‘উদার ভারত! সকল মানবে দিয়াছ তোমার কোলে স্থান
পার্সি-জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দু খ্রিষ্টান-শিখ-মুসলমান’
—নব্বই দশকের টালিউডের আব্বাজান সিনেমায় কাজী নজরুলের এই গানের দৃশ্যায়ন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ভারতের মাটিতে সাম্প্রদায়িক বিভেদের স্থান থাকতে পারে না—এটাই ছিল সেই সিনেমার বিষয়বস্তু।
ভারতমাতা তার কোলে তার সব ধর্মানুসারী সন্তানকে সমানভাবে ঠাঁই দিয়েছে—এ কথা যখন নজরুল লিখছিলেন, তখন (১৯৩২ সালে) ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়নি। তখন সে ব্রিটিশ শৃঙ্খলে বন্দী।
বন্দিদশার সেই ভারত তখন নজরুলের ভাষায় ছিল উদার। সে সময় বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়ার পরও নজরুলের সেই কথায় কেউ তখন দ্বিমত করেননি।
‘মুসলমান’ নজরুল এই গান লেখার দুই বছর পর ১৯৩৪ সালে নিজের পরিচালিত ‘ধ্রুব’ সিনেমায় হিন্দু দেবর্ষি নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
সে সময় বা তার পরের দিকে ভারতে ইউসুফ খানদের যদিও দিলীপ কুমার কিংবা মমতাজ জাহান দেহলভিদের যদিও মধুবালা নাম নিয়ে সিনেমায় নামতে হচ্ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিভেদ আর দলবাজির রাজনীতি তখনো ভারতের সিনেমাকে, বিশেষত বলিউডকে গিলে খায়নি।
আজ নজরুলের ‘উদার ভারতের’ স্বাধীন হওয়ার বয়স আশি ছুঁই ছুঁই করছে। আজ সে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ।
কিন্তু কথা হচ্ছে, গত এক দশকে ভারতের সবচেয়ে বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলিউড লাগাতার যেসব সিনেমা প্রসব করে যাচ্ছে, তাতে নজরুল যদি এখন বেঁচে থাকতেন, আর তাঁর ‘উদার ভারত’ গানটি যদি কোনো সিনেমায় জুড়ে দেওয়া হতো, তাহলে নজরুলের ফেসবুক প্রোফাইলে নির্ঘাত হা হা রিঅ্যাক্টের শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে যেত।
রাজনৈতিক ধারার সিনেমা মুখ্যত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। হিটলার-মুসোলিনির বিরুদ্ধে চার্লি চ্যাপলিনের দ্য গ্রেট ডিক্টেটর থেকে শুরু করে আমাদের এই মাটিতে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনের বিরুদ্ধে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া—এমন বহু সিনেমা বহু দেশে তৈরি হয়েছে।
কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অথচ গণতন্ত্রের চেতনা থেকে দৃশ্যমানভাবে বিচ্যুত হওয়া একটি সরকারের দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করতে বলিউড নির্মাতারা যেভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভক্তির চরম উসকানি দেওয়া সিনেমা বানিয়ে যাচ্ছেন, সেটি কেবল সত্যিকারের উদার ভারতবাসীকে নয় বরং বহুত্ববাদী ভারতকে স্বাগত জানানো প্রতিবেশীদেরও হৃদয় ভেঙে দিয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের যে ৩৭০ ধারা কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করেছিল, তা ২০১৯ সালে বাতিল করার বিতর্কিত সরকারি সিদ্ধান্তের সমর্থনে আদিত্য সুহাস জাম্বালে বানিয়েছেন আর্টিকেল ৩৭০।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দর্শকদের, মানে আমাদের ইতিহাসের সত্যিকারের পাঠ নিতে বলেছেন।
ছবির শুরুতে অজয় দেবগনের কণ্ঠে সেই ‘ইতিহাস’ পড়ে যাওয়া হয়েছে। ভয়েসওভারের এই ‘ইতিহাসে’ অবশ্য ইতিহাসের চিরায়ত যুক্তি-পাল্টা যুক্তির ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। সিনেমাটির নির্মাতার নিজস্ব বিশ্বাস বা যা তাঁরা প্রচার করতে চেয়েছেন, সেটাকেই ইতিহাস বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ছবিতে অরুণ গোভিল অভিনীত মোদির চরিত্রটিকে বলতে শোনা যায়, ‘হাম আর্টিকেল তিন শ সত্তর হাটায়েঙ্গে (আমরা ৩৭০ ধারা বাতিল করব)।’
কিরণ কর্মকার অভিনীত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর চরিত্রটিকে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলতে দেখা যায়, ‘পুরা কা পুরা কাশ্মীর ভারত কা হিস্যা থা, হ্যায় অউর র্যাহেগা।’ (কাশ্মীরের গোটাটাই ভারতের ছিল, আছে এবং থাকবে)।
কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের রক্ষাকবচ ও উদার ভারতের অন্যতম নিদর্শন বলে পরিচিত ৩৭০ ধারার পক্ষের মানুষের প্রতি ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বের যে কী পরিমাণ শ্লেষ রয়েছে, তা মোদি ও অমিত শাহর দুটি সংলাপে ফুটে ওঠে।
সবাই জানেন যে এগুলো চিত্রনাট্যের মামুলি ও কাল্পনিক সংলাপ নয়। এগুলো মোদি ও অমিত শাহর বাস্তব সংলাপ।
অনেক সমালোচক বলেছেন, এটা আসলে বিজেপির অ্যাজেন্ডা নিয়ে বানানো এমন প্রোপাগান্ডার সিনেমা যে তাতে হিংসা উগরে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাখঢাকের বালাই রাখা হয়নি।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বলিউডকে সরকারের রাজনৈতিক প্রচারের পোষ্য যন্ত্র বানাতে শুরু করে। তখন থেকেই সরকারের নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব সিনেমা তারা তৈরি করতে থাকে।
কিন্তু গত চার বছরে বলিউডে এমন সব সিনেমা তৈরি হয়েছে, যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবং ভারতের হিন্দু-মুসলিমকে পরস্পরের প্রতি চরম বিদ্বেষী করার আগুনে কাঠখড় জুগিয়েছে।
২০১৯ সালে নির্বাচনের আগে বলিউডে মুক্তি পায় মোদির আত্মজীবনীভিত্তিক সিনেমা মিস্টার মোদি। মোদির ভূমিকায় ছিলেন বিবেক ওবেরয়। ওই ছবির উপলক্ষ ছিল ভোট, আর লক্ষ্য ছিল মোদির জয়।
পাঁচ বছর পর আবার যখন নির্বাচন শুরু হয়েছে, তখন ভোটকে সামনে রেখে বলিউড প্রোপাগান্ডাধর্মী সিনেমায় ছেয়ে গেছে।
এই নির্বাচনে বিজেপির অ্যাজেন্ডা মাথায় রেখে বলিউডে অন্তত ১০টি সিনেমা বানানো হয়েছে।
২০০২ সালে গুজরাটের গোধরায় দাঙ্গায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বহু মুসলমানের প্রাণহানির ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মোদি ও তাঁর দলের জন্য আজও বিব্রতকর।
সেই ঘটনার দায় থেকে মোদিকে বাঁচানোর চেষ্টায় এম কে শিবাক্ষ বানিয়েছেন অ্যাক্সিডেন্ট অর কন্সপিরেসি: গোধরা।
সামনের লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে সিনেমাটি ১ মার্চ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেন্সর সার্টিফিকেট না পাওয়ায় এটির মুক্তির তারিখ পিছিয়ে যায়।
২২ মার্চ মুক্তি পেয়েছে বিংশ শতকের বিতর্কিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা ও বিজেপির রাজনৈতিক প্রেরণাপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকারের বায়োপিক স্বতন্ত্র বীর সাভারকার।
এই ছবিতে সাভারকার চরিত্রটির মুখ দিয়ে মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস পার্টিকে ইংরেজদের দোসর বলানো হয়েছে। বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস পার্টি সম্পর্কে ভোটারদের মনে যাতে একটি প্রগাঢ় নেতিবাচক ধারণা আসে, সে ধরনের সংলাপ ও দৃশ্য খুব স্থুলভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
ছবিটির একটি দৃশ্যে সাভারকার জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনে কাভি সোচা হ্যায় কে, কংগ্রেসকি কিসি মেম্বারকো কালাপানিকি সাজা কিউ নেহি হুয়ি?’ (আপনারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কংগ্রেস পার্টির কোনো সদস্যকে কেন কোনো দিন কালাপানির নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়নি?)
আরেক জায়গায় সাভারকারকে বলতে শোনা গেছে, স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী যুক্ত না হলে অন্তত তিন দশক আগেই ভারত স্বাধীন হয়ে যেত।
মোদির সর্বশেষ সেনসেশনাল ‘অখণ্ড ভারত’-এর স্বপ্নের কথার প্রতিধ্বনি করে পর্দার সাভারকার বলেছেন, ‘হাম অখণ্ড ভারত বানায়েঙ্গে (আমরা অখণ্ড ভারত বানাব)।’
সেই ‘অখণ্ড ভারত’ কতটা ‘উদার ভারত’ হবে, তা অবশ্য এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে।
স্ক্রল ডটইন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘আ ডামিস গাইড টু প্রোপাগান্ডা ফিল্মস ইন বলিউড’ শিরোনামের একটি লেখায় চলচ্চিত্র সমালোচক নন্দিনী রামনাথ বলেন, বলিউডে এখন জাতীয়তাবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। সেখানে বিনোদনের চেয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারিত হচ্ছে বেশি।
নন্দিনী বলেন, ‘সিনেমাকে এখন এমনভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শের অস্ত্র বানানো হচ্ছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তি বা ঘটনা সম্পর্কে আমরা প্রচলিত ইতিহাস থেকে এত দিন যা জেনে এসেছি, এসব সিনেমা তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এগুলো একটি নতুন বিকল্প ইতিহাস তৈরি করছে। এটা বলিউডের ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে।’
গত বছরের মে মাসে মুক্তি পাওয়া দ্য কেরালা স্টোরি আরেকটি প্রোপাগান্ডা মুভি।
এই ছবির গল্পে দেখানো হয়েছে যে ভারতের ৩২ হাজার খ্রিষ্টান ও হিন্দু নারীকে প্রেমের জালে জড়িয়ে (বিজেপির ভাষায় ‘লাভ জিহাদ’) ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে সন্ত্রাসী আইএস গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এই ছবি সম্পর্কে মোদি বলেছিলেন, এই ছবি সন্ত্রাসবাদীদের ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে।
ছবিটির পরিচালক সুদীপ্ত সেন দাবি করেছেন, তিনি এই ছবিতে ‘সত্য’ তুলে এনেছেন।
তবে সিনেমাটি নিয়ে বিক্ষোভ হওয়ার পর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে বলেন, ৩২ হাজার নারীর ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনো তথ্যসূত্র ছবিতে দেখানো হয়নি। এই গল্প যে সত্যি ঘটনা, তার কোনো প্রমাণ ছবিটির পরিচালক হাজির করতে পারেননি। সে কারণে ছবিটির ডিসক্লেইমারে ‘এটি একটি কাল্পনিক গল্প’ কথাটা জুড়ে দিতে আদালত আদেশ দিয়েছেন।
এই ক্যাটাগরির আরেকটি ছবি দ্য কাশ্মীর ফাইলস। ছবিটিতে মুসলিম জঙ্গিরা কাশ্মীরের চার হাজার হিন্দু পণ্ডিতকে হত্যা করেছে বলে দেখানো হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনটিতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুচিকা শর্মার বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। সেখানে তিনি বলেন, বলিউডের এসব প্রোপাগান্ডা মুভিতে বাস্তব ও কাল্পনিক ঘটনাকে এমনভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে যে ‘ঐতিহাসিক জনরা’ বলে সিনেমার যে ক্যাটাগরি এখন আছে, সেই ক্যাটাগরির চরিত্রটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে ভয়ানকভাবে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছড়িয়ে পড়ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া আখির পলায়ন কব তক? সিনেমায় মুসলিমদের অত্যাচারে হিন্দুদের ‘এগজোডাস’ বা দলে দলে পালানোর ঘটনার কল্পনাশ্রয়ী রোমহর্ষ দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক বিভক্তিকে নিঃসন্দেহে উসকে দেবে।
হায়দরাবাদের নিজামে ১৯৪৭ সালের আগের ও পরের দাঙ্গা নিয়ে বানানো হয়েছে রাজাকার: দ্য সাইলেন্ট জেনোসাইড অব হায়দরাবাদ।
তেলেঙ্গানা বিজেপির নেতা গুডুর নারায়ণ রেড্ডির প্রযোজনায় বানানো এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছে গত মার্চে। সেখানে দেখানো হয়েছে, পাকিস্তানের অনুপ্রবেশ করানো রাজাকার বাহিনী হিন্দুদের ওপর ‘নীরব গণহত্যা’ চালিয়েছে।
এই প্রোপাগান্ডা মুভির কাফেলায় বলিউডের একেবারে সামনের সারির সুপারস্টাররাও ভিড়েছেন। গত জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া এই ক্যাটাগরির ছবি ফাইটার -এ ঋতিক রোশন ও দীপিকা পাড়ুকোন অভিনয় করেছেন।
এই ছবিতে পুলওয়ামা ঘাঁটিতে পাকিস্তানের হামলার পর ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রতিশোধ নেওয়ার গল্প বলা হয়েছে। সেই গল্প বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি চরিত্রের সংলাপে তীব্র ‘হেট স্পিচ’ যুক্ত করা হয়েছে।
‘বলিউড অ্যান্ড ইন্ডিয়া ইলেকশনস: হোয়েন রিল অ্যান্ড রিয়েল পাথস’ শিরোনামে বিবিসির চলতি মাসে প্রকাশ করা প্রতিবেদন বলছে, আর্টিকেল ৩৭০ সিনেমাটির মতোই কাশ্মীর ফাইলস বিজেপির প্রোপাগান্ডা অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।
বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে ছবিটির প্রদর্শন শুল্কমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।
বিবিসির প্রতিবেদনটিতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুচিকা শর্মার বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। সেখানে তিনি বলেন, বলিউডের এসব প্রোপাগান্ডা মুভিতে বাস্তব ও কাল্পনিক ঘটনাকে এমনভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে যে ‘ঐতিহাসিক জনরা’ বলে সিনেমার যে ক্যাটাগরি এখন আছে, সেই ক্যাটাগরির চরিত্রটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে ভয়ানকভাবে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছড়িয়ে পড়ছে।
এ ক্ষেত্রে তিনি ২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া সম্রাট পৃথ্বীরাজ ছবিতে ইতিহাসের ভয়ানক বিকৃতি ঘটানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
‘বলিউড “টেকওভার”: প্রো-মোদি ফিল্মস সাম্প ইন্ডিয়ান ভোটারস অ্যাহেড অব ইলেকশন’ শিরোনামে সাংবাদিক কুনাল পুরোহিতের তৈরি করা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল–জাজিরা।
ওই প্রতিবেদনে দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) সিনেমা স্টাডিজ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক (যিনি ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত দীর্ঘদিন ভারতের সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন) ইরা ভাস্কর বলেছেন, সংগীত, কবিতা, গল্প, উপন্যাস—সব ধরনের পপ কালচারে জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রবণতা শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিজেপি হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে সম্পূর্ণ মুঠোর মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।
আসলে সিনেমাকে নেহাত বিনোদন হিসেবে বিক্রি না করে তার সঙ্গে একটু-আধটু জাতীয়তাবাদ মেশানোর কারবার বলিউডে অনেক আগেই শুরু হয়েছিল।
আগে ব্যাপারটা ছিল চায়ের সঙ্গে আফিম মিশিয়ে বেচার মতো। কাস্টমার বুঝবে না, চায়ে আফিম আছে। কিন্তু খাওয়ার পর বুঝবে একটা মাদকতা তাকে মোহাবিষ্ট করছে।
সত্তর দশকের মনমোহন দেশাইয়ের অমর আকবর অ্যান্টনি ছবির কথাই ধরা যাক।
সেখানে দেখা যায়, সিনেম্যাটিক কায়দায় শিশু অবস্থায় তিন ভাই তিন দিকে ছিটকে হারিয়ে যায়। এক খ্রিষ্টান পাদরির কাছে অ্যান্টনি নামে (অমিতাভ বচ্চন), এক হিন্দু পুলিশ অফিসারের কাছে অমর নামে (ঋষি কাপুর) এবং এক মুসলিম পরিবারে আকবর নামে (বিনোদ খান্না) এই তিন শিশু বড় হয়। বড় হওয়ার পর তাদের বন্ধুত্ব হয়।
একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমুখর গল্প এগোতে থাকে।
ছবির শেষে ভিলেনদের যথেষ্ট পরিমাণ মারপিট করার পর তারা জানতে পারে যে তারা তিনজন একই মায়ের পেটের তিন ভাই। মাকে পাওয়া যায়।
এই মা হিন্দু। ছবির শেষে সেই ‘হিন্দু’ আত্মপরিচয়টিই বড় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর প্রাধান্যবিস্তারী একটা সূক্ষ্ম দ্যোতনা যেন সেখানে আফিমের মতো মিশিয়ে দেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গের লেখক অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি লেখায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, এর মধ্য দিয়ে যেন দর্শকের কানে ফিসফিস করে বলে দেওয়া হয়, তুমি মুসলিমই হও আর খ্রিষ্টানই হও, তুমি কিন্তু আদতে হিন্দু মা (ভারতমাতা)-র সন্তান।
যেন অনুচ্চারিত ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে যে সংখ্যালঘুর অভিভাবকত্ব করতে হলে সংখ্যাগুরুকেই এগিয়ে আসতে হয়। সংখ্যালঘু এখানে ‘পৃষ্ঠপোষিত’, ‘আশ্রিত’।
অনির্বাণ মনে করেন, ‘তখনকার এই “হিন্দুত্ব” ছিল বেশ মৃদু। তার মধ্যে আগ্রাসীভাব ছিল না।...১৯৯০-এর মধ্যেই এক আগ্রাসী চেহারায় আবির্ভূত হতে শুরু করে বলিউডি ছবিতে উপস্থাপিত হিন্দু জাতীয়তাবাদ।
সে সময় যে বিষবৃক্ষের চারা রুয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ তা মহিরুহ হয়ে গেছে। সেই মহিরুহে দেবত্ব আরোপ করার কাজও সারা হয়ে গেছে। সে দেবতুল্য বিষবৃক্ষ কাটার সাধ্য এখন আর কারও হবে বলে মনে হয় না।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই–মেইল: sarfuddin2003@gmail