খাওয়ার স্যালাইনের অনন্য অর্জনটি যেন হারিয়ে না যায়

খাওয়ার স্যালাইন তৈরির সহজ নিয়মটি ঘরে ঘরে পৌঁছানোর কাজটি কিন্তু শুরুতে মোটেও সহজ ছিল না।

স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টি কর্মসূচিসহ নানান সাফল্যের গল্প আছে। তবে ডায়রিয়া প্রতিরোধে মুখে খাওয়ার স্যালাইন (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ওআরএস) বানানোর কাজটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি ছিল এক অনন্য অর্জন। এটি কেবল হাজারো শিশুর জীবনই রক্ষা করেনি, বরং নিশ্চিত করেছে একটি প্রজন্মের স্বাস্থ্য। তবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সদ্য পরিচালিত এক গবেষণায় আশঙ্কাজনক তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণা বলছে, খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেটে কী লেখা আছে, মায়েদের বড় অংশই তা পড়তে পারে না। পড়তে পারলেও পড়ে দেখে না। অনেকে ঠিকভাবে স্যালাইন তৈরি করে শিশুকে খাওয়াতে জানেন না। ভুল নিয়মে তৈরি করে ভুলভাবে খাওয়ালে যে স্যালাইন শিশুর ক্ষতি করে, তা দেশের অনেক মা-ই জানেন না। সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে।

আধা লিটার পানি, এক মুঠ গুড় আর এক চিমটি লবণের ফর্মুলা একসময় তো মানুষের মুখে মুখে ছিল। হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী সৃষ্টি ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের চরিত্র রফিক (আসাদুজ্জামান নূর) আর সাদেক আলীর (সুজা খন্দকার) সেই ‘ঘুটা…ঘুটা’ বলা বিজ্ঞাপনটি পেয়েছিল প্রবল জনপ্রিয়তা। মানুষের মধ্যে সেটি তুমুল আলোড়ন তোলে। সে সময় দেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি মানুষেরই মুখে মুখে ছিল। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেই স্যালাইন খাওয়াতে হবে, বিষয়টি রীতিমতো সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।

খাওয়ার স্যালাইন তৈরির সহজ নিয়মটি ঘরে ঘরে পৌঁছানোর কাজটি কিন্তু শুরুতে মোটেও সহজ ছিল না। মনে রাখতে হবে, আশির দশকের বাংলাদেশে সড়ক ও টেলিযোগাযোগ এবং অন্যান্য অবকাঠমো ছিল অপ্রতুল। এ ছাড়া সরকারের বার্ষিক বাজেটের আকার এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের কথা বিবেচনায় নিলে দেশব্যাপী এমন একটি কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা সরকারের একার পক্ষে ছিল রীতিমতো দুরূহ। আর সেখানেই সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিল ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান, যারা শতভাগ দক্ষতার সঙ্গে এই অসাধ্য সাধন করেছিল।

প্রসঙ্গত, সত্তর দশকে বাংলাদেশের প্রতি পাঁচজন শিশুর একজনের মৃত্যু হতো পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই। এরই মধ্যে ১৯৭৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ’ ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের সাধারণ পরিষদ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে শিশুর ‘সুরক্ষা ও বিকাশ’-এর বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অন উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ নামে একটি কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে এনজিও নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য করা হয়। তখন শিশুমৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে ব্র্যাক একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল। সেই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ডায়রিয়া।

খাওয়ার স্যালাইনের ফর্মুলাটি জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে ব্যাপক সাফল্য পেলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়াই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ব্র্যাক চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিল।

ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা গেলে অনেক শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব, এই চিন্তা থেকে আইসিডিডিআরবির সঙ্গে মিলে ব্র্যাক শুরু করে ডায়রিয়া প্রতিষেধক কর্মসূচি—ওরাল থেরাপি এক্সটেনশন প্রোগ্রাম, যেটি ‘ওটেপ’ নামেই বেশি পরিচিত। এর আওতায় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে মা ও নারীদের হাতে–কলমে আধা লিটার পানিতে এক চিমটি লবণ আর এক মুঠ গুড় মিশিয়ে স্যালাইন বানানো শেখানো হয়। ব্র্যাক ১০ বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মাকে স্যালাইন বানানোর প্রশিক্ষণ দেয়। ১৯৯০ সাল নাগাদ ডায়রিয়াজনিত শিশুমৃত্যুর হার নেমে আসে অর্ধেকে।

শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সন্দিহান থাকলেও বাংলাদেশে স্যালাইনের এই সফল ব্যবহার আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়। তখনকার বাংলাদেশের দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা, সীমিত সরকারি বাজেট এবং স্বাস্থ্য খাতের অপ্রতুল পরিকাঠামোর মধ্যেও উদ্যোগটি ছিল অভিনব।

অবশ্য ষাটের দশকের শেষ ভাগেই আইসিডিডিআরবি (ভূতপূর্ব কলেরা রিসার্চ ল্যাব) লবণ, গ্লুকোজ ও পটাশিয়ামের মিশ্রণে ওরাল স্যালাইনের ফর্মুলা উদ্ভাবন করেছিল। এই আবিষ্কারের নেপথ্যে ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সদ্য প্রয়াত জনস্বাস্থ্যবিদ রিচার্ড ক্যাশ ও ডেভিড নেলিন। কুমিল্লার মতলবের হাসপাতালে এর কার্যকারিতা নিয়ে তাঁরা বিস্তৃতভাবে কাজ করেন।

এ বিষয়ে রিচার্ড, নেলিন, রফিকুল ইসলাম ও আবদুল মজিদ মোল্লার লেখা নিবন্ধ প্রভাবশালী চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এ ছাপা হয়। ল্যানসেট সম্পাদক একে ‘শতবর্ষের শ্রেষ্ঠ’ আবিষ্কার হিসেবে মত দেন। অচিরেই এটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের যুগান্তকারী এক উদ্ভাবন হয়ে ওঠে।

খাওয়ার স্যালাইনের ফর্মুলাটি জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে ব্যাপক সাফল্য পেলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়াই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ব্র্যাক চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিল। আচরণগত পরিবর্তনের যোগাযোগ কৌশলের অংশ হিসেবে ‘ডোর টু ডোর’ ও ‘পারসন-টু-পারসন’ অ্যাপ্রোচে বাংলাদেশের প্রত্যেক মাকে শেখানো হয় স্যালাইন বানানোর কৌশল। শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং থানায় (বর্তমানে উপজেলা) প্রকল্পটি পাইলট আকারে শুরু হয়।

এর প্রধান লক্ষ্য ছিল দুটি। প্রথমত, লবণ-গুড়ের ফর্মুলাটি মাঠপর্যায়ে নিখুঁতভাবে নিয়ে যাওয়া এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেক মাকে এই ফর্মুলায় স্যালাইন বানানো শেখানো। এই কাজে যোগ দেন ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী স্থানীয় উদ্যমী কিছু নারী। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পাঠানো হতো। উদ্যমী এসব নারীকর্মীর নাম ছিল ‘ওআরডব্লিউ’(ওরাল রিপ্লেসমেন্ট ওয়ার্কার)। সহজ কথায়, মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘মনে রাখার মতো সাতটি পয়েন্ট’-এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ।

শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সন্দিহান হলেও খাওয়ার স্যালাইনের সাফল্য বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। ইউনিসেফের সাবেক নির্বাহী পরিচালক জেমস পি গ্র্যান্ট ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপিকে বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক অগ্রগতি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

খাওয়ার স্যালাইনকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি একদিনে হয়নি। এটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি এক প্রচেষ্টা।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সচিব, আমলা, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ আকবর আলি খান প্রথম আলোয় প্রকাশিত (২০২২) এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন: ‘ব্র্যাকের “ওটেপ” কর্মসূচির ফলে শুধু ডায়রিয়ার প্রভাবই কমেনি, বরং এটি বাংলাদেশের শ্রমশক্তি ও অর্থনীতিতেও ফেলেছে ইতিবাচক প্রভাব। ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কর্মক্ষমতা বেড়েছে, যা আফ্রিকার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে এগিয়ে রেখেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জনস্বাস্থ্যবিদ ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী রিচার্ড ক্যাশের সঙ্গে যৌথভাবে এ বিষয়ে আ সিম্পল সল্যুশন নামে একটি বই লেখেন। তাঁর মতে, ‘ডায়রিয়ার প্রকোপে একসময় বাংলাদেশের গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। ঘরে বসে স্যালাইন তৈরির কৌশল শেখানো এবং তা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগটি ছিল এক অসাধারণ উদ্ভাবনী পদক্ষেপ। এটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যে এক গেম চেঞ্জার হয়ে উঠেছিল।’

খাওয়ার স্যালাইনকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি একদিনে হয়নি। এটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি এক প্রচেষ্টা। যেখানে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ। ছিল মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মেধা, শ্রম আর ঘাম। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেছিলেন।

১৯৭৯ সালে যেখানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৯৯, সেখানে ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬-তে! উদাহরণটি আমাদের সফল উদ্যোগ টিকিয়ে রাখতে ধারাবাহিক মনোযোগ এবং নীতিগত অগ্রাধিকার সম্পর্কে শিখিয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ, শ্রম ও গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে যে সাফল্য অর্জন করেছিলাম, সরকারের নীতি কিংবা অগ্রাধিকারভিত্তিক কার্যক্রমের পরিবর্তনের কারণে সেসব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ কিংবা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। খাওয়ার স্যালাইনের সাফল্যও যেন হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এখনই।

  • গোলাম কিবরিয়া লেখক, গণমাধ্যম বিশ্লেষক, উন্নয়নকর্মী

  • রাব্বী আহমেদ লেখক ও উন্নয়ন গবেষক