ভারতের জেগে উঠতে সময় লাগল পাক্কা ৭৮ দিন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর জ্বলছে গত ৩ মে থেকে। রাজ্যের ৫৩ শতাংশ মেইতি জনগোষ্ঠী আর ৪০ শতাংশ কুকি-জো সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ থেকে এ সংঘাতের শুরু। তারপরও যখন দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটানো হলো, নানাভাবে হয়রানি করা হলো এবং সর্বোপরি ১৮ জুলাই এ ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলো, তখন ভারত ও গোটা বিশ্বের নজরে এল এ ঘটনা। নগ্ন এই দুই নারীর একজন আবার দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার।
সাম্প্রতিক এ সংঘাত শুরু হয় আদালতের একটি আদেশকে কেন্দ্র করে। কুকিসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ভূমির যে অধিকার ভোগ করে আসছিলেন, তা তখন মেইতিদেরও দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। এ সংঘাতে ১৪৫ জন নিহত হয়েছেন, উপজাতি সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। প্রায় ৬০ হাজার কুকি-জো মিজোরাম, মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়েছেন। এটি এমন একটি মানবিক সংকট ও গৃহযুদ্ধ, যেখানে জবরদস্তি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদেহ।
মণিপুরে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল বহু বছর আগে থেকেই। এ আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল এমন এক রাজনীতি, যা বংশপরম্পরায় মণিপুরিদের আলাদা করে রেখেছে; আর এখন পুরো রাজ্যকে ভাগ করে ফেলতে চাইছে।
বোমা-বন্দুকের আওয়াজ মণিপুরে নতুন নয়। এমনকি ধর্ষণ করে নিয়ন্ত্রণের যে কৌশল, তা-ও ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিদ্রোহ মোকাবিলায় ভারতীয় সেনারা ব্যবহার করেছেন। মেইতি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে কল্পিত বৈষম্য ও যন্ত্রণার একটি ধারণা গেঁথে আছে। তাঁরা মনে করেন, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার চার দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট মণিপুরের রাজা বোধচন্দ্র চিং যে ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন স্বাক্ষর করেছিলেন, তাতে তাঁরা ঠকে গেছেন।
চুক্তি অনুযায়ী মেইতি রাজারা মণিপুর শাসন করবেন ঠিকই, কিন্তু সামরিক, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। বাস্তবে ১৯৭২ সালে মণিপুর ভারতের ভেতর অন্যান্য রাজ্যের মতোই একটি রাজ্যে পরিণত হয়।
মণিপুরের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মেইতি, কুকি ও নাগা। ব্রিটিশ শাসকেরা, যাঁরা কিনা বিভক্তি ঘটিয়ে শাসন করার কৌশলে ওস্তাদ, তাঁরা মণিপুরকে পাহাড় ও উপত্যকার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে প্রধানত খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী উপজাতিদের (নাগা ও কুকি-জো) পাহাড়ে বসবাসের অধিকার দেওয়া হলো। আর হিন্দুপ্রধান মেইতিদের ইম্ফল উপত্যকায় আটকে ফেলা হলো। কিন্তু মণিপুর রাজ্যের ভূমির ৯০ শতাংশই পড়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে আর উপত্যকা অঞ্চলে ভূমির পরিমাণ ১০ শতাংশ।
স্বাধীন ভারতবর্ষের উচিত ছিল যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া। তারা সেটা করেনি; বরং মেইতিদের পাহাড়ে জমি কেনার অনুমতি দেওয়া না হলেও উপজাতিদের উপত্যকা অঞ্চলে জমি কেনার সুযোগ দেওয়া হলো। এতে মেইতিদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে যায়।
শুধু যখন চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটেছে, তখনই সংবাদমাধ্যম উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে নজর দিয়েছে—যেমন নগ্ন নারীর ভিডিও প্রকাশ। এ ভিডিও প্রকাশের পরই মোদি মণিপুর নিয়ে দুই মাসের নীরবতা ভাঙলেন। এমনকি এই ভিডিও নিয়ে নিন্দা জানালেও গত মে থেকে সেখানে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে মোদির মুখ থেকে কোনো কথা শোনা যায়নি।
ত্রুটিযুক্ত ঔপনিবেশিক ধারা ভেঙে ফেলার বদলে নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার ব্রিটিশদের বুনে যাওয়া বৈষম্যকে জিইয়ে রাখে। এ কারণে পাহাড়ের উপজাতি ও উপত্যকার মেইতিদের মধ্যে সম্পর্কের যে চিড় ধরেছিল, তা বাড়তে বাড়তে রীতিমতো গুহার মতো গভীর হয়ে যায়।
এখন কুকিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ আরও বেড়েছে। যদিও কুকিরাই মণিপুরের আদিবাসী। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা এন বীরেন সিং নতুন এক ভাষ্য নিয়ে এসেছেন। তিনি বলছেন, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর সেখানকার চিন পাহাড় থেকে কুকিদের অব্যাহত অনুপ্রবেশ ঘটছে। এর ফলে ভূমি ও অন্যান্য সম্পদের ওপর ধারাবাহিক চাপ বাড়ছে।
সিং মেইতি সম্প্রদায়ের এবং তাঁর আচরণ পক্ষপাতমূলক—এ অভিযোগ আছে। যদি সত্যিই কুকি-জো জনগোষ্ঠীতে হঠাৎ সংখ্যা বৃদ্ধি দেখা দেয়, তা প্রমাণ করার একমাত্র উপায় পরিসংখ্যান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ও বিজেপি ২০২১ সালে যে আদমশুমারি হওয়ার কথা ছিল, তা করেনি। এ কারণে কুকিরা দলে দলে মণিপুরে অনুপ্রবেশ করছেন বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তার পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা হাজির করতে পারেনি।
নানা দিক থেকে বলা যায়, মণিপুর যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তা আসলে ভারতের দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। রাজ্যের পর রাজ্যে পুলিশ সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা না দিয়ে কীভাবে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে, সেটাই একবার ভেবে দেখুন। পুলিশের এই আচরণের কারণ ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে পাওয়া পুলিশ অ্যাক্ট। এ আইন দিয়ে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের দমন করেছে। মণিপুরের পুলিশ যদি ইম্ফলে কুকি-জো সম্প্রদায়ের মানুষকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়, তার কারণ তারা সরকারের নির্দেশনা মেনে চলছে এবং সংবিধান মেনে চলছে না। যার অর্থ হচ্ছে, সব নাগরিক সমান নয়।
কিন্তু মণিপুর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের মানুষ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা—বহু বছর ধরে তাঁদের বোঝানোই হয়েছে এভাবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রধানত তিব্বতি-বর্মণ এবং অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোত্রভুক্ত। তাঁদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ও মুখাবয়ব আলাদা। সে কারণেই কি ভারতের আর্য-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী তাঁদের সঙ্গে মিলিয়ে চলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। একই সময়ে এ অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ ও সহযোগিতার যে অনুরোধ, তা নয়াদিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ের শক্তিশালী প্রাচীর এবং সংবাদমাধ্যম অতিক্রম করতে পারেনি।
শুধু যখন চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটেছে, তখনই সংবাদমাধ্যম উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে নজর দিয়েছে—যেমন নগ্ন নারীর ভিডিও প্রকাশ। এ ভিডিও প্রকাশের পরই মোদি মণিপুর নিয়ে দুই মাসের নীরবতা ভাঙলেন। এমনকি এই ভিডিও নিয়ে নিন্দা জানালেও গত মে থেকে সেখানে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে মোদির মুখ থেকে কোনো কথা শোনা যায়নি।
এ থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? মণিপুর যদি বিরোধী দল-শাসিত রাজ্য হতো, তারপরও মোদি মণিপুরের প্রতি এই মনোভাবই পোষণ করতেন।
আজকের দিনে দেশে আসলে এ-ই হচ্ছে। যাঁরা যন্ত্রণাদগ্ধ, তাঁদের এখন নিজেদের চোখ নিজেদেরই মুছতে হবে। সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে না থেকে গুছিয়ে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ কেন ভারতে নিজেদের প্রতারিত মনে করেন—এ দোষ তাঁদের ঘাড়ে চাপানো কেন? অনেক আশা আর প্রত্যাশা নিয়ে সাত দশক আগে যে অ্যাকসেশন তাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, সে প্রসঙ্গ তুললেই-বা তাঁদের দোষ দেবেন কেন?
ভারত তাঁদের হারিয়ে দিয়েছে। আবারও।
প্যাট্রিসিয়া মুখিম সম্পাদক, শিলং টাইমস
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ শেখ সাবিহা আলম