গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বাতিল করে দেওয়ার পর আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকা এবং নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে দুটি ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। প্রথমটি ইসির জন্য ইতিবাচক।
এই ব্যাখ্যা হচ্ছে যে নির্বাচন কমিশন প্রায় অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়েছে এবং অত্যন্ত সাহসিকতা দেখিয়ে নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছে। আরপিও-র ৯১ই ধারায় কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, নির্বাচন কমিশনাররা তা প্রয়োগ করেছেন। এই আসনে পাঁচজন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রার্থী ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের, সেহেতু এ সিদ্ধান্ত আসলে কমিশনের নিরপেক্ষতাই প্রমাণ করে।
এই ব্যাখ্যার পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফের প্রতিক্রিয়াকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, গাইবান্ধায় সবকিছু ঠিক ছিল, তারপরও কেন ভোট গ্রহণ বাতিল হলো, তা তাঁর কাছে ‘বোধগম্য নয়’ (প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০২২)।
এর ঠিক বিপরীতে যে ব্যাখ্যা, তা নির্বাচন কমিশনের জন্য ইতিবাচক নয়। প্রশ্নাকারে সেই ব্যখ্যা হচ্ছে ‘একটি আসনেই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভোট করতে ব্যর্থ, সেখানে ৩০০ আসনে নির্বাচন করবে কী করে?’ এর উত্তরে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘এটা সময় বলে দেবে। এখন একটি আসনে সঠিক হচ্ছে না বলে ৩০০ আসনে হবে না, সেটি বলা সমীচীন হবে না। এই নির্বাচন থেকে আমরা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারব।’
এসব ব্যাখ্যা যত চটকদারই শোনাক না কেন, এগুলো গাইবান্ধার উপনির্বাচনের আসল শিক্ষা তুলে ধরে না। গাইবান্ধার উপনির্বাচন কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর কিছু পুরোনো, কিন্তু সম্ভবত এখন তা আরও স্পষ্ট।
গণমাধ্যমে গাইবান্ধার নির্বাচনে সংঘটিত ঘটনাবলির যে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ভোট গ্রহণের শুরু থেকেই কেন্দ্রগুলো ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দখলে চলে গিয়েছিল এবং তা ঢাকায় বসে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা সিসিটিভিতে দেখছিলেন। যা দেখছিলেন, তা অভূতপূর্ব কোনো ঘটনা নয়, এর আগে জাতীয় নির্বাচন, উপনির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সর্বত্রই এ ঘটনা ঘটেছে।
এই কমিশনের অধীন গাইবান্ধার উপনির্বাচন প্রথম জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন এটা ঠিক, কিন্তু এমন তো নয় যে এই কমিশনের সদস্যরা আগের জাতীয় নির্বাচনগুলো সম্পর্কে কিছু জানেন না। বা গত এক দশক তাঁরা শীতনিদ্রায় ছিলেন।
কমিশনের সদস্যরা যে এ বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত আছেন, তার প্রমাণ হচ্ছে গত ৩০ মে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিবের বক্তব্য। এক সংবাদ সম্মেলনে ইভিএমের মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ একটাই, আর কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। সেটা হচ্ছে যে ডাকাত, সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে, “আপনার ভোট হয়ে গেছে চলে যান”।
দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ’ (প্রথম আলো, ৩০ মে ২০২২)। এসব ‘ডাকাত’ যে নির্বাচন কেন্দ্রে থাকে, তা জানার পরও নির্বাচন কমিশন এর বিরুদ্ধে চার মাসে কিছুই করেনি, এমনকি এ নিয়ে একটি বাক্য ব্যয় করেনি। আর এসব কথিত ডাকাত কি কেবল ইভিএমের গোপন কক্ষে ঢুকেই ডাকাতের ভূমিকা নেয়, নাকি এর আগেই তাদের আচরণে বোঝা যায়, সেটাও তো বোধগম্য।
নির্বাচন কমিশন জানে এই ‘ডাকাতেরা’ কারা। তার প্রমাণ আছে সংবাদপত্রের পাতায়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী সোজাসাপটা বলে দিয়েছেন, ‘বাটন টিপে দিতে কেন্দ্রে আমার লোক থাকবে’ (প্রথম আলো, ৩০ মে ২০২২)। আওয়ামী লীগের ওই নেতা আরও বলেছিলেন, ইভিএম না থাকলে রাতেই সব ভোট নিয়ে ফেলতেন। এ ধরনের প্রার্থী কেবল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করেন অথবা কেবল চট্টগ্রামেই থাকেন, এমন তো নয়।
নির্বাচনের দিনে যারা ‘ডাকাতি’ করেছে বলে বলা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেনি যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তারাই কিন্তু অহরহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের আটক করছে। ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মীরা ছাত্রলীগের হাতে প্রহৃত হয়ে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গিয়েও রক্ষা পাননি।
তাহলে গাইবান্ধায় এমন কিছু ঘটবে না, এমন ধারণা কমিশন কোথা থেকে পেয়েছিল, সেটা নিশ্চয় প্রশ্ন করা যায়। কেউ যুক্তি দিতে পারেন তারা ‘আশা’ করেছিল; কিন্তু ‘আশাবাদ’ তো দায়িত্ব পালনের কৌশল হতে পারে না। সাংবিধানিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়ে আশাবাদের ওপর ভরসা করাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ বললে কি অতিরঞ্জন হবে? এখন সন্দেহবাদীরা তো এমন সিদ্ধান্তে আসতেই পারে যে আসলে কমিশন জেনেশুনেই এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেয়নি, তুরুপের তাস হাতে রেখেছে শেষ পর্যন্ত।
ভোট গ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে বলে কমিশন বুঝতে পেরেছে নির্বাচন শুরু হওয়ার অনেক পরে, এর আগেই চারজন প্রার্থী নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায় যে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সকালেই।
এগুলো কমিশন ধর্তব্যে নিয়েছে, যখন পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে গেছে। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য, আড়াইটার সময় নির্বাচন বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার সময়ও তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, তা আমরা এখনো বলতে পারব না।’
কিন্তু যাঁদের কারণে ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে গেল, তাঁদের বিরুদ্ধে কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন কোনো সংবাদ কোথাও চোখে পড়েনি। অনেকে বলবেন কমিশন কী করবে, এই ‘দুষ্কৃতকারীদের’ ধরার কাজ তো পুলিশের। লক্ষণীয় যে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের বক্তব্য, ‘অনিয়ম বন্ধ করার ক্ষেত্রে ইসিকে মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে ইসি সুষ্ঠু ভোট করতে সক্ষম হয়নি।’ এর মানে দাঁড়াচ্ছে যে একটি মাত্র আসনের নির্বাচনেই কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তার অধীনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানকার প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল, সেটাও অনুসন্ধান দাবি করে। কেননা আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘কোথাও কোনো অনিয়ম হয়েছে, এ রকম কেউ বলতে পারেননি। জেলা প্রশাসনে কথা বলেছি, সেখানেও কোনো তথ্য নেই।’
গত শনিবার ডিসি এবং এসপিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকের সময় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সে কারণে এসব বিষয় আরও বেশি মনোযোগ দাবি করে। ওই বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান অভিযোগ করেছিলেন যে অনেক ডিসি ও এসপি স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কথামতো কাজ করেন। এ কারণে আচরণবিধি লঙ্ঘনে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এরপর তাঁর বক্তব্য নিয়ে সভায় এসপি ও ডিসিদের কেউ কেউ হইচই করেন এবং আনিছুর রহমান আর বক্তব্য দিতে পারেননি (যুগান্তর, ১১ অক্টোবর ২০২২)।
নির্বাচনের দিনে যারা ‘ডাকাতি’ করেছে বলে বলা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেনি যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তারাই কিন্তু অহরহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের আটক করছে। ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মীরা ছাত্রলীগের হাতে প্রহৃত হয়ে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গিয়েও রক্ষা পাননি।
চট্টগ্রামে বিএনপির ১২ অক্টোবরের সমাবেশের আগের দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ নেতা-কর্মীদের আটকের চেষ্টা করেছে। পুলিশের একটি শাখা সম্প্রতি দেশের সব কটি জেলায় পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে বিএনপি এবং সরকারবিরোধীদের তালিকা করতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব পারছে, কিন্তু গাইবান্ধার নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের হয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি। এর অর্থ, হয় তারা নির্বাচন কমিশনের কথা শোনেনি, নতুবা নির্বাচন কমিশন তাদের কাছে এমন কিছু চায়নি। এর কোনোটিই নির্বাচন কমিশনের জন্য ইতিবাচক নয়।
যাঁরা এই প্রশ্ন করছেন যে নির্বাচন কমিশন একটা আসনে পারেনি, ৩০০টিতে কী করে পারবে—তাঁদের সঙ্গে আমার ভিন্নমত এইখানে যে তাঁরা সম্ভবত যথাযথ প্রশ্ন করছেন না। প্রশ্নটা নির্বাচন কমিশন পারবে কি না সেটা নয়, বরং নির্বাচন কমিশন চাইবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। নির্বাচন করা মানে জনগণের অর্থে কেনা ইভিএম মেশিন নিয়ে দোকান খোলার মতো করে নির্বাচন কেন্দ্র খোলা নয়।
নির্বাচন মানে নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি করা, ভোটারদের আস্থা অর্জন। সেটা নির্বাচনের আগের দিন, আগের সপ্তাহ বা আগের মাসের ব্যাপার নয়। গাইবান্ধার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন যদি আশা করে তাদের এ বিরল পদক্ষেপ তাদের ব্যাপারে আস্থা তৈরি করবে, তাহলে বুঝতে হবে নাগরিকদের বিষয়ে তাদের ধারণায় বড় ধরনের ঘাটতি আছে। তাদের এ পদক্ষেপ আরও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব প্রশ্ন কেবল এই উপনির্বাচনের ব্যাপারে নয়, ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট