পাকিস্তানের ইতিহাসের এখন এক সংকটময় সময়। এই সময় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার খুব প্রয়োজন। কিন্তু এই স্থিতিশীলতা অনেক খুঁজেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। দেশ এখন বিদেশি ঋণের চাপে জর্জরিত।
আনুষ্ঠানিক খাতের আর্থিক দেউলিয়াত্ব এড়াতে প্রচেষ্টার সাফল্যের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি পূর্বশর্ত। কিন্তু ইসলামাবাদ এবং এর আশপাশে অভিজাতদের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে চলছে ক্ষমতার লড়াই। বাড়ছে অস্থিতিশীলতা। আর প্রান্তে, বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও পাখতুনখাওয়া তো টগবগ করে ফুটছে।
দেশের শাসকগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংকটের বোঝা ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত নয়। তারা এই অসহনীয় বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্তদের ওপর অন্যায্য বাজেট ও করারোপ করে। এসব উদ্যোগ সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়াচ্ছে।
পাকিস্তানকে ভোগাচ্ছে একাধিক সংকট। এসবের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো কয়েক দশকের পুরোনো হাইব্রিড ব্যবস্থার হতাশাজনক ব্যর্থতা। এই হাইব্রিড ব্যবস্থা বলতে রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর জেনারেলদের সংবিধানবহির্ভূত গলা টিপে ধরা বোঝায়।
১৯৮০-এর দশকের শেষে জিয়াউল হকের সামরিক আইন দিয়ে গঠন করা ‘প্রজাতন্ত্র’ ছিল নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। এর পর থেকে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ যত বেড়েছে, রাজনৈতিক অভিজাতদের এসবের ওপর নিয়ন্ত্রণ তত আলগা হয়েছে। গত দুটি সাধারণ নির্বাচনে (২০১৮ ও ২০২৪) সামরিক বাহিনী যে নির্লজ্জ কারচুপি করিয়েছে, তাতে দেশের রাজনীতির মেরুকরণ আরও তীব্র হয়েছে। দেশে ডেকে এনেছে অস্থিতিশীলতা।
একটা উদাহরণ দিয়ে উভয়সংকটের মাত্রা বোঝানো যায়। জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর ৩ বছরের জন্য চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন। তাঁর মেয়াদ ২০১৯ সালের নভেম্বরে শেষ হলেও অবসর নেননি তিনি।
কিং মেকার হিসেবে নিজের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন আইন প্রণয়নের জন্য সংসদকে বাধ্য করে তিনি আরও তিন বছর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ পান। প্রায় ছয় বছর কার্যত দেশ শাসন করার পরও খুব অনিচ্ছায় ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর অবসর নিয়েছিলেন। মেয়াদ আরও বাড়ানোর ইচ্ছা তাঁর ছিল!
মহাশক্তিমান সেনাপ্রধান বাজওয়ার ছয় বছরের মেয়াদে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের নামমাত্র প্রধান নির্বাহী হিসেবে দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে দুজন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউই সাংবিধানিক মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।
তাত্ত্বিকভাবে পাকিস্তান একটি ফেডারেল সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ তার ফেডারেল চরিত্রকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষুণ্ন করে। কারণ, সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতারা পাঞ্জাবি জেনারেলদের মধ্য থেকে আসেন। তাঁরা রাষ্ট্রের ফেডারেল চরিত্রের প্রতি বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেন না। ব্যাপারটি বালুচ, পশতুন, গিলগিট বাল্টিস্তান ও কাশ্মীরের মতো নিপীড়িত জাতিগুলোর মানুষের মধ্যে বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিকে আরও গভীর করে তুলেছে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথোপকথনের সময় জেনারেল বাজওয়া গর্বের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, তাঁর আমলে তাঁর অভিভাবকত্বে একের পর এক নতুন শাসক ক্ষমতায় এসেছেন। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও অযোগ্যতার জন্য দুষতেও তিনি ভোলেননি।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে ‘সবচেয়ে সৎ’ নেতা হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প নিয়েছিল সামরিক বাহিনী। উদ্দেশ্য ছিল নওয়াজ শরিফ ও আসিফ আলী জারদারির মতো ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ নেতাদের প্রতিহত করা। সে প্রকল্প বুমেরাং হয়েছে।
ইমরান খান ছিলেন জনতুষ্টবাদী নেতা। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, প্রবাসী পাকিস্তানিদের মধ্যে তাঁর ভিত্তি ছিল খুব মজবুত। সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে ইমরান খান ছিটকে বের হয়ে যান জেনারেল বাজওয়ার মুঠো থেকে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাজনৈতিক কারসাজিতে খুব দক্ষ। তাদের হাতে আছে গোয়েন্দা সংস্থা। ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কৌশল দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিকভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। সঙ্গে ছিল তাদের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বয়ান।
এসব দেখে সামরিক বাহিনী জোর ধাক্কা খেয়েছিল। বাহিনী থেকে ইমরান খানের সক্রিয় সমর্থক বাদ দেওয়ার জন্য শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। সে সময় অব্যাহতি দেওয়া হয় দুজন কর্প কমান্ডারকে। ইমরান খানের আমলে দেশের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসএই) প্রধান ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ। তাঁর বিরুদ্ধেও সামরিক আদালতে মামলা চলছে। অভিযোগ, দুর্নীতি ও বর্তমান চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের বিরুদ্ধে ইমরান খানের চালানো প্রচারণায় সমর্থন।
জেলখানায় শতাধিক পিটিআই–সমর্থক বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ২০২৩ সালের ৯ মে সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানোর। একই অভিযোগে মামলা আছে ইমরান খানের বিরুদ্ধেও। গুরুতর জল্পনা আছে যে তাঁকেও সামরিক আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হবে।
২০১০ সালে পাস হয় ১৮তম সংবিধান সংশোধনী। এই সংশোধনী ছিল ১৯৭৩ সালে সংবিধান জারি হওয়ার পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার। এতে ১০২ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংবিধানের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ সংশোধিত হয়। এতে মানবাধিকারকে শক্তিশালী করা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধি করা এবং অতীতের সামরিক স্বৈরশাসকদের আরোপিত কিছু আইনের বিকৃতি রদ করা হয়েছে। সংবিধানের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদকে শক্তিশালী করে সংবিধানকে বাতিল, বিদ্রোহ ও স্থগিতাদেশের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
অজনপ্রিয় সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল মোশাররফের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের আন্দোলনের পর সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব কিছু সময়ের জন্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই ফাঁকে ১৮তম সংশোধনী সংসদে পাস করা গিয়েছিল। নতুন ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সামরিক বাহিনীর সরাসরি ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
এরপর জেনারেলরা প্রধানমন্ত্রীদের অযোগ্য ঘোষণা করে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য উচ্চ বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রাখা শুরু করেন। তখন থেকে ক্ষমতার রাজনীতিতে উচ্চ বিচার বিভাগের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায়। শুরু হয় রাজনীতির বিচার বিভাগীয়করণ এবং বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ। নতুন ও সম্প্রসারিত ভূমিকার কারণে বিচার বিভাগও জেনারেলদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। তাই বিচার বিভাগের ডানা কাটার জন্য সংসদে সর্বশেষ আইনটি আনা হয়েছে।
তাত্ত্বিকভাবে পাকিস্তান একটি ফেডারেল সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ তার ফেডারেল চরিত্রকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষুণ্ন করে। কারণ, সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতারা পাঞ্জাবি জেনারেলদের মধ্য থেকে আসেন। তাঁরা রাষ্ট্রের ফেডারেল চরিত্রের প্রতি বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেন না। ব্যাপারটি বালুচ, পশতুন, গিলগিট বাল্টিস্তান ও কাশ্মীরের মতো নিপীড়িত জাতিগুলোর মানুষের মধ্যে বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিকে আরও গভীর করে তুলেছে।
বেলুচিস্তানে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ গত ২৬ আগস্ট প্রদেশের ১০টি জেলায় সমন্বিত আক্রমণ করে তার শক্তি প্রদর্শন করেছে। সামরিক বাহিনী ও তার গোয়েন্দা সংস্থার হাতে জোরপূর্বক গুমের শিকার হাজার হাজার বালুচের মুক্তির জন্য ড. মাহরাং বালুচ ও অন্য বালুচ তরুণীদের নেতৃত্বে শক্তিশালী শান্তিপূর্ণ নাগরিক অধিকার আন্দোলনও রয়েছে। পশতুন যুবকেরাও সেনাবাহিনীর বিপথগামী আফগান নীতির হাতে তাদের স্বদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। তালেবান বিদ্রোহীরা পাখতুনখাওয়ায় বেশ কয়েকটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে প্রতিদিন হামলা হয়।
এত কিছুর মধ্যে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে একটা মাত্র আলো দেখা যাচ্ছে। জেনারেলরা তাঁদের হাতের পুতুলদের মাধ্যমে জনগণের ওপর যে দেউলিয়া নীতি চাপিয়ে দিচ্ছেন, সেগুলো সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা ক্রমেই বাড়ছে। এর প্রমাণ হলো, যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে, তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। তাই মনে রাখা উচিত, রাজনৈতিক নেতারা জেনারেলদের চামচা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জনপ্রিয়তা হারাতে পারেন।
আফ্রাসিয়াব খটক পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক
ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন