প্রথমেই সবার একটি ভুল ধারণা ঠিক করে নিই। আমরা সাধারণত চাকরিজীবীদের দুই ভাগে ভাগ করি, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও সরকারি কর্মকর্তা বলে কিছু নেই, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং সরকারি চাকরি আইনেও কর্মকর্তা বলে কিছু নেই। এখন দেখে নিই, কী আছে সংবিধানের ২১(২) ধারায়, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’
আর আমরা সব ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে ওপরে ওঠাতে ওঠাতে আসলে কোথায় নিয়ে গেছি, তা এখনকার পত্রিকা দেখলেই বোঝা যায়। জনগণের সেবক কথাটাই এখন হারিয়ে গেছে মানুষের মুখ থেকে, মন থেকেও। বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষের মনের মধ্যে ঔপনিবেশিক নতজানু ভাব এতটাই ঢুকে গেছে যে সবাই এই সুযোগ নেয়।
কিছুদিন ধরেই আমাদের এসব কর্মচারীর নিজ ‘উন্নয়ন’ কার্যকলাপের সংবাদে পত্রিকা সয়লাব। এখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তাঁদেরই এই সম্পত্তি, তাহলে তাঁরা যাঁদের অধীন, তাঁদের কত সম্পত্তি! আপনি যদি শীর্ষ অবস্থানে থাকেন, অবশ্যই আপনার অধস্তন কে কী করছেন আপনি বুঝতে পারবেন, এটাই ম্যানেজমেন্টের বাস্তবতা।
কিন্তু যদি আপনি সেটা টের না পান, এটা আসলে আপনারই ব্যর্থতা। আর ব্যর্থতা মেনে আসলে আপনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত অথবা অধস্তনকে বরখাস্তের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত আসা উচিত। কিন্তু এখানেই কবি নীরব।
আমাদের দেশে সরকারি কর্মচারীদের চাকরি যাওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। এমনও দেখা যায়, অনেকে চাকরি ছেড়ে গেছেন, পরে আবার আদালতের মাধ্যমে চার থেকে পাঁচ বছর আগের সব বেতনসহ ফেরত আসছেন। আমাদের এত এত অপচয়ের প্রজেক্ট হচ্ছে, ব্যর্থতার জন্য কারও কখনো কোনো শাস্তি হয়েছে?
আর অপসারণের প্রক্রিয়া এতই ঝামেলার, এত এত দুর্নীতিতে কয়জন অপসারিত হয়েছে? এটা এমন একটি মেশিন, যেখানে আপনি ঢুকলেন এবং আপনার বয়স না হওয়া পর্যন্ত সেই মেশিন চলতেই থাকল। এই সুযোগই অনেকে নিচ্ছে, ভবিষ্যতেও নেবে যত দিন এই চাকরি কর্মদক্ষতাভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক করা না হবে।
আপনারা কি দেখেছেন ভারতের গত ২৫ বছরের পরিবর্তন? কারণ হচ্ছে, ভারতের সরকারি চাকরি হয়ে গেছে অনেকটা চুক্তিভিত্তিক, আপনি কাজ করলে তা নবায়ন করা হবে, না হলে টা টা। এটাই আসলে একমাত্র উপায় এই সিস্টেমকে ঠিক করার। ভারত পারলে আমরা পারব না কেন? এর ফলে সৎ কর্মচারীরা অনুপ্রাণিত হবেন, নিজের উত্তম ভবিষ্যতের জন্যই তাঁরা কাজ করবেন, দেশ হবে গতিশীল।
যখন শেষবার বেতন স্কেল দেওয়া হলো, তখন বলা হলো, বেতন বাড়লে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু আমরা বরাবরই দুর্নীতিতে প্রথম দিকেই থেকে গেছি। এই সময়ের মধ্যে গণতন্ত্র হারিয়ে গেল, বাক্স্বাধীনতা কমে গেল, ফলে সংবাদমাধ্যমেও দুর্নীতি নিয়ে আসা খবর কমে গেল।
মাঝেমধ্যে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক তো থেকেও না থাকার মতো। ফলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য ও আশকারা আরও বেড়ে গেল।
২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হলফনামা এবং প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এখন তা উধাও। যদিও হিসাব দিলেও কিছু হয় না। প্রতিবছর নির্বাচনের আগে এমপি প্রার্থীরা সম্পদের হিসাব দেন। সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রায় সবারই প্রকাশ্য আয় কয়েক শ শতাংশ বাড়ে। কোনো তদন্ত হয়? তাই হিসাবের সঙ্গে তদন্তও বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ক্ষমতার আশপাশে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তিও হু হু করে বাড়তে থাকল। তাঁরা শুধু বিদেশেই সম্পদ গড়ছেন না, নিচ্ছেন দ্বৈত নাগরিকত্বও। কিন্তু ক্ষমতার পাশে থাকার কারণে তাঁদের সাত খুন মাফ।
খেয়াল করে দেখুন, সম্প্রতি কীভাবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নাম আসছে? দুজনের নাম মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে অনেক কিছু। সেখানে সিটিজেন জার্নালিজমের মাধ্যমেও আরও মানুষের দুর্নীতি প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সরকার কী করেছে? দুর্নীতিবাজদের কি ধরতে পারছে তারা? আগেই বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। বিদেশে চলে যাওয়ার পর বরং দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা আসছে।
প্রথমেই সিস্টেমের কথা বলেছি। এখন দেখি, সরকার আর কী কী কাজ করেছে। আমাদের দেশ ধুঁকছে টাকা পাচারের জন্য। ২০২১ সালে সরকার তদন্তে ২৮ পাচারকারীর নাম পায়। একজন মন্ত্রীই বললেন, তাঁদের বেশির ভাগই সরকারি কর্মচারী। কিন্তু এত দিনে একজনও কি শাস্তি পেয়েছেন? পাননি। এমনকি নাম প্রকাশও করা হয়নি।
২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হলফনামা এবং প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এখন তা উধাও। যদিও হিসাব দিলেও কিছু হয় না। প্রতিবছর নির্বাচনের আগে এমপি প্রার্থীরা সম্পদের হিসাব দেন। সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রায় সবারই প্রকাশ্য আয় কয়েক শ শতাংশ বাড়ে। কোনো তদন্ত হয়? তাই হিসাবের সঙ্গে তদন্তও বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এদিকে দুদক সরকারের অনুমতি ছাড়া তদন্ত করবে না। এখন সরকারের কাছে কি আসলেই তথ্য নেই? ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার তথ্য প্রকাশের জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তার মানে পুলিশের কাছেই তথ্য আছে। কিন্তু তারা এই তথ্য চেপে গিয়ে দেশপ্রেমীর কাজ করা মানুষকেই শাস্তি দিচ্ছে? হতে পারে সেই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, তাহলে আছাদুজ্জামান মিয়া কী করেছেন?
এরপর বিভিন্ন খাতে দেওয়া আছে ইনডেমনিটি। দেশের বিশাল বিশাল ক্ষতি, তা থেকে প্রাপ্ত সুবিধা ও সরল মনের ভুল হিসেবে চালিয়ে যাওয়া। যেখানে জবাবদিহি থাকে না, সেখানে দুর্নীতি থাকবেই। আর এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তো সাংবাদিক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকার কৌশল নিয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকে চোরের গলায় মালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘আমি চোর’। এখন দেশে চোরকে চোর বলার সৎ সাহস কারও নেই। সবাই ব্যস্ত সুবিধাভোগী শ্রেণিকে তোয়াজে, যদি সুযোগ পাওয়া যায় কিছুর। যার কারণে কোনো কর্মকর্তার পদোন্নতি বা নতুন দায়িত্ব গ্রহণে অভিনন্দনের বন্যা বয়ে যায়। তাদের সঙ্গে একটি ছবি বা সেলফি তুলতে পারলে যেন অনেকের জীবন ধন্য হয়ে যায়! সেই ছবি তুলেও অনেকে করেন ক্ষমতাচর্চা।
এই অরাজকতার মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার গুরুত্ব বাড়ছে। সেখানে সাইয়েদ আবদুল্লাহ, আজাহার উদ্দীন অনিকদের মতো সাহসী তরুণেরা যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু সেসব তরুণও নানাভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে তাঁদের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা চলছে। এই জায়গায় কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নীরব। যেখানে সামান্য একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য আইন খড়্গহস্ত হয়ে যায়, সেখানে এসব সাহসী তরুণকে যেভাবে মানসিকভাবে হয়রানি করা হয়, এর জন্য কিছুই করার কেউ নেই।
ক্ষমতার দাপট ও এসব দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীর জন্য সৎ কর্মচারীরা হচ্ছেন বঞ্চিত, দেশের মহামূল্যবান টাকা হচ্ছে পাচার, অনেক সাধারণ মানুষ হচ্ছে নিপীড়নের শিকার, দেশের সবকিছু চলে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাভোগীদের কাছে। মানুষ ভুলে গেছে নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকারের কথা। সরকার কি আসলে এসব কর্মকর্তা দিয়ে দেশ চালাতে পারছে? ক্ষমতায় টিকে থাকা ছাড়া আর কিছুই তো ঠিকমতো চলছে না, এটিই মনে করেন অনেকে।
আমি এই টাকার হিসাবকে বোঝার জন্য শুধু ছোট একটি উদাহরণ দিই, যাতে কোটি টাকা মানে আসলে কী, সেটা বোঝেন। বিভিন্ন হাসপাতালে বার্ষিক যে ওষুধ, অক্সিজেন, রোগ পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, এক্স-রে ফিল্ম, ইসিজি পেপার, আলট্রাসনোগ্রাফি পেপার, তুলা–ব্যান্ডেজ–গজ, মানে চিকিৎসা-সম্পর্কিত যা কিছু ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে বলা হয় মেডিকেল সার্ভিসেস রিক্যুইজিটস বা এমএসআর।
এখন মোটামুটি এক–দেড় লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট উপজেলার একটি হাসপাতালে এই এমএসআরের জিনিস কেনাকাটার বাজেট থাকে ৬৫ লাখ থেকে ৭০ লাখ টাকার কাছাকাছি। এখন এই বরাদ্দ বিভিন্ন উপজেলায় অবস্থানগত হিসাবে কমবেশি হয়, আবার কিছু উপজেলায় যেখানে বড় ওটি কমপ্লেক্স থাকে, সেখানে বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়। লাখ জনসংখ্যা হিসাবে প্রতিজনের জন্য তাহলে বরাদ্দ থাকে ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মতো, পুরো এক বছরে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। এই বাজেটও অনেক জায়গাতেই সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় না, নানা রকম ফাঁকফোকর আর লোপাট হয় এখানে।
মানে চিন্তা করেন, একটি হাসপাতালে সারা বছর যে জীবন রক্ষাকারী কার্যক্রম চলবে, ওষুধ-অক্সিজেন সব মিলিয়ে যা খরচ হবে, তার চেয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তার এক পক্ষের কোরবানির খরচ বেশি। যাঁর মূল বেতন ৮০ হাজার টাকার কাছাকাছি হবে। দুর্নীতি বুঝতে আর কিছু কি লাগবে আপনাদের? আমরা আসলে সেই সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের লাটসাহেবের কুকুরের কয়টা পায়ের সমান, কেউ কি একটু হিসাব করে দিতে পারবেন?
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক
[email protected]