পরীক্ষার হলে পেছনের জনকে নকল সরবরাহ করে সামনের জন পৃষ্ঠার নিচে নোট লিখে দিয়েছিল, ‘তুমি লিখে সিরাজকে দিও’। পেছনের জন কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা ছাড়াই নকল কপি করায় এতটাই ব্যস্ত ছিল যে সিরাজকে দেওয়া তো দূরে থাক, বরং পরীক্ষার খাতায় হুবহু লিখে রেখে এসেছে, ‘তুমি লিখে সিরাজকে দিও’। ‘হুবহু’ এগোতে গিয়েই হয়েছে কি না, জানি না, তবে এবারের বাজেটে আমাদের সফটওয়্যার খাতেরও কিছুটা ‘সিরাজকে দেওয়া’র মতো অবস্থা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের জন্য ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এবারের বাজেট প্রস্তাবে সফটওয়্যার উৎপাদন ও কাস্টমাইজেশন সেবার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়েছে। বিদেশি কিছু সফটওয়্যারের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এমন কিছু বিদেশি সফটওয়্যারের শুল্ক আর মূসক বসানোর কথা বলা হয়েছে, যেগুলো এ দেশে তৈরিই হয় না। অদূর ভবিষ্যতে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এর মধ্যে আছে অপারেটিং সিস্টেম, ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সফটওয়্যারও।
বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে, দেশি সফটওয়্যারের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সাধারণত এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সুচিন্তিতভাবে না হয়ে ‘হুবহু’ মুখস্থ পদ্ধতিতে সে ধরনের নীতি গ্রহণ করা হলে সেটি হিতে বিপরীত ঘটায়। ব্যাপারটা দেশের জিরাফের খামারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য, বিদেশ থেকে জিরাফ আনার ওপর শুল্ক বসিয়ে দেওয়ার মতো। অথচ দেশে জিরাফের খামারের অস্তিত্ব থাকাটাই কঠিন। তার ওপর, জিরাফ আমদানি না হলেও খুব বেশি কিছু যাবে আসবে না, কিন্তু অপারেটিং সিস্টেম আর ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস বাদ দিয়ে বেশির ভাগ সফটওয়্যার উন্নয়ন বা উৎপাদন করাই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ এ মুহূর্তে ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশে সৃষ্টি হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম। বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশে প্রায় ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করে যাচ্ছেন, ভূমিকা রাখছেন বেকারত্ব হ্রাস এবং বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নে। শুধু ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা আছে লাখের ওপরে, ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম আছে কমপক্ষে দুই হাজার। ই-কমার্সসংশ্লিষ্ট পণ্য ডেলিভারি, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত আছেন হাজার হাজার প্রকৌশলী ও কর্মী। দেশের মানুষ ব্যবহার করছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস। বেকার কোনো শিক্ষার্থী অন্তত এখন রাইড শেয়ারিং বা ডেলিভারি সার্ভিস দিয়েও চলার চেষ্টা করতে পারছে। বছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার।
দেশে উৎপাদিত হয় এমন সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্কারোপ করতেই যেখানে তিনবার ভাবার কথা, সেখানে দেশে উৎপাদন হয় না, এ রকম সফটওয়্যারে শুল্ক আর করারোপ এ পর্যায়ে সমর্থনযোগ্য নয়। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সামনে রেখে অন্তত আরও কয়েক বছর এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। এতে করে শুল্ক বা কর থেকে রাষ্ট্রীয় আয় এখন কিছুটা কম হলেও, ভবিষ্যতে কয়েক গুণ বেশি হয়ে সেটি ফেরত আসবে।
এভাবে, প্রতিনিয়ত দেশে বেড়ে চলছে ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য ও পরিষেবা। এর অধিকাংশই সম্ভব হয়েছে, ডিজিটাল রূপান্তরের কারণে। এসব পরিবর্তন, ইন্টারনেট সংযোগ এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে এখন আমরা স্বপ্ন দেখছি স্মার্ট বাংলাদেশের। অথচ এসব খাত নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সংগঠনগুলো থেকে ইতিমধ্যে সফটওয়্যার বা তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বাজেট প্রস্তাবনা নিয়ে সংগত কারণেই হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। সফটওয়্যার ও সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশার প্রতি সুবিচার না করে স্মার্ট বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়ে নেওয়া যাবে?
যদিও এ খাতসংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার নির্মাতারা বেশ কিছু দিন ধরে বলে আসছেন, দেশে উৎপাদিত হয়, এমন কিছু সফটওয়্যার, যেমন ব্যাংকিং, অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার, ইত্যাদির আমদানির ওপর কর ও শুল্ক বৃদ্ধি করার জন্য। কিন্তু এই দাবির যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দেশি এ প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি এসব সফটওয়্যারের মান আগে নিশ্চিত করতে হবে। সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ, ত্রুটি দূরীকরণ, বিক্রয়–পরবর্তী সেবা ইত্যাদিতে দেশি সফটওয়্যার আগে মানোত্তীর্ণ হতে হবে; তারপর সেগুলো সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপার আসবে। তা না হলে, মানহীন সফটওয়্যার সুরক্ষা দিতে গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রাহক তথা রাষ্ট্রের নাগরিক।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যাংকিং সফটওয়্যার যেসব ব্যাংকে ব্যবহার হচ্ছে, সেসব ব্যাংক থেকে ফিডব্যাক নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে, সেগুলো কতটুকু মানসম্পন্ন। এটি ঠিক যে এই বড় বড় সেক্টরে আমাদের পদচারণা নতুন। নতুন হিসেবে এ সফটওয়্যারগুলো কিছুটা যৌক্তিক ছাড় পাওয়ার দাবি অবশ্যই রাখে; কিন্তু, ন্যূনতম একটা মান নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা না থাকলে, আমরা কখনো মান বাড়ানোর তাড়না অনুভব করব না।
অতএব, দেশে উৎপাদিত হয় এমন সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্কারোপ করতেই যেখানে তিনবার ভাবার কথা, সেখানে দেশে উৎপাদন হয় না, এ রকম সফটওয়্যারে শুল্ক আর করারোপ এ পর্যায়ে সমর্থনযোগ্য নয়। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সামনে রেখে অন্তত আরও কয়েক বছর এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। এতে করে শুল্ক বা কর থেকে রাষ্ট্রীয় আয় এখন কিছুটা কম হলেও, ভবিষ্যতে কয়েক গুণ বেশি হয়ে সেটি ফেরত আসবে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন ধরনের সাইবার নিরাপত্তা দিতে সক্ষম সফটওয়্যারও বাংলাদেশে তৈরি হয় না। বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান এই ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সারা বিশ্ব উঠেপড়ে লেগেছে, বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। অথচ সে নিরাপত্তা সফটওয়্যারের মূল্যও যদি আমাদের এখানে বেড়ে যায় এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সাইবার নিরাপত্তায় বিনিয়োগ না করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত শুধু সে প্রতিষ্ঠান হবে না, আশপাশের সবাই হবে। রাস্তায় শুধু নিজে সতর্কভাবে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা রোধ করা যায় না, সে জন্য উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির চালকদেরও সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে হয়। সাইবার আক্রমণের শিকার প্রতিষ্ঠান ডোবার সময় একা ডোবে না, আশপাশের সবাইকে নিয়ে ডোবে।
ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]