সিরিয়ার বিপ্লবীদের কেন এমন ভয় পাচ্ছেন মিসরের শাসকেরা

সিরিয়ার এই পটপরিবর্তনের ঘটনায় আরব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া আসছে মিসর থেকেছবি : এএফপি

সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর সেখানকার নতুন সরকারকে নিয়ে মিসরের শাসকদের মধ্যে ভয় ও সতর্কতা জেঁকে বসেছে। সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বকে অসম্মান করা, তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি করা এবং সিরিয়ার সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা নিয়ে ভীতি ছড়াচ্ছে মিসরের শাসকমহল।

সিরিয়ার এই পটপরিবর্তনের ঘটনায় আরব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া আসছে মিসর থেকে। অথচ ভৌগোলিকভাবে দামেস্ক থেকে কায়রো অনেক দূরে অবস্থিত। এর বিপরীতে জর্ডান, কুয়েত, সৌদি আরব ও কাতারের মতো দেশগুলো সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। সিরিয়ার নতুন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সৌদি আরব ও কাতার তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আহমদ আল-শারা যদি ইসলামি মতাদর্শের ভিত্তিতে নতুন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সফল হয় তাহলে মিসরের শাসকমহলের উদ্বেগ আরও গভীর হবে। এটি নিঃসন্দেহে মিসরের প্রেসিডেন্ট ফাত্তাহ আল-সিসির জন্য সতর্কবাতা। কারণ, তিনি ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করেন। নিষ্ঠুর সামরিক অভ্যুত্থানে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ইসলামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করেন।

আরও পড়ুন

এখন পর্যন্ত মিসরের শাসকেরা সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কাউকে দামেস্কে পাঠায়নি। তাদের কায়রোতেও আমন্ত্রণ জানায়নি। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, মিসর সরকার এখনো পরিস্থিতিকে পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারেনি। অথবা আসাদ পতনের ধাক্কা তারা সামলে উঠতে পারেনি।

প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ ৮ ডিসেম্বর পালিয়ে যাওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও সিরিয়ার সঙ্গে মিসরের সম্পৃক্ততা দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনালাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

এ সময় মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি তাঁর সিরিয়ান অপরপক্ষ আসাদ আল-শাইবানিকে ‘সিরিয়ার ঐক্য, স্থিতিশীলতা এবং আরব পরিচয় রক্ষা করে, বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিরিয়ার নেতৃত্বে একটি ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন’ অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সম্প্রতি মিসর সিরিয়ায় ১৫ টন মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে। অন্যদিকে কাতার, সৌদি আরব ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিরিয়ানদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ মানবিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

সন্দেহ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ মিসরের ওপর গভীরভাবে চেপে বসার আরেকটি কারণ হলো, আল-শারা এমন একজন যিনি মিসরের আল-সিসি সরকারের প্রতি বৈরী। দামেস্কের সঙ্গে আঙ্কারার এখনকার গভীর সম্পর্ক বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

গত চার সপ্তাহে মিসরের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন আল-শারাকে উদ্দেশ করে ভয়ানক আক্রমণ করে চলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এমপি ও জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে সিরিয়ার নতুন সরকারের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘খুনে সন্ত্রাসীদের একটি গ্যাং’।

এ ছাড়া মিসরে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি নিরাপত্তা অনুমোদন ছাড়া সিরিয়ার নাগরিকদের মিসর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এমনকি যাঁরা ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা কানাডায় থাকেন তাঁরাও এই বিধিনিষেধের আওতায় থাকবেন। সিরীয় কেউ মিসরীয়দের সঙ্গে বিয়ে করলেও তার ক্ষেত্রেও এই বিধিনিষেধ থাকবে।

এমন পদক্ষেপ মিসরে সিরিয়ানদের উপস্থিতি সীমিত করার ইঙ্গিত দেয়।

মিসরের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সিরিয়ার এই পটপরিবর্তন আসাদ সরকারকে পুনর্বাসনে আল-সিসির প্রচেষ্টাকে খাটো করেছে, সিরিয়ার আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতাকে ভেঙে দিয়েছে, আরব বসন্তের অধ্যায়টি বন্ধ করে দিয়েছে এবং একটি স্থিতাবস্থা সংহত হয়েছে।

১৩ বছরের বেশি সময় পর সিরিয়ায় একটি ইসলামি আন্দোলনের পুনরুত্থান মিসর, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সরকারগুলোর সামনে সতর্কবার্তা হিসেবে এসেছে। তারা ভয় পাচ্ছেন, সিরিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার যদি সফল হয় তাহলে তাতে অন্যখানেও অভ্যুত্থানের প্রেরণা তৈরি হতে পারে।

দুটি বড় ঘটনা মিসরের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এক. মধ্যপন্থী ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার কারণে সিরিয়ার নতুন সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। দুই. আসাদ–পরবর্তী সিরিয়ার স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় তুরস্কের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন।

আরও পড়ুন

যা হোক, সিরিয়ার বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ক্ষেত্রে মিসরের সক্ষমতা অনেকখানি কমে গেছে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, সৌদি আরব সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আসাদ সরকারের পতনের ফলে ইরানের প্রভাব দুর্বল করেছে এবং সিরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও উপসাগরীয় স্বার্থের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছে।

সিরিয়ান আর্মি ও ডিপ স্টেট সংস্থাগুলোর বিলুপ্তি এবং নতুন সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা ব্যবস্থা তৈরির কারণে মিসরের হাতে এখন বিরোধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিকল্প কম। মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও সুদানে যে রকম প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ড দেখেছি, সেটা করা এখানে কঠিন।

কুর্দি কার্ড খেলা ছাড়া সিরিয়ায় প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালানোর সুযোগ নেই মিসরের। কিন্তু তুরস্ক এরই মধ্যে কুর্দি গোষ্ঠীগুলোকে নিরপেক্ষ করার উদ্যোগ শুরু করেছে।

মিসরের শাসকগোষ্ঠী সিরিয়ার বিপ্লবের সম্ভাব্য ঢেউ তাদের দেশে আছড়ে পড়ার ভয় পাচ্ছে তার কারণ হলো, অর্থনৈতিক সংকট, মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক স্থবিরতা এবং আল-সিসির প্রতি জনসমর্থন কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো রয়েছে।

আরও পড়ুন

সন্দেহ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ মিসরের ওপর গভীরভাবে চেপে বসার আরেকটি কারণ হলো, আল-শারা এমন একজন যিনি মিসরের আল-সিসি সরকারের প্রতি বৈরী। দামেস্কের সঙ্গে আঙ্কারার এখনকার গভীর সম্পর্ক বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

এই সব ফ্যাক্টর মিসরকে রাজনৈতিক দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মিসর কি সম্পর্ক স্থাপন করবে নাকি সতর্কতার সঙ্গে অপেক্ষা করবে সিরিয়ার সরকার কখন নিজ থেকে তাদের উদ্বেগগুলো দূর করবে।

  • মোহাম্মদ হাসান, মিউলইস্ট মনিটরের কলাম লেখক
    মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত