লেবাননে যুদ্ধ করে বারবার ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল

বৈরুতের শহরতলিতে ইসরায়েলি আক্রমণের পরএএফপি

লেবাননে ব্যাপক বোমাবর্ষণের পর ইসরায়েল তার প্রতিবেশী দেশটিতে স্থল আক্রমণ শুরু করেছে।

ইসরায়েলের সীমান্ত থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরে লিটানি নদীর ওপারে হিজবুল্লাহকে ঠেলে দেওয়ার জন্য সৈন্যরা দক্ষিণ লেবাননে প্রবেশ করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো উত্তর ইসরায়েলে প্রায় ৬০ হাজার ইসরায়েলিকে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা।

হাসান নাসরুল্লাহ এবং তাঁর বেশ কয়েকজন কমান্ডারকে হত্যা করে ইসরায়েল ইতিমধ্যে হিজবুল্লাহর ওপর গুরুতর আঘাত হেনেছে।

এসবের ফলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাপট বেড়েছে। তবে এ-ও সত্য যে বেশির ভাগ ইসরায়েলি তাঁকে আর ক্ষমতায় দেখতে চান না। ইসরায়েল এখন লেবাননে তার গাজা অপারেশনের পুনরাবৃত্তি করতে প্রস্তুত। সে চায় নিজের স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্বিন্যাস করতে। কিন্তু সে যতটা মুখে পুরেছে, ততটা চিবোতে পারবে তো?

ব্যর্থ ট্র্যাক রেকর্ড

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাপট বেড়েছে। তবে বেশির ভাগ ইসরায়েলি তাঁকে আর ক্ষমতায় দেখতে চান না।

ঠিক একই রকম উদ্যোগ আগেও নিয়েছে। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) নির্মূল করার প্রয়াসে তারা ১৯৮২ সালে রাজধানী বৈরুত পর্যন্ত আক্রমণ করেছিল। এই একই বছরে ইরানের নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সরকারের সহায়তায় হিজবুল্লাহ গঠিত হয়েছিল।

বৈরুতের সাবরা ও শাতিলা শরণার্থীশিবিরে শত শত ফিলিস্তিনিকে গণহত্যা করার জন্য ইসরায়েল তার লেবানিজ খ্রিষ্টান মিত্রদের ক্ষমতায়িত করেছিল। ফলে পিএলও তার সদর দপ্তর বৈরুত থেকে তিউনিসিয়ায় স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল।

এরপর ইসরায়েল তার সীমান্তের উত্তরে একটি নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে। কিন্তু হিজবুল্লাহ কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইসরায়েলি হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ২০০০ সালে একতরফা সৈন্য প্রত্যাহার করেছিলেন।

এই প্রত্যাহারের ফলে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে হিজবুল্লাহর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।

হিজবুল্লাহকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ২০০৬ সালে ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়। ৩৪ দিনের রক্তক্ষয়ী লড়াই এবং উভয় পক্ষে অনেক হতাহতের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। হিজবুল্লাহ বিজয়ী হয়।

প্রতিবাদী যুদ্ধ

তবে এবার সাফল্যের ব্যাপারে নেতানিয়াহু নিজেকে আত্মবিশ্বাসী মনে করছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে চরমপন্থী মন্ত্রীদের সমর্থন। বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করেন তিনি।

ইসরায়েলের কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী অস্ত্র আছে। গাজা যুদ্ধে হামাসের হাতে ইসরায়েলি নাগরিক হত্যা ও অপহরণের প্রতিশোধ নেওয়ার সময় তা সে দেখিয়েছে।

পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে ইসরায়েল গাজার বিস্তৃত অংশকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। হত্যা করেছে ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ শিশু।

নেতানিয়াহু যুদ্ধের নিয়ম, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন, জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এবং গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের সতর্কতা উপেক্ষা করেছেন। ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের বিশ্বব্যাপী ব্যাপক নিন্দাকে তিনি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছেন।

ইসরায়েলের সঙ্গে আছে আমেরিকার সামরিক, আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন। ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সমর্থনে ওয়াশিংটন আরও প্রায় ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে।

এবার কি ভিন্ন কিছু হবে

পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে ইসরায়েল গাজার বিস্তৃত অংশকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। হত্যা করেছে ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ শিশু।

ইসরায়েলের পারমাণবিক সক্ষমতার কারণে নেতানিয়াহুর আস্থা আরও বেড়েছে। নেতানিয়াহু এবং তাঁর সমর্থকেরা দাবি করেছেন যে তাঁরা ইরান-সমর্থিত বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের আত্মরক্ষায় যেকোনো অস্ত্র বা শক্তির ব্যবহার বৈধ।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বেশ কয়েকটি পশ্চিমা ও আঞ্চলিক আরব মিত্র ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে। এখন হিজবুল্লাহকে উপড়ে ফেলার অসমাপ্ত কাজ আবার শুরু করতে ইসরায়েল মনোনিবেশ করেছে।

নেতানিয়াহু জানেন হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার অর্থ ইরানের জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে ফেলা। ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি নিতে তাঁর আপত্তি নেই। আর সেই কাজে পূর্ণ মার্কিন সমর্থনের আশ্বাস তো আছেই।

তেহরান হিজবুল্লাহকে ত্যাগ করবে বলে মনে হয় না। তবে তার অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারও রয়েছে। মনে রাখতে হবে, ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান রাজনৈতিক ও সামাজিক বিধিনিষেধ কমানোর এবং ইরানিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন।

পেজেশকিয়ান ইরানের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নতির জন্যও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমাদের (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে আলোচনা পুনরায় চালু করা। তাহলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়ানোর সুযোগ হবে।

পেজেশকিয়ানের এই নীতিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সমর্থন রয়েছে বলে মনে হয়। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, হিজবুল্লাহ নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম। আপাতত, তেহরানের দৃষ্টিভঙ্গি হলো ইসরায়েলকে লেবাননে আটকে রাখা।

হিজবুল্লাহ হামাস নয়

হিজবুল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখনো সে সশস্ত্র ও কৌশলগতভাবে পিছিয়ে যায়নি। দলটি ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পিছু হটবে না। এই প্রতিরোধের ফলে ইহুদি রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি হবে। অনেক ইসরায়েলির উত্তর ইসরায়েলে প্রত্যাবর্তন বিঘ্নিত হবে।

এই পর্যায়ে দুটি কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

একটি হলো এক বছরব্যাপী অভিযানের পরও ইসরায়েল এখনো হামাসের প্রতিরোধকে পুরোপুরি নির্বাপিত করতে পারেনি। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধ অনেক কঠিন এবং আরও বিপজ্জনক হতে পারে।

অন্যটি হলো নেতানিয়াহুর মতো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশও নিজের পছন্দ অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন। তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং গণতন্ত্র প্রচারের আড়ালে আফগানিস্তান ও ইরানে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।

কিন্তু আমেরিকার কর্মকাণ্ড এই অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেখা গেছে যে রক্তাক্ত যুদ্ধ, নৃশংস শক্তির প্রয়োগ পৃথিবীর সমস্যাগুলো সমাধানে কূটনীতির কার্যকর বিকল্প হতে পারেনি।

  • আমিন সায়কাল অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্টার্ন অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক

এশিয়া টাইমস থেকে নেয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন