আজ আমেরিকার জন্য এক প্রত্যাশিত শোকের দিন

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে কামালা হ্যারিসের সমর্থকশিবিরে বিমর্ষতা নেমে আসেছবি: এএফপি

আজ হতাশার দিন। যাঁরা আমেরিকায় কী হতে চলেছে বলে ভয় পান, তাঁদের বলা বৃথা যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়েছেন। তিনি এবং তাঁর রিপাবলিকান মিত্ররা ব্যাপক হারে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই মানুষগুলোর জীবন ধ্বংস হবে। ধ্বংস হবে পরিবারগুলো। রিপাবলিকানরা সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য আইন রদ করবেন। ভ্যাকসিন মানুষের জন্য খারাপ—এই তত্ত্বের তাত্ত্বিক রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রকে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ দেওয়ার হুমকি তো দেওয়া আছে আগে থেকেই। সামাজিক নিরাপত্তা এবং মেডিকেয়ার খাতে ব্যাপক কাটছাঁটের, ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়ন এবং ট্রাম্পের রাজনৈতিক শত্রুদের সহিংস উপায়ে দমনের প্রসঙ্গে ট্রাম্প কোনো রাখঢাক রাখেননি। প্রায় নিশ্চিতভাবে দেশব্যাপী গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হবে। নারীদের নাগরিকত্বকে আরও ক্ষুণ্ন হবে, তাঁদের মর্যাদা হরণ করা হবে। বিক্রি হবে নারীদের স্বপ্ন, নষ্ট হবে তাঁদের স্বাস্থ্য।

আমরা যাঁরা বুঝি যে ট্রাম্প কী করতে পারেন, তাঁদের জন্য আজ এক শীতল শোকের অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে। এই শোক অপ্রত্যাশিত নয়। আমেরিকায় অনেকেই উদ্বেগের সঙ্গে এই খবর পড়ছেন। তাঁরা প্রস্তুত হচ্ছেন এক অস্থির সময়ে জিঘাংসার শিকার হওয়ার জন্য। তাঁদের উদ্বেগ সত্য হবে। তাঁরা দেখবেন যে যতটুকু ভাবছেন, আগামী প্রশাসন তার চেয়ে ভয়াবহ হবে। আমি সেই সব সাধারণ আমেরিকানের কথা ভাবছি, যাঁরা এই ক্ষয়িষ্ণু দেশে উন্নতির জন্য সংগ্রাম করছেন। তাঁদের জীবন ধ্বংস হবে, নয়তো সংক্ষিপ্ত হবে।

অনেকের কাছে ট্রাম্পের এই বিজয় ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিত বিজয়ের চেয়ে বেশি কিছু হয়তো মনে হবে না। কিন্তু ২০২৪ আর ২০১৬ এক নয়। আজকের এই সময় আরও খারাপ। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সরকার এবং সুশীল সমাজ উভয় প্রতিষ্ঠানই ট্রাম্পের কর্মসূচির গতি ধীর করার বা প্রতিরোধ করার জন্য কাজ করেছিল। সেই সব প্রতিষ্ঠান আর মানুষের অনেকেই এখন ট্রাম্পের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় আর এনজিওগুলো ট্রাম্পবাদকে মর্যাদার আসনে বসাতে ছুটে আসছে। বিলিয়নিয়ার-নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কাভারেজ কমিয়ে তাঁর অপকর্ম ঢেকে রাখতে আগ্রহী। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের উসকানিগুলো প্রশাসনের কিছু মধ্যপন্থীরা সহনীয় করতে চেষ্টা করতেন। সেই সব মানুষই আর প্রতিষ্ঠান এত দিনে ঝেঁটিয়ে দূর করা হয়েছে।

ট্রাম্পকে এখন ঘিরে রেখেছে ধর্মান্ধ, ষড়যন্ত্রকারী ও মর্ষকামীরা। এরা এখন তাদের ঘৃণার লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণ করতে রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো ব্যবহার করতে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত। এমনকি ট্রাম্প নিজেও অপরাধমূলক অনাক্রম্যতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের একটি সাম্প্রতিক রায়ে প্রেসিডেন্টের কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য দায় এড়ানোর সুযোগ আরও বেড়েছে। ট্রাম্প যে এই দায় এড়ানোর জন্য কী ব্যবহার করবেন, তা ধারণাও করা যাচ্ছে না।

আমি আশা করি, এসবের পরিবর্তে আমাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছেন, আমরা তাঁদের দৃষ্টি ফেরাতে পারব। আমি বলতে চাইছি, যাঁরা ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের কথা। তাঁরা গতকালের চেয়ে আজ কম নিরাপদ। এই মানুষগুলোর আমাদের সংহতি আর মনোযোগের প্রয়োজন।

ট্রাম্প যে গোষ্ঠীগুলোকে অবমাননা করেন—অভিবাসী, নারী, প্রতিবন্ধী, কিছু নির্দিষ্ট দেশের মানুষ—ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাঁরা আবার অপমানিত হবেন। যাঁরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট নয়, তাঁদের মর্যাদা রক্ষা করতে অঙ্গীকার করলেন, এটা কি সেই মানুষগুলোর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়?

আমাদের মধ্যে যাঁরা ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক, আমরা যাঁরা যাঁরা কৃষ্ণাঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার বা নারী, আমরা ট্রাম্পের ছড়িয়ে দেওয়া ঘৃণা ও শ্রেষ্ঠতা সত্ত্বেও নিজেদের যোগ্যতা এবং নাগরিকত্বকে অর্থবহ করতে সংগ্রাম করেছি। এই মানুষগুলো এ দেশকে সমতার মুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছেন। এখন তাঁদের নিজেদের টিকিয়ে রাখার, আসন্ন সবচেয়ে খারাপ দিনগুলোতে নিজেদের নিরাপদ রাখার ছোট স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে হবে।

আমেরিকার কি ট্রাম্পই পাওনা ছিল? তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। এক তাত্ত্বিক এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বলেছিলেন যে ট্রাম্প হচ্ছেন জাতির ভেতরের রয়ে যাওয়া দানবতার প্রকাশ। এই দেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল ক্রীতদাসদের ওপর ভর করে। সেই বর্ণবাদ কী এখনো টিকে নেই? আমেরিকা কি হিংসা আর জবরদস্তির মধ্য দিয়ে তার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্য গড়ে তোলেনি? অর্থের প্রতি নোংরা ভালোবাসা এবং নীতির প্রতি নির্লজ্জ অবহেলাই কি আমাদের উচ্ছৃঙ্খল অর্থনীতির মূল প্রেরণা নয়? এবং এখনো অনেক আমেরিকান আছেন, যাঁরা এই দেশের অন্য কোনো ভবিষ্যতের আশা করেন।

তাঁদের আশার কারণ হয়তো এই যে আশা ছাড়া তাঁরা বাঁচবেন না। আগামী দিনে তাঁরা হয়তো একে অপরের ওপর আক্রমণ শুরু করবেন। উদারপন্থী ও বামপন্থীরা একে অপরের দিকে আঙুল তুলবেন। কমলার কর্মীরা তাঁদের রাজ্যে ব্যর্থতার জন্য একে অপরকে দায়ী করবেন। কেউ বর্ণবাদী খেলার আশ্রয় নেবেন। হয়তো দেখা যাবে যে আরব–আমেরিকানদের বানানো হলো বলির পাঁঠা। অনেকে বলবেন যে ডেমোক্রেটিক পার্টি গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়ে প্রচারে খুব বেশি সময় ব্যয় করেছে। এতটা না করে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।

পরাজয় হয়েছে। এখন চারপাশে অনেক দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব দোষের দিকে এই আঙুলের ইশারা আসলে মূল সমস্যা থেকেই নজর সরিয়ে দেবে। সামনে যা আসছে, সেই দুর্যোগ মোকাবিলা করার থেকে নজর এতে চলে যাবে দূরে।

আমি আশা করি, এসবের পরিবর্তে আমাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছেন, আমরা তাঁদের দৃষ্টি ফেরাতে পারব। আমি বলতে চাইছি, যাঁরা ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের কথা। তাঁরা গতকালের চেয়ে আজ কম নিরাপদ। এই মানুষগুলোর আমাদের সংহতি আর মনোযোগের প্রয়োজন। তাঁদের দিকে মনোযোগ দিলে যে আমেরিকা ডোনাল্ড ট্রাম্প ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, তার কিছু অন্তত বেঁচে থাকবে।

মোয়িরা ডোনেগান গার্ডিয়ানের আমেরিকান কলামিস্ট

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন