কয়েক বছর ধরেই ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ বেন্নি মরিস ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন। আর সাম্প্রতিক কালে তিনি কোনোরকমে রাখঢাক না করেই ইরান আক্রমণ করার জন্য ইসরায়েল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে পর গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর ১ নভেম্বর হারেৎজে ‘ইরানে হামলা করার জন্য ইসরায়েল আর এখনকার চেয়ে ভালো সময় পাবে না’ শিরোনামে এক লেখায় তিনি দাবি করেন, ‘এটাই একমাত্র উপায়, যা অবশিষ্ট আছে’।
আর এ বছরের ১ জুলাই হারেৎজের ইংরেজি সংস্করণে তিনি বলেন যে ইসরায়েল যদি প্রথাসিদ্ধভাবে ইরানের পরমাণু প্রকল্পে আক্রমণ করতে না পারে, ‘তাহলে তার হয়তো রীতিবিরুদ্ধ সক্ষমতা প্রয়োগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।’ এই লেখার শিরোনামটাও ছিল খুবই উসকানিমূলক—‘টিকতে হলে ইসরায়েলকে অবশ্যই এখনই ইরানে হামলা করতে হবে।’
তিন বছর আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে হারেৎজে তিনি লিখেছিলেন, ‘সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলকে ঠিক করতে হবে যে সে কি প্রতিরোধমূলক আক্রমণে যাবে, নাকি পারমাণবিক শক্তিধর ইরানের সঙ্গে সমঝোতা করে তার ছায়ায় বসবাস করবে। এটা নির্ধারণের মুহূর্তটাও খুব কাছে ঘনিয়ে এসেছে।’
আবার প্রায় দেড় যুগ আগে ২০০৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে তিনি ইরানে পারমাণবিক হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেননা ‘এর বিকল্প হলো ইরানকে আণবিক বোমার অধিকারী করা।’ অবশ্য তখন তিনি স্বীকার করেছিলেন যে উভয় ক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্যে এক পারমাণবিক হলোকাস্ট ঘটে যাবে।
বহু ইসরায়েলি অবশ্য বেন্নি মরিসের মতোই মনোভাব পোষণ করেন। তাঁরা মনে করেন যে ইসরায়েলের উচিত ইরানে আক্রমণ করে দেশটির পরমাণু প্রকল্প ধূলিসাৎ করে দেওয়া। তাতে ইসরায়েলের নিরাপত্তা চিরদিনের মতো নিশ্চিত হবে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো দেশ আজ পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক হুমকি হয়ে ওঠেনি, প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার নিয়মিত হুমকি দেয়নি।
অবশ্য তাঁরা কেউই ইরানে হামলার পরিণতি নিয়ে ভাবিত নন। তাঁরা ধরে নিয়েছেন যে দুনিয়াজুড়ে কিছু প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া হলেও তাতে ইসরায়েলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। হাজার হোক যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তো জায়নবাদী রাষ্ট্রটির পাশে থাকবেই।
উৎসাহ যখন ওসিরাক
ইরানে হামলা চালাতে উদগ্র হয়ে ওঠা ইসরায়েলিদের কাছে ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইরাকের ওসিরাক পরমাণু প্রকল্প কেন্দ্রে সফল হামলার ঘটনাটি বিশেষভাবে উৎসাহজনক। তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনশাম বেগিনের নির্দেশে অপারেশন অপেরা বা অপারেশন ব্যাবিলনের মাধ্যমে ইসরায়েলের আটটি যুদ্ধবিমান জর্ডান ও সৌদি আরবের আকাশসীমা অতিক্রম করে ইরাকের ওসিরাকের পারমাণবিক চুল্লির ওপর বোমা ফেলে কাঠামোগুলো ধ্বংস করে দেয়।
প্রহরায় নিয়োজিত বিমানবিধ্বংসী ইরাকি কামানগুলো যখন গর্জে ওঠে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়েছে। নিরাপদে ইসরায়েলি বিমানগুলো নিজ দেশের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। বিশ্বজুড়ে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, এমনকি ইসরায়েলের ভেতরেও এ অভিযান নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। তবে ইসরায়েলের কোনো ক্ষতি হয়নি।
বরং প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো দেশে হামলা করার সক্ষমতা দেশটির আছে, সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ইসরায়েল অবশ্য এর চেয়ে বেশি জোর দেয় এ রকম হামলা করায় তার অধিকারের প্রতি, হোক তা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি লঙ্ঘন।
সময়-সময় ইসরায়েলের কথিত আণবিক অস্ত্র প্রয়োগের জন্য মরিসের আহ্বান তাঁর একটা ঘোর হয়ে গেছে। আর এটা স্ট্যানলি কুবরিক পরিচালিত সিনেমা ড. স্ট্রেনজলভের কথা মনে করিয়ে দেয়। সিনেমায় দেখানো সেই কল্পিত, পাগল ও সাবেক নাৎসি বিজ্ঞানীর মতো মরিসও উদ্বিগ্ন হওয়া বাদ দিয়ে বোমের প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন।’
আবার ওসিরাকে ইসরায়েলের সফল হামলায় ভারত একই পদ্ধতিতে কাহুতায় অবস্থিত পাকিস্তানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালানোর চিন্তা শুরু করে। এ কাজে পাশে পায় ইসরায়েলকে। কারণ, ১৯৭৯ সালের মে মাসে বেগিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে সতর্ক করেন। সে সময় তিনি লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সখ্যর কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
কাহুতায় হামলার পরিকল্পনা করা হয় ছদ্ম ইসরায়েলি হামলা হিসেবে। ভারতের ‘ইকোনমিক টাইমসের’ ২০১৭ সালের ২৪ জুনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসরায়েল গুজরাটের জামনগর বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে পাকিস্তানের কাহুতায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে, যা ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অনুমোদনও করেছিলেন।
সেটা ১৯৮৪ সালে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রিগ্যান প্রশাসন ভারতকে এ রকম বিপজ্জনক অভিযানের বিষয়ে সতর্ক করে দিলে ইন্দিরা পিছু হটেন। ওদিকে পাকিস্তানও কাহুতায় সামরিক প্রতিরক্ষা জোরদার করে সম্ভাব্য ইন্দো-ইসরায়েলের যৌথ আক্রমণের আশঙ্কায়।
ইতিহাসবিদের আবেগোন্মত্ততা
ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ বেন্নি মরিস খ্যাত হয়েছিলেন সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদ (রিভিশনিস্ট হিসটোরিয়ান) হিসেবে। তিনিসহ মোট চারজনকে এই কাতারভুক্ত করা হয়েছে ইসরায়েলের ইতিহাসকে জায়নবাদীদের প্রচলিত বয়ানের বিপরীতে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণের জন্য। বাকি তিনজন হলেন আভি শ্লেইম, ইলান পেপে ও সিমাহ ফ্লাপান।
’৮০-র দশকে তাঁদের চারজন চারটি বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের নয়া ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁরা নন্দিত ও নিন্দিত হন। তাঁদের মূলকথা হলো: ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে যে তাদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে শরণার্থী বানানো হলো, তা ছিল জায়নবাদী পরিকল্পনার অংশ। তবে শ্লেইম ও পেপের সঙ্গে এ নিয়ে কিছুটা দ্বিমত করে মরিস বলেন যে এটা যুদ্ধ বাধার ফল হিসেবে ঘটেছিল যদিও ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের বিষয়টি অস্বীকারের উপায় নেই।
তবে বেন্নি মরিস সম্প্রতি কেন ইরানে হামলার জন্য এবং পারমাণবিক বোমা হামলার জন্য, এতখানি আবেগোন্মত্ত বা হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো হয়ে পড়লেন, তা অনেকেরই প্রশ্ন। হারেৎজে প্রকাশিত তাঁর লেখা দুটি পড়ে অনেক ইসরায়েলি এ রকম মন্তব্যও করেছেন যে তিনি বিভ্রান্ত ও অন্যদের বিভ্রান্ত করছেন।
মরিস দাবি করেছেন যে ইরানে পরমাণু হামলা চালালে ‘ইসরায়েল হয়তো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, ক্যাম্পাসের অজ্ঞ ও বুদ্ধিহীন যুবক এবং বিভিন্ন বৈশ্বিক নেতাদের কাছ থেকে তীব্র নিন্দাবাদের সম্মুখীন হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকের কাছ থেকে সক্রিয় সমর্থন না পেলেও অন্তত উল্লেখযোগ্য সহানুভূতি মিলবে।’
ইসরায়েলি গবেষক অ্যাডাম রাজ ২ জুলাই হারেৎজে এক পাল্টা নিবন্ধে প্রশ্ন করেছেন, ‘১৯৪৫ সালের আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত লঙ্ঘিত হয়নি এমন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নিষেধ ভঙ্গ করলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুধু কিছু অভিযোগই উঠবে? এটা একটা ভিত্তিহীন উপসংহার।
মরিস তো পারমাণবিক হাতিয়ার ব্যবহারের রাজনৈতিক, কূটনীতিক ও সামরিক গুরুত্ব বোঝার তাগিদই অনুভব করেননি। এটা তাঁর মাথায় নেই যে কোনো সরকারের (হোক গণতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী) এ রকম বোমা ব্যবহারের বৈধতা নেই। বরং পারমাণবিক বিস্তার রোধের আন্তর্জাতিক প্রয়াস চলমান আছে। আর ইরানে পারমাণবিক বোমা ফেলে ও নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যাবে? এ রকম একটি বোমার ব্যবহারের পরামর্শে কেউ কি শিহরিত না হয়ে থাকতে পারে?’
রাজ আরও বলেছেন যে ইসরায়েলিদের এক বড় অংশই এখন মনে করছেন যে কূটনৈতিক অবস্থান থেকে ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে’। তাই তাঁরা বিনাশ সাধনের আলাপচারিতাকে স্বাভাবিক ও বৈধ বলে ধরে নিয়েছেন। মরিস ও তাঁর মতো আরও অনেকে রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় ফেটে পড়েছেন আর সবকিছু বিনাশের নীতি গ্রহণ করেছেন।
রাজের ভাষায়, ‘৭ অক্টোবরের গণহত্যা বহু মানুষের যৌক্তিক বিবেচনা-বোধের ক্ষয় ঘটিয়েছে। যখন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছিলেন যে গাজাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হবে, তিনি ইসরায়েলি জনগণের কাছ থেকে এর বৈধতা পেয়েছিলেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে গাজায় বিমান হামলা বামপন্থীদের কাছ থেকেও তেমন কোনো সমালোচনার মুখে পড়েনি।
বিপরীতে এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে যে মোসাদের সাবেক পরিচালক তামির প্রাডো প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলছেন যে এভাবে বোমাবর্ষণ ছিল প্রতিশোধের আক্রমণ, যা পরিস্থিতিতে আরও জটিল করেছে এবং আমরা যা চেয়েছিল, তা অর্জন করার ক্ষেত্রে আমাদের সামর্থ্যকে বড় পরিসরে নস্যাৎ করে দিয়েছে।’
অবশ্য মরিসের এই হিস্টিরিয়া গোছের আচরণের আভাস দেড় যুগ আগে চিহ্নিত করেছিলেন ইসরায়েলি সাংবাদিক ইয়োসি মেলম্যান। গত ৪ জুলাই হারেৎজে আরেক নিবন্ধে তিনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। সেটা হলো, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ইরানের পরমাণুবিরোধী একটি অনুষ্ঠানের। সেখানে তিনি ও মরিস আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
মরিস একপর্যায়ে ইসরায়েলকে ইরানের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলার আহ্বান জানান। মেলম্যান লিখেছেন, ‘উপস্থিত দর্শকেরা, যারা প্রায় সবাই কট্টর ইসরায়েলি সমর্থক, এই আহ্বানে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর যখন আমার কথা বলার পালা আসে, আমি আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি যে এ ধরনের আহ্বান কতটা ভয়াবহ এবং একই সঙ্গে একটি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত, মরিয়া ও পলাতক মনোবৃত্তির নির্দেশক।’
মেলম্যানের মতে, মরিসের রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান একদিকে চরমপন্থীর মতো, অন্যদিকে আশ্চর্যজনকভাবে বিভ্রান্তির। একদিকে তিনি ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় এই ভূমি থেকে আরবদের বিতাড়নে ইসরায়েলিদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর মতো পাল্টা দাবি করেছেন যে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়াটা যৌক্তিক ছিল।
মেলম্যান আরও লিখেছেন, ‘আজকে মরিস যে ইরানের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের কথা বলছেন, প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আজ পর্যন্ত এ রকম কোনো পরামর্শ দেননি। তাঁর এই চিন্তা খাপ খায় ট্যালি গোটলিভ ও এমিচাই এলিয়াহুর মতো চরম ডানপন্থী আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে যারা পারমাণবিক বোমা মেরে গাজা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সময়-সময় ইসরায়েলের কথিত আণবিক অস্ত্র প্রয়োগের জন্য মরিসের আহ্বান তাঁর একটা ঘোর হয়ে গেছে। আর এটা স্ট্যানলি কুবরিক পরিচালিত সিনেমা ড. স্ট্রেনজলভের কথা মনে করিয়ে দেয়। সিনেমায় দেখানো সেই কল্পিত, পাগল ও সাবেক নাৎসি বিজ্ঞানীর মতো মরিসও উদ্বিগ্ন হওয়া বাদ দিয়ে বোমের প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন।’
আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক।