বৈষম্যবাদী তৎপরতা যেভাবে পরাজিত করতে হবে

২০২৪–এর শুরুতে তৃতীয়বারের মতো অ-নির্বাচন করে শেখ হাসিনা সরকার যখন আবারও ক্ষমতায় জেঁকে বসে, তখন সমাজে দুটো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একদিকে সরকারি ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো চিরস্থায়ী ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনা দেখে উচ্ছ্বসিত এবং আরও বেশি উদ্ধত হয়; অন্যদিকে দুর্নীতি-লুণ্ঠন ও অত্যাচার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সমাজের সর্বস্তরে সৃষ্টি হয় এক নিদারুণ হতাশা, যাকে বলা যায় সামাজিক বিষণ্নতা।

বিষণ্নতার পেছনে ক্ষোভ ঠিকই আরও জমা হচ্ছিল। ক্রমপুঞ্জীভূত এই ক্ষোভের বহু কারণ ছিল। হাসিনা সরকার জিডিপির উচ্চ হার প্রবৃদ্ধি দেখালেও কর্মসংস্থানের প্রকট সমস্যা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের টানাপোড়েন, জিনিসপত্রের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণ জালিয়াতি, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক উচ্চ ব্যয়ের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ লুট ও পাচার এবং বৈষম্য বৃদ্ধি মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। ক্ষোভের আরেকটি বড় কারণ হলো, জনগণের সমস্যা সমাধানে সরকারের ভয়ংকর নিষ্ক্রিয়তার পাশাপাশি মানুষের ওপর সরকারি দলের লোকজনদের যথেচ্ছ অত্যাচার।

ছাত্রলীগ, যুবলীগের মতো বিভিন্ন লীগের নামে দখল, লুট, বন উজাড়, নদী বিনাশ চলছিল। এর সঙ্গে ফুটপাতের দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পর্যন্ত ছিল চাঁদাবাজি আর নির্যাতন। কাউকে অপছন্দ হলে সরকারি বাহিনীর তুলে নেওয়া, মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে হুমকি, ক্রসফায়ার, গুম তো ছিলই।

তৃতীয় যে বিষয়টি আরও ক্ষোভ বাড়িয়েছে, তা হলো ভারতের সঙ্গে অধস্তন সম্পর্ক। সীমান্ত হত্যা চলেছে, পানির বাধা দিন দিন বেড়েছে। অথচ সেগুলোর সমাধান না করে তাদের প্রতি গদগদভাব ও একের পর এক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ বছরের জুনে শেখ হাসিনা দুবার ভারত সফর করেন। দ্বিতীয় সফরে তিনি ট্রানজিটের সুবিধা আরও অনেক বিস্তৃত করেন। এসব চুক্তির বিষয়ে জনগণ কিছুই জানতে পারেনি। যখন কাজের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর বিভিন্ন লীগসহ পুলিশ–বিজিবি আক্রমণ, এমনকি নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু করে, তখন এসব পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে, সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।

এ বছরের ৫ জুন কোটা সংস্কার নিয়ে এক মামলার সূত্রে আদালত তাঁর রায়ে পুরোনো কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০১৮ সালের পর আবার এই কোটা আন্দোলন শুরু হয়। জুন মাসে এই আন্দোলন ক্রমে বিস্তৃত হতে থাকে। ১ জুলাই থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ডাকা ধর্মঘট শুরু হয়, সে সময় ঘটনাক্রমে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাঁদের পেশাগত দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেন।

এই ধর্মঘট ডাকে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এবং সব শিক্ষক সমিতি, যারা বরাবরই সরকারের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যের জন্য পরিচিত ছিল। তৃতীয়বার প্রতারণা ও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে জনগণের দাবিদাওয়ার প্রতি সরকারের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল অনেক।

শিক্ষক বা শিক্ষার্থী উভয়েরই দাবি নিয়ে আলোচনার বদলে সরকারের পক্ষ থেকে হাস্যরস–মশকরা–অপমান চলছিল। এর চরম প্রকাশ ঘটল ১৪ জুলাই রাতে, সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রতি বিষোদ্‌গার, পাইকারি হামলা এবং ১৬ জুলাই থেকে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। মানুষের পক্ষে এত কিছু মেনে নেওয়া কঠিন ছিল, তাই ঘটল জনবিস্ফোরণ।

২ আগস্ট ৩৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের উদ্যোগে আয়োজিত ‘দ্রোহযাত্রা’ যেভাবে জনস্রোত তৈরি করে, ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে যেভাবে মানুষের ঢল নামে আর ৪ আগস্ট হাসিনা–উত্তর রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা যেভাবে জনসমর্থন পায়, তাতে হাসিনা সরকারের যে আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, সেটাই স্পষ্ট হয়। সহস্র মানুষ খুন আর ২০ হাজারের অধিক জখম করার পরও সেই জনবিস্ফোরণ থামেনি, বরং এক অপ্রতিরোধ্য গণ–অভ্যুত্থানে তা টেনে নামায় সরকারকে, শেখ হাসিনা সদলবলে পালান।

অসম্ভব সাহস আর এক সাগর রক্ত দিয়ে ১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এ দেশকে স্বাধীন করেছিল। আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল এক বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। কিন্তু এর বদলে সম্পদের কেন্দ্রীভবন, সামরিক–বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র, লুটপাট এবং অবিচারের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল।

১৯৭২–এ ইতিহাসের সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাঁর হাতেই সংবিধানে স্বৈরতন্ত্রের ভিত তৈরি হয়, তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ একদলীয় প্রায় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭৫–এ শেখ মুজিবকে সপরিবার হত্যা করে আসে সামরিক শাসন। এরপর সামরিক শাসকদের হাত ধরে একে একে জন্ম নেয় বিএনপি, জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ এবং এই পার্টিগুলো বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন হয়, এদের সহযোগী হিসেবে জামায়াতও ক্ষমতার অংশীদার হয়।

কয়েক দশকে বারবার প্রত্যাশা ভঙ্গ হলেও জনপ্রতিরোধ থামেনি। এর মধ্যে সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, এরশাদবিরোধী গণ–অভ্যুত্থান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন, শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের অধিকারের আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন, ফুলবাড়ী-সুন্দরবন-নদী-বন-জমি রক্ষাসহ জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের আন্দোলন, দুর্নীতি লুটপাটবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—এ রকম অসংখ্য বিষয় নিয়ে মানুষ প্রতিরোধ গড়েছে, মার খেয়েছে, জীবন দিয়েছে। এসবের ধারাবাহিকতাতেই সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তৈরি করেছে ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান।

শিক্ষার্থী-জনতার এই অসাধারণ অভ্যুত্থানের সাফল্য প্রধানত তিনটি: ১. আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অত্যাচারী প্রবল পরাক্রমশালী হাসিনা সরকারের পতন। ২. বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিদিনের নির্যাতন, হুমকি থেকে মানুষের মুক্তি। রাষ্ট্রীয় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ। ৩. বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আলোচনা, বিতর্কের উচ্ছ্বাস। মনে হচ্ছে সবারই যেন কিছু বলার আছে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা আছে, মত-ভিন্নমত আছে।

এই গণ–অভ্যুত্থানেও আগের মতোই তরুণেরাই আন্দোলনের শীর্ষ ভূমিকায় থেকেছে। তবে এবারের আন্দোলনে বাম–ডান বিভিন্ন দলের ভূমিকা থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছিল না। দ্বিতীয়ত, এবারের আন্দোলনে সক্রিয় সংবেদনশীল ভূমিকা ছিল শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক, নারীর। তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ডিজিটাল প্রযুক্তির, যার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে দ্রুত খবর গেছে, নৃশংসতা ও প্রতিরোধের ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে মানুষকে জমায়েত করেছে, আন্দোলনকারীরা পরস্পর সংযুক্ত থেকেছে।

চতুর্থত, এবারের আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের স্পষ্ট অবস্থান না থাকায় অসংখ্য কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর প্রতিফলন দেখা যায় দেয়ালে দেয়ালে। কাঁচা হাতে লেখা আঁকায় বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে, তা অসাধারণ। সেখানে সব ধর্ম, জাতি ও লৈঙ্গিক বৈষম্য দূর করে সমতার বাংলাদেশের স্বপ্ন উঠে এসেছে। তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের তিন দিন পর যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে, তার এবং তাদের সহযোগী ছাত্রনেতাদের কথা ও কাজে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ এখনো মূর্ত হয়নি। বস্তুত এ রকম একটি বড় পরিবর্তনের জন্য যে তাদের কোনো প্রস্তুতি বা দিগ্‌দর্শন ছিল না, সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে বারবার।

আকাঙ্ক্ষার বিপরীত–যাত্রাও গত কয় মাসে দেখা গেছে। গণ–অভ্যুত্থানের পথে যাঁরা নিহত ও গুরুতর আহত হয়েছেন, তাঁদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বা কর্মজীবী। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। তা এখনো অগোছালো অবস্থায়।

ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দিন–রাত কাটাচ্ছেন এখনো। মন্দির, মাজার, মসজিদসহ বহু শিল্পকর্ম আক্রান্ত হয়েছে। বহু কারখানা অচল হয়ে হাজারো শ্রমিক বেকার, বহু শ্রমিককে বকেয়া মজুরি চেয়ে এখনো পথে নামতে হচ্ছে। চাঁদাবাজি আবারও শুরু হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম এখনো সেই ওপরেই আছে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এখনো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।

হাসিনা আমলের পরিবেশবিধ্বংসী প্রাণবিনাশী প্রকল্প এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি এখনো অব্যাহত আছে। যানজট দুর্ঘটনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে। অন্যদিকে বৈষম্যবাদী রাজনীতির নড়াচড়া ক্রমেই বাড়ছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো বা অস্বীকার করে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে খারিজ করা, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে।

জোরজবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কর্তৃত্বে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ধারা দখল, লুণ্ঠন ও দুর্নীতির পথ তৈরি করেছিল, সে ধারাও অব্যাহত রাখা হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গেলে এসবের পরিবর্তন হতে হবে।

তবে সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন করেছে। সেসব কমিশন তাদের রিপোর্ট তৈরি করতে বিশদ কাজ করছে। ইতিমধ্যে শ্বেতপত্র কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে, যেখানে গত সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও সম্পদ পাচারের বিস্তারিত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।

বৈষম্যহীন সর্বজনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এর সঙ্গে শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতি ও ধর্মীয় বৈষম্য দূর করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতি ও কর্মসূচির রাজনৈতিক বিধিব্যবস্থা দরকার হবে। ২০২৪ যে জনপন্থী পরিবর্তনের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করেছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২৫ সালে বৈষম্যবাদী তৎপরতা পরাজিত করতে হবে। এবং বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দর্শন ও রাজনীতি শক্তিশালী করতে হবে।

আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক