গত ২৭ জুন ২০২৩ দ্য ডেইলি স্টার ‘গ্রাফট ইন পাবলিক হসপিটাল কস্ট টাকা ৪৫৯ কোটি ইন ফাইভ ইয়ারস’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। এ সংবাদের প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপেছে। এ লেখায় প্রকাশিত সংবাদ, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যোগাযোগ এবং জনগণের টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন প্রকাশসহ প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন প্রকাশে সাংবাদিকতার মান ও নৈতিকতার দিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) অফিস কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) ওপর ২০১৪-২০১৫ থেকে ২০১৮-২০১৯ সময়ে চারটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি এবং সংসদে তা জমা দেয়। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দ্য ডেইলি স্টার সংবাদটি প্রকাশ করে। সংবাদে অনিয়মের আর্থিক পরিমাণ, নীতিহীনতা, চাহিদাবিহীন চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ ও অব্যবস্থাপনা তুলে ধরা হয়েছে। এটি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার কোনো অনুসন্ধান নয়
বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) অফিস একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সিএজি অফিস যা পেয়েছে, দ্য ডেইলি স্টার তা ছেপেছে এবং পাঠকদের জানিয়েছে। পাঠক ও শ্রোতাকে জানানো সংবাদমাধ্যমের প্রধান কাজ। জানানোর রয়েছে অমিত শক্তি। কারণ, মানুষ একবার জেনে গেলে তাকে অজানা বানানো যায় না। অসংগত কিছু প্রকাশিত হলে অভিযুক্তরা ভয় পান, হম্বিতম্বি করেন। ভয় পান বলেই হয়তো ভয় দেখাতে চান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপনের ভাষায় ফিরে আসা যাক, যা বেশ আক্রমণাত্মক। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, অসৎ উদ্দেশ্য, অসত্য তথ্য প্রকাশ, জনস্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধ শব্দগুচ্ছের প্রয়োগ ঘটছে হরহামেশা। এর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে আলাদা করা ও লেবেলিং করার বিশেষ তৎপরতা লক্ষণীয়
দ্য ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত সংবাদটির একমাত্র উৎস নিরীক্ষা প্রতিবেদন। এখানে সাংবাদিকের নিজস্ব অনুসন্ধান থাকতে পারত, ঘটনার আরও গভীরে যাওয়া যেত। উল্লিখিত সংবাদে বেশ কটি সূত্রের ইঙ্গিত ছিল। মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সিএজি অফিস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম এসেছে। হাসপাতালের রোগী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের বক্তব্য নেওয়া যেত।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল মামলা নং-৩/২০১৭-এর ফরিয়াদি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার (জনসংযোগ) এবং প্রতিপক্ষ ছিলেন দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক। মামলাটি ছিল মূলত দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অসন্তোষ। এ মামলার যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে ডেইলি স্টার-এর পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, ‘কোনো ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বক্তব্য থাকে।’ এটি তাদের অনুসরণীয় নীতি।
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়ে প্রকাশিত সংবাদটি এক উৎস থেকে পাওয়া। এ সংবাদে কোনো মানুষের মুখ নেই। সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন গভীর সংবাদের উৎসের সন্ধান দেয়। ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে বিষয়টি আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে পারে।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৬ জুলাই ২০২৩ জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, অবজারভার, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ভোরের কাগজ ও দ্য ডেইলি সান পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন ছেপেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও তা আপলোড করা হয়েছে। সরকারি সংস্থার বিজ্ঞাপনের খরচ জনগণের পকেট থেকেই আসে। জনগণের অর্থের অপচয় না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে দুটি উন্নত বিকল্প ছিল। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃত্ব প্রণীত বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি, ১৯৯৩ (২০০২ সাল সংশোধিত)-এর অনুচ্ছেদ ১১ ও ১৭-এ এমন নির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে—
১১. ব্যক্তিবিশেষ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান অথবা কোনো জনগোষ্ঠী বা বিশেষ শ্রেণির মানুষ সম্পর্কে তাদের স্বার্থ ও সুনামের ক্ষতিকর কোনো কিছু যদি সংবাদপত্র প্রকাশ করে, তবে পক্ষপাতহীনতা ও সততার সঙ্গে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের উচিত ক্ষতিকর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান/সংস্থাকে দ্রুত এবং সংগত সময়ের মধ্যে প্রতিবাদ বা উত্তর দেওয়ার সুযোগ প্রদান।
১৭. সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত পক্ষ বা পক্ষসমূহের প্রতিবাদ সংবাদপত্রটিতে সমগুরুত্ব দিয়ে দ্রুত ছাপানো এবং সম্পাদক প্রতিবাদলিপির সম্পাদনাকালে এর চরিত্র পরিবর্তন না করা।
দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে যেহেতু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্ষুব্ধ হয়েছে, সুতরাং নিয়ম অনুসারে প্রতিবাদ ডেইলি স্টার-এ পাঠাতে হবে। ৯ জুলাই ২০২৩ ডেইলি স্টারে ‘অ্যাভার্ট অ্যান্ড আওয়ার রিপ্লাই’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো প্রতিবাদ ডেইলি স্টার পায়নি। মান পদ্ধতি অনুসরণ না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন দৈনিকে প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন ছেপেছে, যেখানে প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত আচরণবিধি অনুসরণ করা হয়নি।
আলোচনার সুবিধার্থে ধরা যাক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি প্রতিবাদটি ডেইলি স্টার পত্রিকায় পাঠাত এবং ডেইলি স্টার যদি তা না ছাপাত (যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে), তাহলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রেস কাউন্সিলের কাছে এর প্রতিকার চাইতে পারত। ইতিমধ্যে অনেক ব্যক্তি/সংস্থা বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলের কাছে এ ধরনের প্রতিবাদ চেয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে পেশাদারির পরিচয় দিতে পারেনি।
বিজ্ঞাপনের সাধারণ নীতি হলো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, এমন বিষয় প্রচার বা প্রকাশ যাবে না। বিজ্ঞাপন ও ক্রোড়পত্র নীতিমালা ২০০৮–এ বিজ্ঞাপন প্রকাশের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা আরও সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের সম্প্রচার মাধ্যমের বিজ্ঞাপন পর্যবেক্ষণ ও সমন্বিত বিজ্ঞাপন নীতিমালার আবশ্যকতা বিষয়ে গবেষণাপত্রে (সামাজিক বিজ্ঞান পত্রিকা; খণ্ড-৬, সংখ্যা-৬; পৌষ ১৪১৯) মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী উল্লেখ করেন, রেডিও ও টেলিভিশনের জন্য বিজ্ঞাপন নীতিমালা থাকলে এখনো গণমাধ্যমের জন্য সমন্বিত বিজ্ঞাপন নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের জন্য একটি সমন্বিত বিজ্ঞাপন নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপনের ভাষায় ফিরে আসা যাক, যা বেশ আক্রমণাত্মক। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, অসৎ উদ্দেশ্য, অসত্য তথ্য প্রকাশ, জনস্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধ শব্দগুচ্ছের প্রয়োগ ঘটছে হরহামেশা। এর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে আলাদা করা ও লেবেলিং করার বিশেষ তৎপরতা লক্ষণীয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ বিজ্ঞাপনে উপযুক্ত ভাষার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে আপত্তিকর শব্দ ও বাক্যবন্ধ। প্রতিবাদে বিষয় সুনির্দিষ্টকরণের চেয়ে পারিপার্শ্বিক প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। এটি ইংরেজি প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন, যা বেশির ভাগ লোক পড়তে অক্ষম। বলা যায়, এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক অপ্রয়োজনীয় চর্চা।
তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সংবাদপত্রগুলো কী বার্তা দিল? এ প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন ছাপানো কি সাংবাদিকতার মান ও নৈতিকতার দিক থেকে সমীচীন বিবেচনা করা যায়? একটি সংবাদপত্রের সংবাদের বিরুদ্ধে আরেকটি সংবাদপত্রে প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন ছাপানো কতটা রীতিসিদ্ধ?
সংবাদপত্র যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কনটেন্ট ছাপাতে পারে না। বিজ্ঞাপনের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাইযোগ্য বিষয়। বিজ্ঞাপনদাতা ছাপানোর জন্য যা দিচ্ছেন, তা-ই কি সংবাদপত্র ছাপাতে পারে? সংবাদপত্রের গেটকিপিং এবং এডিটিং অধিকার সুরক্ষিত। প্রশ্ন জেগেছে, সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রগুলো কি এসব গাইডিং প্রিন্সিপাল সচেতনভাবে উপেক্ষা করছে? কারণ, এসব সংবাদপত্রের রয়েছে সাংবাদিকতার দীর্ঘ ইতিহাস। বিষয়টি তাদের অজানা, এমন ভাবার সুযোগ কম।
জনাথন বিগন্যাল মিডিয়া সিমোটিক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিছু মতাদর্শ সমর্থন করা হয়, এরপর সমাজ এগুলো আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। সংবাদপত্রের অন্যতম কাজ হলো অন্যকে শেখানো। সংবাদপত্র প্রতিবাদ-বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে কী শেখাচ্ছে? পোস্টট্রুথ বা সত্য-উত্তর যুগের বাস্তবতায় মানুষ ফ্যাক্টসের তুলনায় ফিকশনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যম বাঁচে ফ্যাক্টের ভেতর, ফিকশনে নয়।
যাহোক, এখন বিজ্ঞাপনের যুগ, অনেকে বিজ্ঞাপন দেয়, বিজ্ঞাপিত হয়। বিনয় ঘোষ তাঁর মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত ও বিদ্রোহ বইয়ে ‘বিজ্ঞাপন ও মন’ প্রবন্ধে জনসমাজের বিনা প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন। সত্য উচ্চারণের চেষ্টা বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢেকে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কবি শঙ্খ ঘোষ ‘মুখ ডেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতায় লিখেছেন—
…একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।…
বিজ্ঞাপনের চাপে সংবাদ প্রকাশ থেকে সরে আসা যাবে না। সাংবাদিকতার পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। নৈতিকতা ও মান অনুসরণ করে সাংবাদিকতা এগিয়ে নিতে হবে।
খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ–বিশেষজ্ঞ