অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক দুটি সিদ্ধান্ত—শুল্ক-কর বৃদ্ধি এবং টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি বন্ধ—স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় নীতির অদূরদর্শিতা এবং অসামঞ্জস্যের প্রতিফলন। প্রথম সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শতাধিক পণ্যের ওপর শুল্ক-কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
মূল্যস্ফীতির উচ্চ মাত্রা বর্তমানে সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে, এবং এভাবে শুল্ক-কর বাড়ানো আরও বেশি চাপ তৈরি করবে। এর ফলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, যা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
এটি সত্যিই অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এবং উদ্বেগজনক যে বর্তমান সরকার কর আয় বাড়ানোর জন্য পরোক্ষ করের ওপর অতিমাত্রার নির্ভরতা আরও বাড়াচ্ছে। পরোক্ষ কর সাধারণত সাধারণ জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কারণ, এসব কর সরাসরি পণ্যের মূল্য বা সেবার সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং জনগণ এগুলোর পুরো বোঝা বহন করে।
বিশেষ করে যখন মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের কর বৃদ্ধির ফলে গরিব ও মধ্যবিত্ত জনগণের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। অথচ সরকার যদি তাদের রাজস্ব নীতির পুনর্বিবেচনা করে এবং ধনীদের কাছ থেকে আরও কর আদায় করার পথে পদক্ষেপ নেয়, তবে তা বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।
টিসিবির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের জন্য সহায়তার পরিসর সংকুচিত করা হয়েছে, যা মূলত সরকারের অর্থনৈতিক নীতি এবং জনগণের প্রয়োজনের মধ্যে তীব্র বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপে শুধু দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে না, বরং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাসও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
বর্তমানে, দেশে কিছু ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দেয় বা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কর রেহাই পেয়ে থাকে। এরা উচ্চ মূল্যের পণ্য ও সেবা বিক্রি করলেও, তাদের আয় ও সম্পত্তির ওপর যথাযথ কর আদায় করা হয় না।
এই বৈষম্য সমাজে ন্যায্যতা ও আস্থা নষ্ট করে এবং দেশীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। যদি সরকার তাদের কর ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর পদক্ষেপ নিত এবং কর ফাঁকি দেওয়া ধনীদের থেকে প্রকৃত কর আদায় করত, তবে সরকারের রাজস্ব আয় আরও শক্তিশালী হতে পারত। বিশেষ করে, যারা অবৈধভাবে কর ফাঁকি দেয়, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব।
এভাবে সরকার যদি পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় বৃদ্ধি করতে পারত, তবে তা দেশের অর্থনীতিকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ এবং স্থিতিশীল করে তুলতে পারত। জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমতার ভিত্তিতে কাজ করা সরকারের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য বয়ে আনতে পারে। কিন্তু যদি সরকার শুধু পরোক্ষ করের ওপর অতিরিক্ত চাপ দেয়, তাহলে তা কেবল সাধারণ মানুষের জন্যই নয়, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে।
অন্যদিকে, টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি গভীরভাবে উদ্বেগজনক। টিসিবির এই কর্মসূচি দরিদ্র জনগণের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। যেখানে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং মানুষের আয় স্থিতিশীল নয়, সেখানে এই কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার দরিদ্র জনগণের সহায়তা বাড়ানোর সুযোগ পেত। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তটি একে অপরের সঙ্গে মিল রেখে চলা বাস্তবতার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।
টিসিবির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের জন্য সহায়তার পরিসর সংকুচিত করা হয়েছে, যা মূলত সরকারের অর্থনৈতিক নীতি এবং জনগণের প্রয়োজনের মধ্যে তীব্র বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপে শুধু দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে না, বরং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাসও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এই সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো সঠিক সমন্বয় নেই। সরকারের উচিত ছিল, এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে দরিদ্র ও সাধারণ জনগণের সহায়তার পরিসর বাড়ানো এবং বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
কিন্তু সরকার এই পরিস্থিতিতে আরও কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা জনগণের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। সরকারের উচিত ছিল তাদের রাজস্ব নীতি পরিবর্তন করে সরাসরি প্রভাবিত জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপ না বাড়িয়ে, কর আদায়ে ধনী শ্রেণির ওপর নির্ভর করে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় দ্রুত হবে এবং তারা জনগণের প্রকৃত প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর ও সদর্থক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
সেলিম রায়হান নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং (সানেম)