খুনের চেয়েও বেশি ভোগান্তি যেসব ‘অপরাধে’

খুন বা হত্যা সবচেয়ে বড় ফৌজদারি অপরাধ। এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অথচ বাংলাদেশের একটি আইনের অপপ্রয়োগের কারণে খুন-ধর্ষণের চেয়েও বেশি ভোগান্তিকর হয়ে উঠছে স্পিচ অফেন্স বা ‘মতপ্রকাশের অপরাধ’। আইনটি হচ্ছে বহুল সমালোচিত ডিএসএ বা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট।

খুনের মতো বড় অভিযোগেও এ দেশে ১৮ বছর বা তার নিচের (শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত) মানুষের বিচার হয় ২০১৩ সালের শিশু আইনে। সেই আইনে শিশুদের ‘বিচার’ হয় মুক্তভাবে (আটক না রেখে) এবং শিশু আদালতে, তাদের ‘শাস্তি’ হয় লঘুমাত্রায়, ‘দোষী’দের কারাগারে না রেখে রাখা হয় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র বা সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে। লক্ষ্য থাকে শাস্তি প্রদান না, বরং শিশুকে পরিচর্যা ও সংশোধন করা।

আরও পড়ুন

কিন্তু ডিএসএর অপপ্রয়োগের কারণে অনেক ক্ষেত্রে এসব সুবিধা পাচ্ছে না অল্পবয়সী অভিযুক্তরা। কাউকে কাউকে জামিন না পেয়ে জেলে থাকতে হচ্ছে বহুদিন। যেমন ১৭ বছর বয়সে করা ‘অপরাধের’ কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরাকে ডিএসএসর অধীনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকতে হচ্ছে এক বছরের বেশি সময় ধরে।

এ বছর এপ্রিল মাসে মানবজমিন-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে এমন ৬৮ জন শিশু-কিশোরের (১৮ বছর বা নিচের) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে। এদের অনেকে স্কুলের ছাত্র, বুঝে না–বুঝে ফেসবুকে প্রভাবশালীদের সম্পর্কে কোনো ছবি বা পোস্ট শুধু শেয়ার করার কারণে তাদের কারও কারও জীবনে নেমে এসেছে চরম ভোগান্তি।

রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বলেই হয়তো এসব মামলার পেছনে হয়রানির চিন্তা কাজ করেছে এবং সে অনুসারে এজাহারে অভিযুক্তের বয়স উল্লেখ করা হয়েছে। এটি সঠিক কি না, তা আদালতে পরীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত তারা জেলে থেকেছে প্রাপ্তবয়স্ক কারাবন্দীদের সঙ্গে। অনেককে থানাহাজতে একই অবস্থায় থাকতে হয়েছে গ্রেপ্তারের পরপরই।

বয়স নির্ধারণের পর শিশু আদালতে এখন এদের অনেকের বিচার চলছে। কিন্তু ডিএসএতে বর্ণিত অপরাধের জন্য কোন আইনে তাদের সাজা দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয় এখনো। শিশু আইন অনুসারে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক খুন করলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ১০ বছর। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্পিচ অফেন্সের কারণে তার শাস্তি হতে পারে ১৪ বছর বা তারও বেশি। খুনের ক্ষেত্রে শিশু আইনে দণ্ড হবে, এটি নিশ্চিত হলেও দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে এটি হবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয় অনেকের কাছে।

দেশি-বিদেশি মহলের চাপ মোকাবিলার জন্য কোনো আইনে লোকদেখানো পরিবর্তন এনে লাভ নেই। আইনগত সংস্কারের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত জনদুর্ভোগ লাভ বা জনকল্যাণ সাধন। সেটি সরকারের বিবেচনায় থাকলে প্রস্তাবিত নতুন আইনের বিষয়ে সব আইনবিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের মতামত নেওয়া উচিত। দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকায় প্রকাশিত এসব মতামত ও প্রতিবেদন সরকারের অগোচরে থাকার কথা নয়।

২.

এ সমস্যার মূলে রয়েছে ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৩ ধারা। সেখানে বলা আছে, অন্য আইনে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান থাকলেও ডিএসএ প্রাধান্য পাবে। এ ধরনের বিধান ২০১৩ সালের শিশু আইনেও রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রণীত আইন হিসেবে ডিএসএর বিধানই এখানে সাধারণভাবে কার্যকর হওয়ার কথা।

আপিল বিভাগের বিচারপতি ইমানউদ্দিনের দেওয়া একটি রায়ে অবশ্য বলা হয়েছিল, শিশু আইন শুধু শিশুদের জন্য প্রণীত বলে অন্যান্য বিশেষ আইনের মধ্যেও এটি একটি বিশেষ আইন এবং সে হিসেবে এটি যেকোনো আইনের ওপরে প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ এই রায় অনুসারে ডিএসএর অধীনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার, আটক, জামিন, বিচার সব ক্ষেত্রেই শিশু আইনের প্রাধান্য থাকার কথা। কিন্তু প্রয়োগ ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে প্রধানত দুটি কারণে। এক. আপিল বিভাগের এই রায় সম্পর্কে পুলিশের অনেকের অসচেতনতার কারণে। দুই. এজাহারে ইচ্ছেমতো বয়স উল্লেখ করলেও পুলিশের জাবাদিহির বিধান ডিএসএতে না থাকার কারণে।

সমস্যা হচ্ছে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও প্রায় অবিকলভাবে ডিএসএর ৩ ধারাকে রাখা হয়েছে। ডিএসএর ওই ধারায় শুধু তথ্য অধিকারের বিষয়ে তথ্য অধিকার আইনের বিধান প্রাধান্য পাবে এটিও বলা আছে। ডিএসএর পরিবর্তে প্রণীত হতে যাচ্ছে যে আইন, সেই সাইবার নিরাপত্তা আইনেও ঠিক তা–ই বলা আছে। কিন্তু এ আইনে শিশু–কিশোরদের ভোগান্তি কমাতে হলে সুস্পষ্টভাবে শিশু আইনের প্রাধান্যের উল্লেখ এবং বয়স নির্ধারণে গাফিলতির ক্ষেত্রে (যেমন জন্মনিবন্ধনের বা স্কুলের সনদের তারিখ না দেখে) পুলিশের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুন

৩.

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের আরেক অপপ্রয়োগ হচ্ছে, একই অভিযোগে সারা দেশ থেকে অসংখ্য মামলা হওয়ার কারণে। খুনের মতো ভয়ংকর অপরাধে একাধিক মামলা হয়েছে এর নজির না থাকলেও বিশেষ করে মানহানির মতো লঘু অপরাধে এই আইনে কয়েক ডজন পর্যন্ত মামলা হয়, অভিযুক্তকে পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি।

উল্লেখ্য, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুসারে মানহানির মামলা করার অধিকার রয়েছে শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির। এর ২০৫ঘ ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই বিষয়ে একাধিক মামলা হওয়ার সুযোগও নেই। অথচ ডিএসএতে নেতার বিরুদ্ধে করা বক্তব্যে ‘সংক্ষুব্ধ’ হওয়ার দাবি করে একই ঘটনায় অজস৶ মামলা করেছেন প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে দমনমূলক এসব মামলা গ্রহণও করেছেন আদালত।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে মানহানি অপরাধ জামিনযোগ্য করা হলেও বাকি সব বিধান অক্ষুণ্ন রাখার কারণে উপরিউক্ত অপপ্রয়োগের সুযোগ এখনো রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনে এ ধরনের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিধান (শুধু যার ‘মানহানি’ হয়েছে, তাকে মামলা করার অধিকার প্রদান, গ্রেপ্তারের পরিবর্তে সামনের মাধ্যমে আদালতে হাজির হওয়ার বিধান, একাধিক মামলা গ্রহণের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিধান) থাকা উচিত। আরও ভালো হয়, এই আইন থেকে মানহানির মতো হয়রানিমূলক মামলার সব সুযোগ বাতিল করে দিলে।

আরও পড়ুন

৪.

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরও কিছু বড় ত্রুটি রয়েছে। এই আইনে মানহানিসহ অন্য সব অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট ও অতি সাধারণকৃত। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলা এই আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। এখন কেউ যদি গবেষণা করে দেখায় ২০১৮ সালের নির্বাচনটি অবৈধ বলে বিবেচিত হওয়ার মতো, তাহলে একেও গণতন্ত্রবিরোধী হিসেবে দেখিয়ে গবেষককে গ্রেপ্তার করা সম্ভব।

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে মামলা, গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও তদন্তে পুলিশের অবারিত ক্ষমতা। এ দুটো সমস্যার সমাধান সম্ভব, কোনো বিচারকের নেতৃত্বে প্রি-ট্রায়াল চেম্বারকে এই আইনের অধীনে মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করার মাধ্যমে।

ডিএসএতে হয়রানিমূলক মামলা হয় মূলত সাত–আটটি ধারায়। এসব ধারায় বর্ণিত কিছু কিছু অপরাধকে জামিন–অযোগ্য করা হয়েছে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে। আবার ডিএসএর অধীনে বহুল ব্যবহৃত কিছু ধারায় বর্ণিত অপরাধ (যেমন ২৬, ২৯ ও ৩৫ ধারা) প্রস্তাবিত আইনেও জামিন–অযোগ্য রয়েছে। মানুষকে অযথা হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে হলে সাইবার নিরাপত্তা আইনে বর্ণিত সব স্পিচ অফেন্স বা মতপ্রকাশের অপরাধকে জামিনযোগ্য করা উচিত।

৫.

দেশি-বিদেশি মহলের চাপ মোকাবিলার জন্য কোনো আইনে লোকদেখানো পরিবর্তন এনে লাভ নেই। আইনগত সংস্কারের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত জনদুর্ভোগ লাভ বা জনকল্যাণ সাধন। সেটি সরকারের বিবেচনায় থাকলে প্রস্তাবিত নতুন আইনের বিষয়ে সব আইনবিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের মতামত নেওয়া উচিত। দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকায় প্রকাশিত এসব মতামত ও প্রতিবেদন সরকারের অগোচরে থাকার কথা নয়।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক