আপনি কি খেয়াল করেছেন, যখন আপনি ইংরেজিতে কথা বলেন, ইংরেজি শব্দগুলো উচ্চারণ করেন, তখন এক রকম বাংলা বাংলা টান চলে আসে? এই সত্য এ দেশে সবার জন্য সত্য না হলেও আমরা অনেকেই আসলে ইংরেজি ধ্বনিবিদ্যায় দুর্বল। ফনেটিক্যালি কারেক্ট না হওয়ার ফলে আমাদের আমাদের ইংরেজি শব্দের উচ্চারণগুলো ইংরেজদের মতো হয় না।
ইংরেজি শব্দ ইংরেজদের মতো করে উচ্চারণ করতে না পারায় আশপাশের অনেক মানুষ আমাদের উচ্চারণ শুধরে দিয়ে অবজ্ঞার হাসি হাসেন। সেই হাসিতে আমাদের মন কাতর হয়, সেই কাতরতা আমাদের ইংরেজি ফনেটিক্যালি উচ্চারণ করার পথে আরও বড় বাধা হয়। অনেকে ফনেটিকস শেখার চেষ্টা করি, কিন্তু আমাদের উচ্চারণে সেই বাংলা টানই রয়ে যায়। তাঁরা হাসেন এবং আমাদের মনে কষ্ট বাড়ে। সেই আমরাই, যাদের ইংরেজি শব্দের উচ্চারণে বাংলা বাংলা টান আসে, তারাই আবার ভারতীয়দের ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করি।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ইংরেজির উচ্চারণ ইংরেজদের মতো না হলে কী আসে–যায়? আমি ইংরেজিতে যা বললাম, তা কি বোঝা যায় না? বুঝতে কষ্ট হয়? আমরা ভারতীয়, নেপালি, ভুটানিদের ইংরেজি কথোপকথন তো অনায়াসেই বুঝি। বুঝি না? তাহলে বাঙালিরা বাঙালিদের উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করছি কেন? আর যারা হাসাহাসি করি, তারা কোন ইংরেজিতে কথা বলি? কোন উচ্চারণে উচ্চারণ করি? ইংল্যান্ডের? আমেরিকার? কানাডার? অস্ট্রেলিয়ার?
ভাষা হচ্ছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন, যা মানুষদের একসঙ্গে বাঁধে। ইংরেজি এখন একটা বৈশ্বিক ভাষা, যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে গিয়ে নিজ নিজ স্বকীয়তা অর্জন করে নিজ নিজ উচ্চারণের জন্ম দিয়েছে। এখন কোন উচ্চারণ সঠিক বা মানসম্মত বা বেঠিক, তা নিয়ে আলোচনা করা বা অবজ্ঞা করার সময় পেরিয়ে গেছে।
ইংরেজি যদি বৈশ্বিক ভাষা হয়েই থাকে, তাহলে এই ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা ভিন্নতা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। এই ভাষা বিভিন্ন দেশে সেখানকার স্থানীয় ভাষার প্রভাবেই বিবর্তিত হবে এবং তার উচ্চারণও তেমন হবে। সেটাই স্বাভাবিক। সেটাই সংস্কৃতির অগ্রগতির লক্ষণ। আমাদের বাংলা টাইপের ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে হাস্যরসের কারণ দেখি না। আমি কোনো ইংরেজকে ফরাসির ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে হাসতে দেখিনি।
ভাষা কখনো স্থির থাকে না। এ এক চলমান সংস্কৃতি। পানির মতো, নদীর স্রোতের মতো। ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও প্রভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলে। ইংরেজি উচ্চারণের ভিন্নতা ভাষার চলমান প্রকৃতি ও উচ্চারণের আঞ্চলিক স্বাদ অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতারই এক প্রতিফলন। এর সঙ্গে আছে নিজের সাংস্কৃতিক সত্ত্বা। আমার মতো করে ইংরেজি উচ্চারণ করতে পারা আমার নিজের সংস্কৃতির এক পরিচয়। আমি আমার মাতৃভাষা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদেশি ভাষায় কথা বলছি। এ এক অন্য রকম অন্তর্ভুক্তি।
ইংরেজদের মতো উচ্চারণ না হলেও আমরা একে অপরকে বুঝতে পারছি কি না বা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি কি না, সেটাই বড় কথা। উচ্চারণের পার্থক্য সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ইংরেজিভাষীরা একে অপরকে বুঝতে পারেন। যোগাযোগই মূল লক্ষ্য, যা উচ্চারণের পার্থক্য থাকার কারণে বোঝার বাধা সৃষ্টি করে না।
যোগাযোগ যদি কার্যকর হয়, তাহলে ইংরেজ ইংরেজ উচ্চারণের বদলে যোগাযোগের দিকে মন দেওয়াই বেশি জরুরি বলে মনে হয়। তাহলেই আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারি এবং একটু হলেও দক্ষ হতে পারি।
ভারত, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, জ্যামাইকা এবং আরও অনেক দেশে ইংরেজিতে কথা বলা তাদের মতো করে অনন্য। এই উচ্চারণগুলো বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তাহলে আমাদের সমস্যা কী? আমরা কেন কেউ বাংলা উচ্চারণে ইংরেজি বললে হাসাহাসি করি? আমরা আমাদের ক্রিকেটারদের ইংরেজি নিয়েও হেসেছি।
আমাদের দেশের মতো ইংরেজি অনেক দেশেরই মাতৃভাষা নয়, দ্বিতীয় ভাষা। দ্বিতীয় ভাষার উচ্চারণ আমকে প্রভাবিত করবে, আমার মাতৃভাষাও দ্বিতীয় ভাষাকে প্রভাবিত করবে। আমার মতো মাতৃভাষীর কাছ থেকে ইংরেজি উচ্চারণ ইংরেজদের মতো করার প্রত্যাশা এক অন্যায়।
ভারতে ইংরেজি ভাষা ব্যাপকভাবে বলাবলি হয়। ওদের অনেক নিজস্ব উচ্চারণ রয়েছে, যা আঞ্চলিক ভাষা ও উচ্চারণের ধরন দিয়ে প্রভাবিত। ভারতীয় ইংরেজি নিজেরাই নিজেদের ইংরেজিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশটির অনেক সফল পেশাদার ইংলিশ বা আমেরিকান উচ্চারণ গ্রহণ না করেও ভারতীয় ইংরেজিতে সুন্দর করে কথোপকথন ও লেখালেখি চালিয়ে সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
নাইজেরিয়া ভাষা–বৈচিত্র্যময় এক দেশ। ইংরেজি তাদের দাপ্তরিক ভাষাগুলোর একটি। নাইজেরিয়ান ইংরেজির উচ্চারণগুলো স্থানীয় উচ্চারণ ও সংস্কৃতি দিয়ে প্রভাবিত। দেশের সবাই এটি গ্রহণ করেন এবং কথা বলেন। সিঙ্গাপুরেও ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা এবং সেখানকার ইংরেজিতে স্বতন্ত্র উচ্চারণ ও শব্দভান্ডার বিকশিত হয়েছে। জ্যামাইকায় ইংরেজি জ্যামাইকান প্যাটোয়া নামে পরিচিত।
দক্ষিণ আফ্রিকা আরেক ভাষাবৈচিত্র্যের দেশ। তাদের ইংরেজির সংস্কৃতি ও ইতিহাসচর্চা চিন্তা করে দেখুন। ফিলিপাইনের ইংরেজির কথা ভাবুন। ফিলিপিনোরা কি ইংরেজদের মতো উচ্চারণ করে? ইংল্যান্ডের একেবারে কোলের কাছের একটি দেশের কথা বলি। আয়ারল্যান্ডের ইংরেজি তো শুনেছেন। আইরিশরা ইংরেজদের মতো ইংরেজি বলে না, তবে সেখানেও সবাই ইংরেজি জানে।
ভারত, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, জ্যামাইকা এবং আরও অনেক দেশে ইংরেজিতে কথা বলা তাদের মতো করে অনন্য। এই উচ্চারণগুলো বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তাহলে আমাদের সমস্যা কী? আমরা কেন কেউ বাংলা উচ্চারণে ইংরেজি বললে হাসাহাসি করি? আমরা আমাদের ক্রিকেটারদের ইংরেজি নিয়েও হেসেছি।
আমাকে ফরাসি, হিন্দি, উর্দু বা স্প্যানিশ শিখিয়ে দিন। আমি কি ওদের মতো ওদের উচ্চারণে কথা বলতে পারব? অনেক ছোট বয়স থেকে ওদের পরিবেশে বেড়ে উঠলে তবেই পারব।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে প্রথম ভাষা ইংরেজি। কিন্তু প্রতিটি দেশের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র উচ্চারণ রয়েছে এবং সব কটিই সবাই মেনে নেয়। কেউ কারও উচ্চারণ শুনে হাসে না।
অন্য কোনো ভাষার উচ্চারণের ক্ষেত্রে ভাষাগত বৈচিত্র্য গ্রহণ করাটাই হচ্ছে ভাষাগত অন্তর্ভুক্তিকে প্রসারিত করা, সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সম্মান করা এবং কার্যকর যোগাযোগকে বাড়িয়ে দেওয়া। কারও উচ্চারণের জন্য হাসা অথবা লজ্জা দেওয়া শুধুই তাদের সাংস্কৃতিক পটভূমিকে উপেক্ষা করে না, বরং অন্য ভাষা শেখা ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তাদের আত্মবিশ্বাস ও মোটিভেশনকেও ক্ষুণ্ণ করে।
আমরা বিশ্বজুড়ে ভাষার সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য উদ্যাপন করতে চাই এবং ইংরেজিকে একটি বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে দেখতে চাই, যা বিভিন্ন অঞ্চল ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন উচ্চারণকে গ্রহণ ও মূল্যায়ন করে।
আসুন, আমরা বাঙালিরা একে অপরের ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি না করে ইংরেজি ভাষা শিখে নিজের উচ্চারণেই ইংরেজি বলি।
ইকরাম কবীর গল্পকার। [email protected]