তালেবানের হাত থেকে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যাচ্ছে

আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী গোষ্ঠিগুলোর শক্তি বাড়ছেছবি : এএফপি

দ্বিতীয় পর্যায়ের শাসনের তৃতীয় বছরে এসে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ওপর বিরোধিতার মাত্রা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এই বিরোধিতা আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

২০২১ সালের আগস্টে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি করে সরে আসার সময় ট্যাংক, যুদ্ধবিমানসহ যেসব সমরাস্ত্র ফেলে যায়, সেগুলো দিয়েই তালেবান যোদ্ধারা সম্প্রতি তাঁদের ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বছর পূর্তি উদযাপন করেছেন।

কিন্তু এই উদ্‌যাপন ও সামরিক শক্তি প্রদর্শন সত্ত্বেও তালেবান যোদ্ধারা একাধিক ফ্রন্টে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট খোরাসানকে (আইএস-কে) বাগে আনতে ব্যর্থ হয়েছে তালেবান।

২০২১ সালের ২৬ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে ভয়াবহ বোমা হামলার জন্য আইএস-কে দায়ী করা হয়। হামলায় ১৭০ জন আফগান ও ১৩ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিলেন। কাবুল থেকে পশ্চিমা বাহিনীগুলো সরিয়ে নেওয়ার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটেছিল।

আইএস-কে সন্ত্রাসী হামলা অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জানুয়ারি মাসে কাবুলে হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, এপ্রিল মাসে হেরাথে সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে হামলা করে ছয়জনকে হত্যা এবং মে মাসে বামিয়ানে তিনজন স্প্যানিশ পর্যটককে হত্যা।

এ মাসেই কাবুলের একটি জনবহুল বাজারে বিস্ফোরণে ১১ জন আহত হওয়ার ঘটনার পেছনে আইএস-কে দায়ী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

আইএস-কে তাদের শক্তি বাড়াচ্ছে। গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করেছিল যে তালেবানের অসন্তুষ্ট কর্মীদের দলে ভেড়াচ্ছে আইএস-কে। তারা আরও সতর্ক করেছিল, তালেবানের গোয়েন্দা শাখা (জিডিআই) ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আইএস-কে এর অনুপ্রবেশ ঘটছে। জুলাই মাসে জিডিআই থেকে আইএস-কে-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে সন্দেহভাজন ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারির সময়, একজন তালেবান কমান্ডারের একটি বক্তব্য খুব বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের কাঠে ঘড়ি আছে, আর আমাদের আছে সময়’। আফগানিস্তানের নাজুকতা বোঝাতে এটা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

তালেবান সরকার চাইছে আন্তর্জাতিক পরিসরে বৈধতা। কিন্তু তালেবানের এই চাওয়াকে ব্যঙ্গ করে প্রত্যাখ্যান করেছে আইএস-কে। তারা বলছে যে তালেবান পশ্চিমাদের কাছে নতি স্বীকার করেছে। আইএস-কে-এর এই অবস্থান অনেক অসন্তুষ্ট আফগানকে দলে টানতে প্রভাবিত করছে।

একই সঙ্গে তালেবান শাসকেরা ইসলামিক স্টেট খোরাসানকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টিও অনেক আফগানের চোখে শাসকদের দুর্বলতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ফলে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসার পর স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিয়ে তালেবান যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তারা।

অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধও বাড়ছে। সাবেক জেনারেল ইয়াসিন জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত তালেবানবিরোধী শক্তি আফগানিস্তান ফ্রিডম ফ্রন্ট (এএফএফ) দেশজুড়ে তালেবানের ওপর হামলা বাড়িয়েছে।

গত ১৫ দিনে এএফএফ গোষ্ঠীটি ৭ প্রদেশে ১৫টির বেশি হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে ফরিয়াব প্রদেশে একটি সামরিক কম্পাউন্ডে হামলায় দুজন তালেবান সেনা নিহত হন। এ ছাড়া কাবুল বিমানবন্দরের সামরিক বিভাগে তারা রকেট হামলা করেছে।

এর আগে গত ১৮ অক্টোবর এএফএফ তালেবানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হামলা করেছিল। সেই হামলায় চারজন তালেবান যোদ্ধা হন। হামলার পর এক বিবৃতিতে এএফএফ বলে, তালেবানের নিরাপত্তা নিয়ে ‘মিথ্যা বিভ্রম ভেঙে পড়েছে’।

এএফএফ গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানের ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের (এনআরএফ) সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের অন্যতম নেতা ও আফগান নায়ক আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদ এখন এনআরএফের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

এনআরএফ দিন দিন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। ২৪ অক্টোবর তারা কাবুল ও ফরিয়াব প্রদেশে হামলা করে। সেই হামলায় ছয়জন তালেবান যোদ্ধা নিহত হন। এর দুই দিন আগে ২২ অক্টোবর ফারাহ প্রদেশে আরেক হামলায় একজন তালেবান যোদ্ধা প্রাণ হারান।

সবকিছু বিবেচনায়, তালেবানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর আত্মবিশ্বাস বাড়ছেই। তালেবানের ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বছর পূর্তিতে এএফএফ এক বিবৃতিতে তালেবানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আরও ‘ঐক্য, সংহতি ও জোটবদ্ধতার’ ডাক দিয়েছে। নির্বাসিত ওয়ারলর্ড আবদুল রশিদ দোস্তম সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় তালেবান সরকার উৎখাতের আহ্বান জানান।

তালেবান এখনো বিরোধীদের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারছে, কিন্তু তাদের আন্তর্জাতিক বৈধতার কমতি আছে। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে আফগানিস্তানের আসন ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানাতে আমরা দেখেছি। এ ঘটনা তালেবান শাসকদের প্রতি চলমান অপমানের ধারাবাহিকতা।

কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারের স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী নয়। সম্প্রতি ব্রিকস সম্মেলনে প্রতিবেশী ভারত ও চীন বলে দিয়েছে যে নারীদের প্রতি আচরণ উন্নত ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত না করলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না।

তালেবান সরকারকে যত দিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৈধতার কমতি থাকবে, তত দিন প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো তাদের দুর্বল করতে উৎসাহিত হবে। ২০০১ সালের মতো তালেবানবিরোধী এই গোষ্ঠীগুলোকে যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমর্থন দেয়, তাহলে তারা সত্যিকারের বিপদে পড়বে।

তালেবান শাসকেরা এই পরিস্থিতিতে তাদের কঠোরতা বাড়িয়েছে। সম্প্রতি জীবন্ত জিনিসের ছবি নিষিদ্ধ করে তালেবান সমাজের মধ্যে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। টেলিভিশন, কম্পিউটার, মুঠোফোনে ছবি ও ভিডিও প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। টেলিভিশনগুলোকে এখন বাধ্যতামূলকভাবে শুধু অডিও প্রচার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। গত বছর তালেবান গানকে নিষিদ্ধ করে।

সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজকে লক্ষ্যবস্তু করা অব্যাহত রেখেছে তালেবান। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের তথ্য বলছে, ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৪১ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

নারীদের ক্ষেত্রে বলা চলে, তালেবান তাদের জীবনের ওপর প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রায় সব ধরনের শিক্ষা এবং প্রায় সব খাতের চাকরি নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিউটি পারলার ও ন্যাশনাল পার্কে নারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর তাঁদের ওপর নৈতিকতা আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। জাতিসংঘ বলছে, পরিস্থিতি ‘বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ’।

তালেবানের এই দমন–পীড়ন তাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন প্রতিরোধের জন্ম দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারির সময়, একজন তালেবান কমান্ডারের একটি বক্তব্য খুব বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের কাঠে ঘড়ি আছে, আর আমাদের আছে সময়’। আফগানিস্তানের নাজুকতা বোঝাতে এটা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

আফগানিস্তানে স্থানীয় শাসক ও বিদেশি সম্রাট শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একজনের পর অন্যজন আসা-যাওয়া করেছে। তালেবান শাসন ঘিরে সম্ভবত এখন ঘড়ির কাটা ও সময় ঘুরছে।

  • ক্রিস ফিটজেরাল্ড, রাজনীতি, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ের লেখক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত