি চালানো হয়। জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া এবং মিশিগান—এই তিনটি সুই স্টেটের মুসলমানেরা ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোন কোন প্রার্থীকে ভোট দিতে চান তার ওপর জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

ওই জরিপে আমরা দেখেছি, ২০২০ সালে যে মুসলমানেরা ডেমোক্রেটিক দলের বড় সমর্থক ছিল, গাজা যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অবস্থানের কারণে তারা তার তীব্র বিরোধিতাকারী হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

২০২০ সালে এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে ৬৫ শতাংশ মুসলমান ভোটার বাইডেনকে ভোট দিয়েছিল। এই ভোট তাঁর নির্বাচনী জয়ের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল কারণ তিনি খুব সংকীর্ণ ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটগুলোতে জিতেছিলেন। জর্জিয়ায় বাইডেন মাত্র ১২ হাজার ভোটে জিতেছিলেন; আর ওই অঙ্গরাজ্যে ৬১ হাজারের বেশি মুসলমান ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। একইভাবে পেনসিলভানিয়ায় বাইডেন ৮১ হাজার ভোটে জিতেছিলেন এবং সেখানে ১ লাখ ২৫ হাজার মুসলমান ভোট দিয়েছিল।

অথচ এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে চালানো জরিপে এখন দেখা গেছে, সেখানে মাত্র ১২ শতাংশ ভোটার বাইডেনকে ভোট দিতে রাজি ছিলেন। যে সময়টাতে জরিপটি চালানো হয়েছিল, সে সময় বাইডেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন। সে সময়ে কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে আসেননি।

তবে এই জরিপ থেকে বোঝা যায়, বাইডেনের গাজা যুদ্ধ নীতি যদি ডেমোক্রেটিক পার্টি অনুসরণ করার আভাস দেয় তাহলে মুসলিম ভোটাররা বাইডেনকে যেভাবে সমর্থন দেওয়া থেকে সরে এসেছে, কমলা হ্যারিসের ক্ষেত্রেও সেই একই অবস্থানে থাকবে।
এর মধ্য দিয়ে অনুমান করা যায়, ডেমোক্রেটিক পার্টিকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলমান ভোটারদের যে একচেটিয়া সমর্থন ছিল, তাদের সেই মোহ ভেঙে গেছে।  

গাজার যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান ভোটারদের যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে, অন্য কোনো ইস্যু স্মরণকালের মধ্যে তা করতে পারেনি।

আইএসপিইউ ২০২০ সালে আমেরিকান মুসলমানদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছিল। সেই জরিপে দেখা গিয়েছিল, মুসলমানদের ভোটদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা (১৯ শতাংশ), অর্থনীতি (১৪ শতাংশ) এবং সামাজিক ন্যায়বিচার (১৩ শতাংশ) শীর্ষস্থানীয় অগ্রাধিকারের বিষয় ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জরিপে জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া ও মিশিগানের মুসলমানদের ৬১ শতাংশই ভোটদানের ক্ষেত্রে গাজা যুদ্ধকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, দল মত নির্বিশেষে মুসলমান ভোটারদের মধ্যে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা হ্রাস করার বিষয়টি সমর্থন করেন। তাঁরা এই নীতিটিকে প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কারণ হিসাবে দেখেন।

যদিও বিদেশে চলমান অন্যান্য যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকান অবস্থানকে মুসলিম ভোটারদের দৈনন্দিন উদ্বেগ থেকে অনেক দূরের বিষয় বলে মনে হতে পারে; তবে ইসরায়েলকে আমেরিকার নিঃশর্ত মদদ দেওয়া ও কূটনৈতিক সহায়তা দেওয়াকে তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালানো হিসেবে দেখে থাকেন।

মুসলমান ভোটারদের কাছে গাজার যুদ্ধের গুরুত্ব যে কতখানি তা আমাদের জরিপ চালানোর কয়েক মাস আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাইমারিতে ‘আনকমিটেড ন্যাশনাল মুভমেন্ট’ নামের একটি আন্দোলনের (যার নেতৃত্বে ছিলেন মুসলমানেরা) কর্মীরা ভোটারদের বাইডেনকে ভোট না দিয়ে ‘আনকমিটেড’ (ব্যালটে প্রার্থী হিসেবে জো বাইডেনের নামের ঘরের পাশে ‘আনকমিটেড’ নামের একটি ঘর ছিল যেখানে টিক চিহ্ন দেওয়ার অর্থ ভোটার বাইডেনের বাইরে অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান) ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান।

প্রাইমারিতে তখন ৭ লাখের বেশি ‘আনকমিটেড’ ভোট পড়েছিল। এর মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বিষয়ে সুর ও নীতি বদলাতে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল।

এরপরই জর্জিয়া, মিশিগান ও পেনসিলভানিয়াতে মুসলমানদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখা গেছে।

বাইডেন প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর কমলা হ্যারিস এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং তিনি ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

গত জুলাইয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে কংগ্রেসে যখন বক্তৃতা দেন তখন কমলা সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম ঘোষিত হওয়ার পর তিনি বলেছেন, গাজার দুর্দশা নিয়ে তিনি চুপ থাকবেন না এবং সেখানে যুদ্ধবিরতির জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

এসব দিক বিবেচনায় বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে দেশটির মুসলিম ভোটার এ বছর অন্য যে কোনো বারের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে যাচ্ছে।
আল জাজিরা থেকে নেওয়া

  • ডালিয়া মোগাহেদ ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং (আইএসপিই)-এর প্রাক্তন গবেষণা পরিচালক

  • সাহের সেলোদ আইএসপিইউ-এর গবেষণা পরিচালক

    ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ